১ম পর্বের লিংক
২য় পর্বের লিংক
পরের দিন অফিস এর কাজ শুরু। আমরা মূলতঃ একটা স্টাডি করছিলাম বেভারেজ ল্যান্ডস্কেপ এর উপরে, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন ক্লাসের লোকজন কি কি পানীয় গত ২৪ ঘণ্টায় পান করেছে, কখন করেছে, কেন করেছে এগুলি জিজ্ঞেস করা হবে আর তাদের সব উত্তর দিয়ে যে ডাটাবেজ তৈরী হবে তা অ্যানালাইজ করে রিপোর্ট তৈরী করে বলা হবে ক ক্লাসের লোকজন সকাল ৮ টা থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত এমন একটা পানীয় খুঁজছে যা বর্তমানে মার্কেটে নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো যাই হোক, পানি এমন একটা পানীয় যেটা পৃথিবীর সবদেশের মানুষই পান করে এজন্য আমাদের স্ক্রিপ্ট এ একটা অপশন ছিল যদি কেউ ভুল করে পানি র কথা উল্লেখ না করে তাহলে তাকে যেন মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে আমরা শুধু কেনা পানির/পানীয়র কথা জানতে চাচ্ছিনা বরং ফ্রি তে পাওয়া কোন সোর্স থেকে পানি পান করলেও যেন তা উল্লেখ করে। যাই হোক রাশান ভাষার ফিল্ড ব্রিফিং দেখে তারপর যখন ডামি ইন্টারভিউ শুরু হল দেখি পানির কথা কেউ উল্লেখ করছেনা। একজন, দুজন এরকম করার পরার আমি ফিল্ড ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম পানি কেন আসছেনা, তখন কি বলে জানেন? বলে গত ২৪ ঘণ্টায় কেউ পানি খায়নি তাই আসছেনা। এটাতে আমার এত অবাক হওয়ার কি আছে ! ! শুনে কার না মেজাজ গরম হবে বলেন? আমি মনে মনে “আমার সাথে ফাজলামি কর?” বলতে বলতে মধুর হেসে বললাম কিন্তু গত ২৪ ঘন্টায় কি এক ঢোক পানি ও খায়নি? ফিল্ড ম্যানেজার ততোধিক মধুর স্বরে বলে না খায়নি। একে তো বিপরীত লিঙ্গ, শক্ত কথা বলতেই কেমন যেন খারাপ লাগে তারপর আবার গায়ে গতরে আমারই সমান – ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হতে পারে। তো যাই হোক মেজাজ ঠাণ্ডা রেখেই জিজ্ঞেস করলাম –
তা তুমি গত ২৪ ঘন্টায় পানি খাওনি,
মেয়ে বলে – না, খাইনি।
গত পরশু? – না খাইনি।
তা বাছাধন কবে লাস্ট পানি খেয়েছ শুনি – উমমমম ঠিক মনে করতে পারছি না, ১০-১২ দিন আগে একবার সুপার মার্কেট থেকে ৫০০ মিলির এক বোতল পানি কিনে খেয়েছিলাম। তাও প্লেইন ওয়াটার না, স্পার্কলিং ওয়াটার।
এই কথা শুনে যে কারও মাথা একবার চক্কর দিতে পারে, আমার কয়েকবার চক্কর দিয়ে উঠল কারণ আমার মনে পড়ল এ ঘটনার ৪-৫ মাস আগে আমরা যখন একটা গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্ল্যানিং এর কাজ করছিলাম, তখন কাজাখস্তান ই একমাত্র দেশ ছিল যে দেশের স্পার্কলিং ওয়াটার এর কনজাম্পশান দেখাচ্ছিল ব্র্যান্ডেড প্লেইন ওয়াটার এর চেয়ে বেশী। ডাটাবেজ সাপ্লায়ারকে শাপ শাপান্ত করে খুবই স্মার্টলি স্পার্কলিং এর ডাটা প্লেইন এ আর প্লেইন এর ডাটা স্পার্কলিং এ দেখান হয়েছিল। খুব বড়সড় সংখ্যা না হওয়ায় এ ভুলটা কারোরই শেষ পর্যন্ত চোখে পড়ে নি।
তো যাই হোক বিশালদেহী+বপু ( ব দিয়ে অন্য একটা শব্দ মাথায় ঘুরঘুর করছে, কিন্তু সেটা লিখলে অনেকে আবার হয়ত আমাকে সংখ্যা তত্ত্ব সহ +/- প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো শুরু করবেন, সুতরাং সেদিকে আর না যাই) রাশান ললনা কে তখন জিজ্ঞেস করলাম – পিপাসা পেলে খাওটা কি? আর পানি খেতে এত আপত্তিই বা কেন?
বলে চা আছে, জুস আছে, সফট ড্রিংক্স আছে, কেফির ( কাজাখস্তানের আর একটা লোকাল ড্রিংক) আছে আর কিছু না থাকলে অন্তত বিয়ার তো আছেই। পানি খাব কেন? পানির আবার কোন টেস্ট আছে নাকি!!
এতক্ষণে আমার তার চায়ের কাপের দিকে নজর পড়ল। সেই সকাল বেলায় এক কাপ চা নিয়ে বসেছিল সে, দু ঘণ্টা পরেও কাপে কিছু চা এখনও অবশিষ্ট আছে। অবস্থা বেগতিক হতে পারে ভেবে আগেই জিজ্ঞেস করে নিলাম অফিসে খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে কিনা – মৃদু হেসে উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে তা পাওয়া যাবে।
দুপুরে বিশালবপুর গেস্ট হিসেবে অফিসের কাছের এক ব্যুফে রেস্টুরেন্ট এ চলে গেলাম। আমি আবার একটু রসিক মানুষ, মানে ভোজনরসিক আর কি!! তা হয়ত আমার পোস্টের পুরো কলেবরে খাবার দাবার বিষয়ক অংশের % দেখেই বুঝে ফেলেছেন আশা করি। তো রেস্টুরেন্ট এ ঢোকার ৫ মিনিটের মধ্যেই প্লেট ভর্তি করে বসে পড়লাম।
আমি যে দেশেই যাই না কেন পারতপক্ষে সেদেশের লোকাল ডিশ খাওয়ারই চেষ্টা করি তা সেটা খেতে যতই বিদঘুটে হোক না কেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। কন্টিনেন্টাল ডিশ গুলো বাদ দিয়ে তাই আমার প্লেটে লোকাল ডিশই ঠাঁই পেল শুধু, আর নিলাম একটা রাশান ঘরানার টমেটো স্যুপ। যাক গতকাল রাতের মত বিদঘুটে নয় খাবার দাবার। মোটামুটি পরিতৃপ্তি নিয়েই শেষ হল লাঞ্চ পর্ব।
খাওয়া দাওয়া শেষে পাতাঝরা একটা সুন্দর পথ দিয়ে অফিসে ফিরে এসে ফের শুরু হল বিরক্তিকর ব্রিফিং, বিভিন্ন ধরণের কল্পিত সমস্যা এবং তার সমাধান দিতে দিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। এই সারাটা দিন একজন কাজাখ/রাশান কেও আমি এক ফোঁটা পানি খেতে দেখিনি । তবে সূক্ষ্ম হিসাব না রাখলেও প্রত্যেকেই যে বেশ কয়েক কাপ চা সাঁটিয়ে দিয়েছে তা খেয়াল করেছি।
বিশালবপু সভেৎলানা ( বাঙালী জিভ দিয়ে রাশান সভেৎলানা অনেক চেষ্টা করেও উচ্চারণ করতে পারলাম না) কে গতকাল রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেলার কথা বললাম। ইঙ্গিতে এটাও বুঝিয়ে দিলাম সে যদি এই সন্ধ্যাটা আমাকে আলমাতি দর্শনে সহায়তা করে তাহলে আমি না করব না। মাত্র ৪ মাস হল বিয়ে হয়েছে, তবুও আমাকে নিরাশ করতে বুঝি বেচারার কষ্ট হল। ৪ জনের কমে যেহেতু বেশবারমাক খাওয়া যায় না ( প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য) তাই ওর জামাইকেও ডাক দিতে বললাম। হয়ত ৩ জন দেখলে বেশবারমাক সার্ভ করলেও করতে পারে। কিন্তু জামাই বাবাজী নাকি পাঁড় মাতাল ( ভদকা না প্লে স্টেশন এর) ! ! উনি আসতে রাজী হলেন না। সভেৎলানা ফোনে বেশ কয়েক বার অনুরোধ, হুমকি ধামকি এবং অবশেষে কাকুতি মিনতি করেও জামাইকে বাসা থেকে বের করতে পারল না। অগত্যা আমাদের দুজনকেই সান্ধ্য-ভ্রমণে বের হতে হল। রাতের আলমাতি যদিও ঠিক উন্নত দেশের মেট্রোপলিটন গুলোর মত অত আলো ঝলমলে নয় তবুও এর একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। আমরা ঘুরে বেড়ালাম পার্লামেন্ট ভবন, গোর্কি পার্ক ( জানি না এটাই উইন্ড অব চেঞ্জ গানের গোর্কি পার্ক কিনা) আর তার আশেপাশের রাস্তায়। প্রচুর কৃত্রিম ফোয়ারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা শহর জুড়ে।
রাতে বিভিন্ন রং এর আলো ফেলে পানির রং একটু পর পর পরিবর্তন করা হচ্ছে।
আর রয়েছে সোভিয়েত জমানার নিদর্শনস্বরূপ প্রচুর ভাস্কর্য। বেশীরভাগ ভাস্কর্যের থিম হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুশ সৈন্যদের বীরত্বগাথা। সবই সোভিয়েত শাসনামলে তৈরী। সেই আমলে এই সব ভাস্কর্যের পাশাপাশি প্রত্যেক বড় শহরেই উপস্থিত ছিল লেনিন এর মূর্তি। যা বর্তমানে এক কিরগিজস্তান ছাড়া বাকী সব মুক্ত দেশেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। দেখলাম লেনিনের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা সেই জায়গাটিও।
ইচ্ছা ছিল এদের কাছে শুনব সোভিয়েত শাসনামল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের বর্তমান অনুভূতি কি, কিন্তু ১৯৮৬ ( সত্যি মিথ্যা আমি জানি না) তে জন্ম নেওয়া সভেৎলানার সোভিয়েত শাসনামল সম্পর্কে তেমন কিছুই মনে নেই, তাই সেই আলাপ আর গড়াল না। ভদ্রভাবে তাই সোভিয়েত শাসনামল বাদ দিয়ে জানার চেষ্টা করলাম রাশান হয়ে কাজাখস্তানে সে কোন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে কিনা, এখানকার রাশানরা রাশিয়ায় চলে যেতে চায় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল সে জাতিগত-ভাবে রাশান হলে কি হবে, মনেপ্রাণে কাজাখস্তানকে এবং তার চেয়েও বেশী আলমাতিকে ভালবাসে। বাবা রাশিয়া ফেরত চলে গেছেন, মেয়েকে বেশ কয়েকবার রাশিয়া চলে আসতে বলেছেন, কিন্তু মেয়ে আলমাতি ছাড়া অন্য কোথাও যেতে নারাজ। সভেৎলানার নাকি অন্য দেশ তো দূরে থাক অন্য শহরে গেলেও নাকি খালি আলমাতি ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।
আলমাতি প্রেমিকার কাছে জানতে চাইলাম তার প্রাক্তন প্রেমিক বর্তমান স্বামীর কথা। সেও একই চিড়িয়া, জাতিগত-ভাবে রাশান কিন্তু আলমাতিকে প্রচণ্ড ভালবাসে। আলমাতির বাইরে কোথাও গেলে তারও নাকি সভেৎলানার মতই হাঁসফাঁস লাগে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম পার্কের সেই অংশে যেখানে তাদের বিয়ে হয়েছিল, জানলাম বৃষ্টির মধ্যে কেমন ছাতা মাথায় দিয়ে তাদের বিয়ে হল, বিয়ের পর তারা যে পার্কের খালের উপরে ছোট্ট পুলে একটা তালা এঁটে সেই চাবি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল খালের মধ্যে সে তালাও অনেক তালার ভিড়ে খুঁজে খুঁজে ঠিকই বের করে ফেলল।
ছবি (গুগল)
জীবনের এই সত্যটা আমি অনেক আগেই জেনেছি, তবুও আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম সভেৎলানার সেই তালা খোঁজা দেখতে দেখতে। মানুষ হতে পারে সাদা/কালো/হলুদ/কিংবা বাদামী, চোখের রং কিংবা চুলের রং আলাদা হতে পারে বা হতে পারে মরুভূমি কিংবা মেরুদেশের বাসিন্দা – ভালবাসার রং সব দেশে সব জায়গায় একইরকম।
চলবে
১ম পর্বের লিংক
২য় পর্বের লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:৫৮