প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
মাসাই মারা বা আম্বোসেলীর মত তো নয়ই এমনকি লেক নাকুরুর মত জনপ্রিয়তাও লেক নৈভাসার নেই। তবুও শেষ পর্যন্ত যে কারণে লেক নৈভাসা বেছে নেয়া তা হল শুধুমাত্র এখানেই পর্যটকেরা পায়ে হেঁটে তৃণভোজী প্রাণীদের খুব কাছ থেকে দেখতে/পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। কোন মাংসাশী প্রাণী আশে পাশে না থাকার কারণে পর্যটকেরা এই সুযোগ পান; অন্য পার্ক/ন্যাশনাল রিজার্ভগুলিতে অনেক অনুরোধ করলে ২-১ মিনিটের জন্য গাড়ী থেকে নামতে দেয় বটে তবে সেক্ষেত্রে প্রাণীদের কাছে যাবার বা ভালমত পর্যবেক্ষণ করার কোন সুযোগ থাকেনা - বড়জোর তাদের পেছনে রেখে ২-১ টা ছবি তোলা যায়।
যাই হোক ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে লাইনে আসি। হ্যাঁ তো যা বলছিলাম, নৈভাসা নামটা এসেছে মাসাই শব্দ "Nai'posha" যার কাছাকাছি বাংলা ভাবানুবাদ হতে পারে "বিক্ষুব্ধ জলাধার"। মাঝেমধ্যে ঝড় হলে লেকের পানির প্রলয়নাচন দেখে হয়ত মাসাইরা এরকম নাম দিয়েছে।
লেক নৈভাসায় এসে প্রথম দেখতে পেলাম Superb Starling (Lamprotornis superbus)
পাখীটা দেখতে এমনিতেই অপূর্ব, বিকেলের রোদ চকচকে পালকের উপর ঠিকরে পড়ে জেল্লা যেন আরও বাড়িয়ে দিল। সতর্ক চোখের দৃষ্টি দেখে যারা ভাবছেন ব্যাটা মোটেই মানুষের কাছে আসবেনা তাদের জানিয়ে রাখি আপনার হাত থেকে খাবার খেতে খুবই পটু এই পাখীটি।
হাটতে হাটতে চোখে পড়ল আফ্রিকার অন্যতম খুদে অ্যান্টিলোপ ডিক ডিক এর সাথে। আকারে একটা ছাগলের বাচ্চার সমান প্রাণীটি অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।
কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করার সাথে সাথে এক দৌড়ে হারিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
আগেই বলেছি লেক নৈভাসা তৃণভোজী প্রাণীদের খুব কাছ থেকে দেখা/পর্যবেক্ষণের জন্য অনন্য জায়গা। একটা জেব্রা দেখতে পেয়ে আমার স্ত্রী চলে গেলেন হাত মেলাতে।
হাত শেষ পর্যন্ত আর মেলানো হয়নি - একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাওয়ার পর উনি যতই নিকটবর্তী হন জেব্রা ঠিক ততটুকু দূরত্ব বজায় রেখে দূরে সরে যায়। জিরাফের ক্ষেত্রে অবশ্য ঘটেছে উল্টো ঘটনা। জিরাফ যত কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে আমার স্ত্রী ততোধিক দূরে চলে যান।
যাই হোক তৃণভোজী প্রাণীদের পিছনে ফেলে আমরা চলে আসলাম লেক নৈভাসার ধারে। বেশ কিছু পাখী চোখে পড়ল এখানে। তাদের মধ্যে যে কয়টিকে নিয়ে না বললেই নয় সেই লিস্টের প্রথমেই রয়েছে Variable Sunbird (Cinnyris venustus) অনেকগুলো রঙের সমাহার সমৃদ্ধ ৪ ইঞ্চির ক্ষুদে এই পাখীটি শুধু যে দেখতেই সুন্দর তাই নয় টুঁই টুঁই শব্দে বেশ সুমধুর গান গাইতেও ওস্তাদ।
কখন ফুলের মধু খাবার জন্য সুচালো চঞ্চু গুঁজে দিবে ফুলের ভিতর তার জন্য অপেক্ষা করতেই করতেই পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।
ওদিকে তখন ঝোপের মাঝে মাছের অপেক্ষায় রয়েছে মাছরাঙাটি।
দেখতে পুরোপুরি Giant kingfisher (Megaceryle maxima) এর মত পাখীটি কিন্তু আকারে বেশ ছোট। আবার পাখীটার বসার ধরণ থেকে মনে হয়না যে বয়সে এখনও বাচ্চা আছে। অনেক চেষ্টা করেও অন্য কোন মাছরাঙার সাথে পাখীটির মিল পেলাম না। ব্লগের কোন পাখী বিশারদ যদি তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন খুব উপকৃত হব।
ঝটপট শব্দ শুনে উপরে তাকাতে দেখি উড়ে যাচ্ছে দুটো Egyptian goose (Alopochen aegyptiaca)
মজার ব্যাপার হচ্ছে যদিও পাখীটির নামের সাথে মিশরের নাম জড়িয়ে আছে পুরো মিশর জুড়ে কিন্তু এদের দেখা যায় না। অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রে যখন পুরো দেশ জুড়ে এদের বিস্তৃতি মিশরে শুধু কিছু নির্দিষ্ট অংশে এদের দেখা যায় এবং আমার গত ৮ মাস মিশর বাসে আমি একবারও মিশরীয় রাজহাঁস দেখিনি। ধারণা করা হয় প্রাচীন মিশরীয়রা সর্বপ্রথম এদের বুনো প্রজাতিকে পোষ মানায় এবং সেই কারণে এদের নামের সাথে মিশরের নাম জুড়ে যায়।
আমাদের গাইড প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছিল যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আগে আমরা যেন লেকের পাড় থেকে সরে এসে বিদ্যুতায়িত বেড়া দিয়ে ঘেরা আমাদের লজ এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ি। সাবধান করার কারণ হচ্ছে বিশালদেহী জলহস্তী। খাদ্যাভ্যাস এর দিক দিয়ে জলহস্তী মোটেও মাংসাশী নয় কিন্তু তার পথের সামনে পড়লে মানুষের আর আস্ত নেই - স্রেফ দু টুকরো করে শরীরটাকে কেটে ফেলে পথের কাঁটা দুর করে এই আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ প্রাণীটি। অনেকেই হয়ত জানেন যে আফ্রিকায় যত মানুষ সিংহের হাতে মারা যায় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী মারা যায় জলহস্তীর হাতে। আফ্রিকায় মানুষ মারার ক্ষেত্রে শীর্ষে অবস্থান করা এই প্রাণীটির হাতে প্রতি বছর গড়ে ৩০০০ মানুষ মারা যায়। সংখ্যাটা যেন আরও বেড়ে না যায় তাই লেকের ধারে অপূর্ব সূর্যাস্ত না দেখেই ফিরে চললাম লজের দিকে।
লজের সীমানায় প্রবেশ করতেই এই ওয়াটার বাক টা বলে উঠল "ওয়েলকাম ব্যাক"
পরের দিন সকাল সকাল যাত্রা শুরু হল আম্বোসেলী পার্কের দিকে।
যাত্রাপথে নাইরোবীতে যাত্রাবিরতি। ফিরে আসার সময় নাইরোবীতে সময় পাবনা তাই এই ফাঁকেই চলে গেলাম সেন্ট্রাল ব্যাংক অব কেনিয়াতে। আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি পরিমাণ ধাতব মুদ্রা আর নোট পাওয়া গেল। যাত্রাবিরতি শেষে পুনরায় যাত্রা শুরু আম্বোসেলীর দিকে।
নাইরোবী থেকে আম্বোসেলীর পর্যন্ত রাস্তাটা একদম মসৃণ আর প্রকৃতিও বেশ সুন্দর। চলার পথে প্রায় প্রত্যেকটি গাছে গাছে ঝুলছে অনেকগুলো করে পাখীর বাসা
কিন্তু কোন দুষ্ট ছেলে নজরে পড়ল না যে পাখীর বাসা ভাঙ্গছে/টেনে নামাচ্ছে গাছ থেকে কিংবা ডিম/ছানা চুরি করছে বাসা থেকে।
রাস্তায় বেশ কিছু জিরাফ চোখে পড়েছে। একবার ভাবলাম গাড়ী থেকে নেমে ছবি তুলি। গাড়ী থেকে যেই নেমেছি দুটো জিরাফ এমন অপলক দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে লাগল যে আমরাও ভুলে গেলাম আমাদের গাড়ীতে উঠতে হবে।
যাই হোক জেমস এর হর্ণের চোটে শেষ পর্যন্ত গাড়ীতে উঠে আবার রওয়ানা হলাম কিন্তু জিরাফ-দ্বয় থেকে দৃষ্টি ফেরালাম না, ওরাও যতক্ষণ দেখা যায় ওরকম অপলক চোখেই তাকিয়ে রইল।
আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি আম্বোসেলী পার্কের কাছাকাছি।
আম্বোসেলী শব্দটা এসেছে মাসাইদের মা ভাষার "এম্পোসেলী" থেকে। যার অর্থ লবণাক্ত ধুলাময় এলাকা। নামকরণ যে কতটা সার্থক আম্বোসেলী পার্কে প্রবেশ করার পর থেকেই তা টের পেয়ে গেছি ধুলো খেতে খেতে।
আম্বোসেলী মুলতঃ বিখ্যাত এখানে বসবাস করা অগণিত হাতি আর জিরাফের কারণে। সবচেয়ে বড় দাঁতের হাতিগুলো এই অঞ্চলে দেখা যায় তাই হাতি শিকারীদের স্বর্গরাজ্য ছিল এ এলাকা। এখনও এ এলাকা স্বর্গরাজ্য তবে হাতি শিকারীদের জন্য নয়, হাতির ছবি শিকারীদের জন্য। আম্বোসেলী যাওয়ার পেছনে আরও একটা প্রধান কারণ থাকে আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমাঞ্জারো দেখার - যে পর্বতের চূড়ার ছবি অনেক সময়ই আফ্রিকার সমার্থক হিসেবে দেখান হয় । কেনিয়া অংশে আবার এই পার্ক থেকেই সবচেয়ে ভালভাবে কিলিমাঞ্জারো দেখা যায়।
যাই হোক পার্কে প্রবেশের আগেই চোখে পড়ল Litocranius গণের একমাত্র সদস্য /প্রজাতি Gerenuk (Litocranius walleri) এর, Waller's gazelle নামেও যদিও অনেকে চেনেন একে।
সোয়াহিলি ভাষায় আবার এর নাম Swala twiga যার অর্থ জিরাফের গলাধারী অ্যান্টিলোপ। নামটা যে একদম সার্থক তাতো বুঝতেই পারছেন।
শরীরের তুলনায় একদম ছোট মাথা কিন্তু বড় বড় কানের কারণে প্রাণীটিকে দেখলে গোমড়া মানুষের মুখেও হাসি ফুটতে বাধ্য। শিংওয়ালা পুরুষ জেরেনুকের চেহারা যদিও অত মজাদার নয়।
অ্যান্টিলোপকূলের সবচেয়ে ভদ্র সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম পার্কের ভেতর। প্রথমেই দেখতে পেলাম বিশালদেহী দু রঙা এই হাতিটিকে
আসলে কিছুক্ষণ আগে জলাভূমি থেকে আসার কারণে উনি এরকম কালো এবং ছাই রঙা মূর্তি ধারণ করেছেন।
ওদিকে আবার দুই হাতি ঝগড়ার ছলে খুনসুটিতে ব্যস্ত
হাতিদের দিকে কোন খেয়াল নেই, অবিরত খাবার খুঁজে চলেছে উটপাখীটি
জেমস আবার তাড়া দিতে শুরু করেছে কারণ সূর্যাস্তের আগেই আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে পার্ক থেকে, তাহলে কি আমাদের আর গোধূলিলগ্নে বন্যপ্রাণীদের ঘরে ফেরা দেখা হবে না? যাই হোক শেষ মেষ গোধূলি না হলেও জেব্রাধূূলি লগ্নে কিছু জেব্রাকে দেখলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে চলে যেতে
কেনিয়াতে অলরেডী ৫ দিন থাকা হয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আকাশিয়া গাছের সাথে সূর্যাস্ত দেখিনি। আফ্রিকা শুনলেই বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি সূর্যাস্তের যে ছবি মানস-পটে ভেসে আসে তাতে তো আকাশিয়া গাছ থাকবেই আর তার সাথে যদি হাতি বা জিরাফও পেয়ে যাই তাইলে তো সোনায় সোহাগা। ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন না হলেও আম্বোসেলীতেই প্রথম পেলাম সেই স্বর্ণালী সন্ধ্যা। আকাশিয়া গাছের কোলে সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল।
সূর্যাস্তের শেষ সোনালী ছটা যখন কিলিমাঞ্জারোর শীর্ষে ঠিকরে পড়ছে আমরাও পার্ক ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের ক্যাম্পের দিকে।
কালকে আবার ফিরে আসতে হবে পার্কের বাকী অংশ দেখার জন্য।
ছবি কৃতিত্ব: ৩/৪ টা বাদে বাকী সকল ছবি তোলার কৃতিত্ব আমার স্ত্রীর। কোন্ গুলি আমার তোলা সেটা নিয়ে দাম্পত্য বিবাদ ২০১১ সাল থেকে এখন অবধি চলছে।
বি:দ্র: যে প্রাণী/পাখী দের বাংলা নাম জানা নেই তাদের ইংরেজী নামের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক নামও জুড়ে দিলাম-জীবজগত নিয়ে জানতে আগ্রহীদের হয়ত সুবিধে হতে পারে ভেবে।
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
চতুর্থ ও শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:১৭