
আমি কোন গন্ধ পাই না, পোড়া মানুষের গন্ধ। আমি আর্তনাদ শুনি না, বুক চাপড়ানো আহাজারি। আমার কাছে এসব আবেগীয় বিষয় শুধুই ‘উপাদান’। কান্নার দুর্লভ নোনাজল আমার কাছে বেরঙা, আয়োডিনহীন বর্জ্য।
সাভারের নিশ্চিন্তপুরের কারখানার যে মানুষগুলোর চোখের আয়োডিনহীন বর্জ্যে দিনের পর দিন কেটেছে, আধপেটে কেটেছে নির্ঘুম রাত, আজ ওদের অনেক দাম। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুরো দেশের আবেগ যেন উথলে পড়ছে। ‘আহারে... আহ্। মানুষগুলা এমনে মইরা গেল। আল্লা, তুমি এমন পাষাণ।’
সরকারের পক্ষ থেকে আসছে কাড়ি কাড়ি সাহায্যের ঘোষণা। কোটি টাকা। কিন্তু এই সাহায্য কাদের জন্য, আগুনে যাদের পুড়ে গেছে নাম-পরিচয়-স্বপ্ন, তাদের? না, তারা তো পলিথিনে মোড়ানো স্রেফ অঙ্গার। ওরা এ দিয়ে কী করবে? আমি বুঝে পাই না, জীবনে যারা জীবনের স্বাদ পেল না, মরণে ওদের জীবনের স্বাদ দিয়ে কী লাভ?
তাই পরিচয়ের অতীত এই মানুষগুলোর জন্য আমার কোনো মায়া নেই!
আমি বলি- ওরাতো মরবেই। ওরা মরবে, মরে সাহায্য নেবে, এরপর আবার মরবে। একজীবনে ওদের অনেকবার মরণ আসে। মুহূর্তে মুহূর্তে, সুচের ফোড়নের মতো। তবুও ওরা শোধরাবে না। ওরা শোষিত হবে, আয়োডিনহীন বর্জ্য ফেলবে, আর রক্ত পানি করে ওয়াল-মার্টে পরিচয় করিয়ে দেবে ওদের ‘ঈশ্বরদের’।
বছরের পর বছর কাজ করে যে মানুষগুলো জীবনবৃত্তান্ত নামক কোনো দলিলের দেখা পেল না, হয়তো মরণের পর বিত্তের আশায় বৃত্তান্ত নিয়ে হাজির হবে কোনো স্বজন। আর আমাদের দেশের কর্তারা কাঁদো কাঁদো মুখে তাদের হাতে বিত্ত গুঁজে দিয়ে আপাতত নিষ্কৃতি নিয়ে অপেক্ষায় রইবেন আরেকটা মহড়ার।
কারণ ওরা আছে বলেইতো যখন-তখন জাতীয়ভাবে শোক দিবসের উপলক্ষ পাওয়া যায়, ভোটের লক্ষ্যে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ‘অমীমাংসিত রহস্য’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক উন্নয়ন প্রতিবেদনে। আর ওই রহস্যের মূলস্তম্ভ আমাদের সস্তা পোশাক কারিগররা।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল অবদানের জন্য শ্রমের আড়তদাররা সরকারকে খুশি করতে পেরে এখন যেন পেয়ে বসেছে। শ্রমিকদের ওরা ‘আমাথা’, ‘আবাল’ হস্ত সম্পন্ন প্রাণী মনে করে। আর মিডিয়া ওয়ালার এদের শোককে পুঁজি করে পাতার পর পাতা ভরিয়ে লিখে যায় নিজেদের স্বার্থে।
এভাবে সবার ক্ষেতে ফসল ফলানো মানুষগুলোর জীবনের দাম কী এতোই কম? কেন ওরা কেবল মরলেই জীবনের নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ, শ্রম মজুরি- এসব নিয়ে কথা হবে? কেন ওরা জীবনে- জীবনের স্বাদ পাবে না?