প্রথম পর্ব
মাসাইমারা থেকে বের হয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেক নাকুরু। মাসাইমারা য় আমরা বিগ ফাইভ গ্রুপের ৪ সদস্য সিংহ, হাতি, মোষ (কেপ বাফেলো) আর চিতাবাঘকে দেখতে পেলেও গণ্ডার দেখতে পাইনি। অনেকেই হয়ত জানেন, শুধুমাত্র যারা বিগ ফাইভ সম্পর্কে অবহিত নন তাদের কে এবেলা জানিয়ে রাখি বিখ্যাত শিকারীরা আফ্রিকায় পায়ে হেঁটে যে ৫ টি বড় প্রাণী শিকার করা সবচেয়ে কঠিন তাদের নিয়ে এই লিস্টটি তৈরী করেছিলেন। এখন যখন বন্দুকের নলের পরিবর্তে ক্যামেরার লেন্স দিয়েই বেশী শিকার (shoot) হয় বিগ ফাইভের সংজ্ঞা তাই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে ফটোশিকারী দের দ্বারা - যাই হোক সেই প্যাঁচালে না গিয়ে লেক নাকুরু পার্ক সম্পর্কে একটু বলে নিই। ১৮৮ বর্গকিলোমিটার আকারের এই পার্কটি মূলতঃ বিখ্যাত ছিল পাখি দেখার জন্য। পুরো লেকটি জুড়ে থাকা ফ্ল্যামিঙ্গোর কারণে লেকটির রং হয়ে থাকত গোলাপী। বর্তমানে পানি দূষণের কারণে অর্ধেকের বেশী ফ্ল্যামিঙ্গো অন্য লেক এ চলে গেছে। পাখি ছাড়াও এই পার্কটি বিখ্যাত চিতাবাঘ এর জন্য আর অন্যান্য প্রাণীতো রয়েছেই। যারা খুব কম সময়ের জন্য কেনিয়া যেতে চান তাদেরকে আমি লেক নাকুরু যেতে উৎসাহিত করব কারণ পার্কটির আকার ছোট হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরণের প্রাণী দেখার সম্ভাবনা এখানে অনেক বেড়ে যায় অন্যান্য বড় পার্ক/রিজার্ভ যেমন মাসাই মারা বা আম্বোসেলীর চেয়ে। লেক নাকুরু পছন্দ হওয়ার পিছনে আমার অন্য একটা বড় কারণ হল আমাদের ক্যাম্পটি ছিল একদম পার্কের সীমানা প্রাচীর এর সাথে লাগানো আর ক্যাম্পটি এমনভাবে সাজানো যে মনে হবে জঙ্গলের মধ্যেই আছি।
দুপুর বেলায় ক্যাম্পে পৌঁছে দুপুরের খাবার চটজলদি সেরেই বেরিয়ে পড়লাম পার্কের উদ্দেশ্যে।
দুই অলিভ বেবুন যখন ঝগড়ায় মত্ত
ইমপালার এক দল অবাক দৃষ্টিতে তখন তা তাকিয়ে দেখছে -
কিছুটা এগুতেই পেয়ে গেলাম তাকে - পূরণ হল বিগ ফাইভ দেখার আশা। আর কি ভাগ্য কি ভাগ্য পেয়ে গেছি সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য কালো গণ্ডার এর দেখা।
একা একা চরে বেড়াচ্ছে, পরবর্তীতে যখন সাদা গণ্ডারদের দলবদ্ধভাবে চরে বেড়াতে দেখেছি খারাপই লেগেছে বেচারার জন্য।
চোখে পড়ল Crowned Lapwing (Vanellus coronatus).
এই প্রজাতির মেয়ে পাখীর মন জয় করা পুরুষের জন্য সহজ নয়। উড়ে উড়ে ডিগবাজী দিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় যে সে সবচেয়ে ভাল উড়তে পারে, তবেই মেলে ঘর বাঁধার অনুমতি।
ল্যাপউয়িং কে ছেড়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল Grey Crowned Crane (Balearica regulorum)
দেখুন না এদের ঝুঁটি আর পালকের বাহার
সাধে কি আর পাখীটি উগান্ডার জাতীয় পাখী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে? উগান্ডার পতাকা আর কোট অব আর্মসে ( সঠিক বাংলা জানা নেই - জাতীয় প্রতীক বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না ) রয়েছে পাখীটির উপস্থিতি।
আস্তে আস্তে চলে আসলাম লেকের পাড়ে। আগেই বলেছি সেই আগের মত ফ্ল্যামিঙ্গোর আর উপস্থিতি নেই পুরো লেক জুড়ে। তবে যারা আছে তাদের সাথে রয়ে গেছে কিছু পেলিক্যান (গ্রেট হোয়াইট পেলিক্যান) আর অন্যান্য পানিতে থাকা পাখী। এরকম কোন ছবি দেখেই কি পণ্ডিতরা বানিয়েছিলেন বাগধারা - হংস মধ্যে বক যথা ! !
ফ্লেমিঙ্গোর মধ্যে যেমন কিছু Greater flamingo (Phoenicopterus antiquorum) কে পেলাম
Lesser flamingo (Phoenicopterus minor) ও নিরাশ করেনি
সন্ধ্যা নেমে আসছে আর সেই সাথে সাথে যেন বেড়ে চলেছে পেলিক্যানগুলোর সান্ধ্য-পূর্ব সাজসজ্জা
ফেরার পথে হটাত করে নামল বৃষ্টি আর বৃষ্টি নামাতে কেমন যেন জবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইজিপশিয়ান গুজ এর এই দলটি।
এর পরেই দেখা পেলাম এই অপূর্ব পাখীটির - Saddle-billed Stork(phippiorhynchus senegalensis),
বাংলা করলে কি জিন-মুখী বক হবে? এই পাখীটির উপস্থিতি কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফস এ রয়েছে, হায়ারোগ্লিফস এ পাখীটির উপস্থিতি থাকলে উচ্চারণ হয় অনেকটা "ba" এর মতন । হায়ারোগ্লিফস এর কথাই যখন উঠল তখন দেখে নিন সেই আমলের সবচেয়ে পবিত্র প্রাণী আইবিস কে যাদের দেখাও আমরা নাকুরুতে পেয়েছিলাম -
যদিও এরা আসলে Glossy Ibis (Plegadis falcinellus), প্রাচীন মিশরের পূজনীয় সেই African sacred ibis (Threskiornis aethiopicus) নয়, তবে তাদের জাতভাই তো বটে।
সেই দিনের মত জীবজন্তু দেখায় ক্ষান্ত দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু নৃত্যপর্ব দেখে দিলাম ঘুম
পরদিন ভোর বেলায় তাঁবু থেকে বেরিয়েই মন ভাল হয়ে গেল। যদিও মাসটি ছিল সেপ্টেম্বর এর শুরু কিন্তু আমি যেন জানুয়ারীর শেষভাগের বাংলাদেশের আবহাওয়া টের পেলাম।
গরমের সময় উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে যাওয়ার মজাটা এখানেই।
সকাল সকাল বেরোনো হল পার্কের উদ্দেশ্যে। কেনিয়ায় বসে উগান্ডার জাতীয় পাখীকে দেখে ফেললাম কিন্তু কেনিয়ার টার দেখা পেলাম না তাই কি হয়? সেই জন্যই যেন দেখা দিলেন Lilac-breasted Roller (Coracias caudatus)
মহাশয় দেখতে ছোট হলে কি হবে এই পুঁচকে শরীর নিয়ে তিনি একটি অনন্য কীর্তির অধিকারী। কেনিয়ার পাশাপাশি তিনি বতসোয়ানার ও জাতীয় পাখী।
কালো গণ্ডার তো গতকাল দেখতে পেয়েছি, আজকে দেখা মিলল সাদা গণ্ডারেরও
একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল Spur-winged Lapwing (Vanellus spinosus)
দেখতে পেলাম থমসন'স গ্যাজেলের লড়াই
লড়াই শেষে পরাজিত গ্যাজেল রণে ভঙ্গ দিলেও বিজয়ী গ্যাজেলের রোষায়িত তাড়া করার দৃশ্য
রথসচাইল্ড জিরাফ দেখারও সৌভাগ্য হল..
ব্যারিঙ্গো জিরাফ বলেও অনেকে ডেকে থাকেন একে। যদিও জিরাফ বিপন্ন প্রাণী নয় কিন্তু ব্যতিক্রম এই প্রজাতিটি। যে গুটিকয় জায়গায় এদের দেখা যায় তার মধ্যে লেক নাকুরু পার্ক অন্যতম। যাই হোক এর পরে দেখা পেলাম ধ্যানে মগ্ন কেপ বাফেলোকে...
পার্কের শেষ মাথায় চলে এসেছি আমরা। দুর্ভাগ্য আমাদের যে লেক নাকুরুতে আমরা কোন চিতাবাঘ দেখতে পাইনি। গাছের ডালে বিশ্রামরত চিতাবাঘের দর্শন পাওয়া লেক নাকুরুতে খুব সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ - চিতাবাঘের দেখা পেলাম না, সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতেই যেন পার্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিদায় জানাল ওয়াটার বাকের দলনেতা
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেক নৈভাসা।
চলবে
ছবি কৃতিত্ব: ৩/৪ টা বাদে বাকী সকল ছবি তোলার কৃতিত্ব আমার স্ত্রীর। কোন্ গুলি আমার তোলা সেটা নিয়ে দাম্পত্য বিবাদ ২০১১ সাল থেকে এখন অবধি চলছে।
বি:দ্র: যে প্রাণী/পাখী দের বাংলা নাম জানা নেই তাদের ইংরেজী নামের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক নামও জুড়ে দিলাম-জীবজগত নিয়ে জানতে আগ্রহীদের হয়ত সুবিধে হতে পারে ভেবে।
প্রথম পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ ও শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:২১