সেন্ট্রাল এশিয়ার কোন একটা দেশ ঘোরার ইচ্ছে সবসময়ই ছিল, আর যেহেতু গত ১ বছর ধরে সেন্ট্রাল এশিয়ার মার্কেট নিয়ে কাজ করছি তাই আশা ছিল কাজের অছিলাতে হলেও হয়ত কোন একটা দেশ ঘুরে আসা হবে। ক্লায়েন্ট যখন একটা বড় জব কাজাখস্তান আর কিরগিজস্তান এর জন্য কমিশন করল তখনই বুঝতে পারলাম এইবার ঘুরে আসা আর মিস হবে না। সেন্ট্রাল এশিয়াতে আমি কাজ শুরু করার আগে দেশগুলি সম্পর্কে জানতাম খুব কমই। মুদ্রা সংগ্রহ করার সুবাদে শুধু এটুকু জানতাম যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পর বেশ কয়েক বছর ধরে মুদ্রাস্ফীতির কারণে কয়েকটি দেশ বেশ কয়েকবার তাদের মুদ্রা/নোটগুলি পরিবর্তন করেছে। আমার সংগ্রহে ২০০৫ এর পরে চালু হওয়া সকল মুদ্রাগুলি থাকলেও তার আগের কালেকশন খুব ভাল না। সুতরাং অফিশিয়াল কাজের পাশাপাশি পুরাতন মুদ্রা সংগ্রহের একটা ভাল সুযোগ ও চলে এলো হাতে। যে কোন নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে যতটা পারি তথ্য জেনে রাখার চেষ্টা করি। আর লোনলি প্ল্যানেট তো আছেই। যেহেতু অফিশিয়াল ট্যুর তাই খুব একটা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই। তাছাড়া আমি যাচ্ছিও শুধুমাত্র আলমাতি ( কাজাখাস্তানের প্রাক্তন রাজধানী) এবং বিশকেক ( কিরগিজস্তানের বর্তমান রাজধানী) তাই এই দুই শহর যেন ভালমতো ঘুরে দেখতে পারি তার জন্যই নেট ঘাঁটাঘাঁটি আর লোনলি প্ল্যানেট পড়া শুরু করলাম। বাংলাদেশ পাসপোর্ট-ধারী যে কোন ভাই ই জানেন যে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও শুধু সবুজ পাসপোর্টের কারণে ভিসা নাও মিলতে পারে, আমার নিজেরই এ ব্যাপারে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। তাই ভিসা না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। বেশ জটিল প্রক্রিয়া শেষে অবশেষে ভিসা মিলল ২ দেশেরই। ক্যামেরা আমার স্ত্রীর কাছে থাকায় আর স্ত্রী দুবাই এ না থাকার কারণে প্রাথমিক যে দুশ্চিন্তায় পড়লাম সেটা হল ছবি তুলব কিভাবে? আর এই উপলক্ষে আমার মত অতি আনস্মার্ট ব্যক্তি জীবনের প্রথম স্মার্ট-ফোন কিনে ফেলল। ফোনটা ওই দুই দেশে যতটা ব্যবহার করেছি তার পরে ১ বছরে ও হয়ত ততটা ব্যবহার করিনি। এই নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি আমার অতি ডিজিটাল বন্ধুবান্ধবরা করেছে এবং প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে, কিন্তু চামড়া জানিনা ঠিক মোটা না পিচ্ছিল, পিচ্ছিলই হবে হয়ত তা পিছলে বেরিয়ে যায়। যাই হোক ভিসা মিলে গেছে, ছবি তোলারও চিন্তা নেই তাই বদর বদর করতে কোন এক বুধবার সকালে রওয়ানা দিলাম বিমানবন্দর এর দিকে আলমাতির উদ্দেশ্যে। প্রচণ্ড কুয়াশা এবং তার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট যানজট এর কারণে শারজাহ বিমানবন্দরে পৌঁছলাম ফ্লাইটের মাত্র ১৫ মিনিট আগে এবং জানতে পারলাম যে ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত।
ছবি: গুগল
সময় যখন বেঁচেই গেল, লোনলি প্ল্যানেট এর না পড়া অংশ শেষ করে ফেলতে তো কোন দোষ নেই।
নির্ধারিত সময়ের প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে বিমান ছাড়ল আলমাতির উদ্দেশ্যে। রাশিয়ানদের বই-প্রীতির কথা আগে থেকেই জানতাম, দেখলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন সদস্য কাজাখস্তানের লোকজনও সেই রীতি বজায় রেখেছে। বিমান ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই দেখি বেশ কয়েকজন কাজাখ, বই ( বেশীরভাগই পেপারব্যাক) খুলে পড়া শুরু করে দিয়েছে। এই দৃশ্য বিলেতে দেখেছি, ভারতে এই পরিসরে না হলেও দেখেছি, দুঃখ হল বাংলাদেশে কখনো দেখিনি, আগে তাও বা ট্রেন ভ্রমণে হাতে গোনা দু-একজনকে আমি বই হাতে দেখেছি তা এখন আর দেখিনা। অনেকে সারা রাস্তা ফেসবুকে কাটিয়ে দিতে পারে কিন্তু বই নৈব নৈবচ। লোনলি প্ল্যানেট পড়া শেষ, অফিসের কাজ শেষ করে কোথায় কোথায় যাব তার একটা খসড়াও বানানো শেষ। বিমান ভ্রমণের বাকি সময়টা স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটালগ অব ওয়ার্ল্ড কয়েন এর কাজাখস্তান আর কিরগিজস্তান সেকশনে চোখ বুলাতে বুলাতে পার হয়ে গেল।
বিমান অবতরণ শুরু হতেই দেশটাকে ভাল লাগতে লাগল। তিয়েনশান পর্বতমালার কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা আলমাতিতে সূর্য বিদায় নেওয়ার আগে যেন আমাকে তুষার-শুভ্র পর্বতমালার উপর থেকে স্বাগতম জানাচ্ছে।
ছবি: গুগল
সেন্ট্রাল এশিয়ার প্রত্যেকটা দেশেই রাশান ভাষার এমন দাপট যে ইংরেজ দের ভাষা কেউ ব্যবহার করে না বললেই চলে। এই দেশগুলোর যে সকল এজেন্সীর সাথে আমি কাজ করি তাদের সাথে কমিউনিকেশনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে এখানে ইংরেজী বলতে গেলে চলেই না।
কাজাখস্তান এমন এক দেশ যেখানে ইমিগ্রেশন অফিসাররা ও ইংরেজী বলেন না, আমি ইমিগ্রেশন এর সময় কিছু প্রশ্ন করাতে আমাকে ইংগিত এ একটা ফর্ম দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল যা কিছু দরকার সব ওই ফর্মে লেখা আছে এবং আমি যেন তাকে আর ডিস্টার্ব না করে মানে মানে ওদের দেশে ঢুকে যাই। আমিও কথা না বাড়িয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম দেশটার ভিতরে। আলমাতিতে বিকেলের শেষ আলোয় অবতরণ করলেও বাইরে বেরোতে বেরোতে পুরো সন্ধ্যা। শুরু হল এমন একটা দেশে আমার যাত্রা যেখানে সবকিছু রাশান/কাজাখ এ লেখা, রাস্তাঘাটে যেখানে কোন লোক ইংরেজী বলেন না। তখনো জানতাম না যে বেশীরভাগ সময় কথা না বরং হাত নেড়েই কাজ চালাতে হবে বাকী কয়েকটা দিন।
চলবে
দ্বিতীয় পর্বের লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৫১