সাপের লেখা আর বাঘের দেখা কপালে থাকতে হয়। যে আগে দেখে টিকে যায় সে আর তার কামড়ে মারা যায় অন্যজন। এটাই সুন্দরবনের নিয়ম
গাঁজাভর্তি বিড়িতে আগুন ধরিয়ে ছোট্ট মাছ ধরার নৌকার বৈঠা হাতে নিয়ে হাসে আব্দুল কাদের সরকার- মানুষও তাইলে কামড়ায়। ...কামড়ায়ইতো। সাপে বাঘে কামড়ায় দাঁতে আর মানুষ কামড়ায় হাতে; কত কিসিমের দাঁত যে গজায় মানুষের হাতে...
সুন্দরবনের খাইখাই ভূতুড়ে বিকেলে একটু একটু করে একটা খালের দিকে এগিয়ে যায় আব্দুল কাদের। নিচে নিঃশব্দ কামট। পাড় ঘেঁষে ঘাপটি মারা কুমির। গাছের মগডালে বানর; নিচে বেকুব হরিণ আর নদী মাটি বাতাসে ওৎ পেতে বসে থাকা সুন্দরবনের বাঘ...
স্রোতের উল্টোদিকে ঠেলে আসা একটা ট্রলার দেখে আব্দুল কাদের একমনে মাছ ধরতে থাকে। ট্রলারটা ফরেস্টের। মাছধরার কোনো পাস-পারমিট নাই কাদেরের কাছে। ট্রলারটা কাছে এলে হাত তুলে সালাম দিয়ে কাকুতি মিনতি করে - স্যার গরিব মানুষ। খাওয়ার জন্য দুইটা মাছ ধরি
কয়েকটা ধমক দিয়ে বড়ো দুটো মাছ ট্রলারে তুলে ফরেস্টাররা চলে গেলে আব্দুল কাদের আবারও মাছ ধরতে থাকে। ভটভটির শব্দ না মিলানো পর্যন্ত মাছ ধরে কাদের। তারপর নৌকাটাকে ছোট একটা খালে ঢুকিয়ে কুড়াল হাতে শোলার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে এগিয়ে যায় ভেতরে। ঝড়ে পড়া একটা গাছের নিচ থেকে কাদা সরিয়ে পলিথিনে প্যাক করা রাইফেলটা বের করে আবার নৌকা চালায়। আরেকটা ছোট খালে ঢুকে এক জায়গায় নৌকাটাকে টেনে একটু উপরে তুলে বেঁধে রাখে। একটা পলিথিনের ব্যাগ কোমরে ঝুলিয়ে একহাতে কুড়াল আর গলায় আড়াআড়ি রাইফেলটা ঝুলিয়ে একটা গাছে উঠে বসে। কোপ মেরে কুড়ালটা আটকে রাখে গাছে। পলিব্যাগ থেকে গুলি নিয়ে রাইফেল রেডি করে গামছা দিয়ে বেঁধে রাখে গাছের আরেকটা ডালে। তারপর ব্যাগ থেকে আরেকটা গাঁজাভর্তি বিড়ি বের করে হাতের তালুতে আগুন লুকিয়ে দম দেয় অনেকক্ষণ। ...ভাগ্য ভালো। মামাদের ঘ্রাণশক্তি নাই। নইলে গাঁজার গন্ধেই তারা মউতের ঘ্রাণ পেতো
মারে চক্কর মারে মাথা
ধড়ফড় করে বুক
মউতের ডাক শুনতি পালি
আগাইয়া আসুক
কয়েকটা কুত্তার ডাক দিয়ে রাইফেল হাতে নিয়ে চারপাশে তাকায় আব্দুল কাদের। টাটকা পায়ের ছাপগুলো বলে আশেপাশে আছে মামা। কুত্তার ডাক কানে গেলেই আসবে। তবে যদি তারে মউতে ডাক না দেয় তবে আসলেও লাভ নাই কিছু। একহাত সামনে দিয়ে বাতাসে ভর করে চলে যাবে আবার। অথবা আসবেই না। আব্দুল কাদের দেখেছে বহুবার। আস্ত হরিণ ভেট দিয়েও কাজ হয়নি। হরিণের উপরে মুততেও আসেনি বাঘ
ওরা অবশ্য বলছিল একটা হরিণ মেরে ফেলে রাখতে। কাদের রাজি হয়নি। হরিণের গায়ে গুলি করতে মায়া লাগে তার। নখ নাই দাঁত নাই ছাগলের মতো একটা জানোয়ার; কাশি দিলে জঙ্গল ভাইঙ্গা পালায়; ওইগুলারে গুলি করে কেমনে? তাছাড়া হরিণ মারার জন্য বাড়তি একটা গুলি মানে বাড়তি একবার ফরেস্টারদের কান খাড়া করে দেয়া
হালাদের যত জারিজুরি সব জেলে আর মাঝিদের সাথেই। বাঘ কিংবা চোরাশিকারিদের বালও ছিঁড়তে পারে না। ফি সপ্তা বাঘে দুইটা একটা মানুষ পাড়ে; ওরা রাইফেল দিয়ে গুলি করে এদিক সেদিক। বাঘের উপরে গুলি করার পারমিশন নাই ওদের। কিন্তু এইগুলা সুন্দরবনের বাঘ। বুদ্ধিতে মানুষের সমান। নইলে অতদিনে বাঙাল চাষার ক্ষেতে লাঙ্গল টানতে হতো বাঘের। ওরা ভালো করেই জানে ওইসব ফরেস্টার থেকে সরকারের কাছে তারা বেশি দামি। তাই গুলি করতে দেখলে দুই পা সামনে গিয়ে ঘাড় কাৎ করে তাকায়। আর দূর থেকে গুলির শুনলে উল্টা শব্দের দিকে আসে। মনে করে হরিণ ফেলল কেউ। এইবার দৌড়াদৌড়ি না করেই মুফতে পাওয়া যাবে একটা শিকার...
নিজের নামের সঙ্গে সরকার থাকলেও সরকারের আগামাথা বোঝে না আব্দুল কাদের সরকার। মানুষের বাঘ মারা নিষেধ। কিন্তু বাঘে যে হামেশা মানুষ মারে? সুন্দরবনের এমন কোনো বাঘ আছে যার পেটে যায়নি মানুষের মাংস? অথচ সরকার কিছুই বলে না এখানে। শুধু বাঘ কেন? হরিণ মারাও নিষেধ। কিন্তু হরিণ কি থাকে? হরিণ তো সব হয় বাঘের পেটে না হয় চোরাশিকারির নৌকায় যায়। না খাওয়া মানুষ একটা হরিণ মারলে ফরেস্টের লোকরা ধরে নিয়ে জেলে ঢোকায়
আব্দুল কাদের হাসে। সুন্দরবনের মানুষদের কি ধরা অতটাই সহজ? বনে তাদের এক নাম। লোকালয়ে নাম আরেক। তার নিজেরই বা কয়টা নাম সেও কি ঠিক বলতে পারে? আর শিকারিদের তারা করবেই বা কী? গহিন জঙ্গলে যারা শিকার করতে আসে তাদের কাছে ফরেস্টারদের মাথা বরাবর একটা গুলি ঢুকিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না। সরকার দেখতেও আসবে না ফরেস্টার বাঘের কামড়ে মরল না মরল মানুষের কামড় খেয়ে
চোখ ছোট করে প্রতিটা ঘাসের দিকে তাকায় আব্দুল কাদের। তাজ্জব মানে মামার লুকানোর ক্ষমতা দেখে। অত বড়ো একখান ধড়। ক্যাটকেটে হলুদের মধ্যে কালো। বহু দূর থেকে চোখে পড়ার কথা। কিন্তু মাত্র এক হাঁটু ঘাসের মধ্যে কিংবা ছোট্ট একটা গাছের আড়ালে কেমনে পুরো শরীরটা লুকিয়ে ফেলে মামা; এখনও মাথায় ঢোকে না তার। একটা গোলপাতার ঝোপে এমনভাবে নিজেরে আড়াল করে যে দশ হাত দূর থেকেও মনে হয় গোলপাতার ফাঁকে মরা গোলপাতা ছাড়া ছিল না কিছুই
- আইস। আইস মামা। সামনে আইস আরো
হামাগুড়ি নয়। আস্তে আস্তে হেঁটে এসেই দাঁড়ায়। সাড়ে ছয় থেকে সাত বছর বয়স। বিশাল থেকে ছোটো আর মাঝারি থেকে বড়ো। আব্দুল কাদেরের আবারও হাসি পায়। বাঘরে মানুষ সব সময়ই বড়ো বানিয়ে দেখতে পছন্দ করে। এইজন্য বাঘ মাপে লেঙ্গুড়ে-মাথায়। নাকের ডগা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত মাপ দিয়ে বলে বারো ফুট অত ইঞ্চি বড়ো। আব্দুল কাদেরের মাথায় ঢোকে না লেজ জোড়া দিয়ে বাঘেরে বড়ো বানানোর দরকারটা কী? বাঘতো এমনিতেই বড়ো...
বাঘটার দিকে তাকিয়ে আফসোস করে ওঠে আব্দুল কাদের- মামারে; অত বড়ো শইলডার কী দরকার আছিল তোর। খালি চাইরটা দাঁত- কয়টা নখ আর ছালডা ছাড়া পুরাটাইতো আকাইম্মা তোর...
কথাটা বলেই মনে মনে হাসে কাদের সরকার- দাঁত আর নখ না থাইকলে তো মামারে বাঘই কইত না কেউ। রামছাগল বানাইয়া বাইন্ধা রাখতো গোয়ালে
শিকার দেখতে না পেলে হামাগুড়ি দেয় না বাঘ। কুত্তার ডাক শুনে বাঘটা দাঁড়িয়ে অনুমানের চেষ্টা করছে ডাকটা কোনদিকে। এখন শ্বাসের শব্দও আটকে রাখতে হবে। মামাদের চোখ আর কান বড়ো ভয়ানক। দেখে ফেললেই সুরুৎ করে মিলিয়ে যাবে। কাদের শ্বাস বন্ধ করে রাইফেলের মুখটা বাঘের দিকে আস্তে আস্তে ঘোরায়
শিকারে যে যত বেশি নিঃশব্দ। ভাগ্য তত বেশি পক্ষে তার। এই বিশাল জন্তুটা জলকাদা ভেঙে কত নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে পারে আব্দুল কাদের জানে। শিকার ধরার কালে বাতাসে ভর দিয়ে হাঁটে বাঘ। কথাটা প্রায় বিশ্বাস করে সে। শিকার দেখলেই নিজের ওজনটাকে একটা শামুকের সমান বানিয়ে ফেলে এই বিশাল প্রাণীটা। এত জলকাদা-মরা ডাল- গাছপালা; সবকিছুই মুখ বন্ধ করে সহ্য করে শিকারি বাঘের শরীরের ওজন। আর ভুলেও কোনো গাছের ডাল টুক করে যদি একটু শব্দ করে ওঠে; আব্দুল কাদের নিজের চোখে দেখেছে; রাগে নিজের পা নিজেই কামড়ে ধরেছে বাঘ- শব্দ কেন হলো? তারপর ঝিম মেরে বসে আবার এগিয়ে গেছে শিকারের দিকে
কিন্তু বাঘের ওজন টের পাওয়া যায় যখন সে প্রকাশ্যে দৌড়টা শুরু করে শিকারের দিকে। ওরে ধুপধাপ। পুরা সুন্দরবন কেঁপে ওঠে তার ভারে। কারণ মামায় তখন তার শিকার ছাড়া আর পোছে না কিছুই; ...বাঘে যারে দেখে হাজারেও না রুখে...
কথাটা ছোটবেলায়ই শোনা। হাজার হাজার হরিণ কিংবা মানুষের মাঝখান থেকে বাঘ শুধু একটাকেই দেখে। আর যারে দেখে তার আশেপাশে যত হরিণ আর মানুষই থাকুক না কেন মামায় ওইটারেই ধরে; ঘাড়ের পেছনে কামড় আর পিঠের মধ্যে থাবা। নিজের পুরা ওজনটা ঢেলে দেয় শিকারের পিঠে; কার বাপের সাধ্যি এই কামড় থাবা আর ওজন নিয়া মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে? হাতির সঙ্গে মামার লড়াই দেখেনি কাদের। কিন্তু হরিণ আর মানুষের সাথে দেখেছে। মুহূর্তের মধ্যে কাদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে শিকার। আর সঙ্গে সঙ্গেই মামা একটা থাবা সামনে বাড়িয়ে শিকারের মাথায় ধরে হ্যাঁচকা এক টানে কড়াৎ করে ভেঙে ফেলে ঘাড়। এই এক টানেই মানুষ আর হরিণ যার যা হবার তা হয়ে যায়। আব্দুল কাদের মনে মনে আবারও হাসে। ঘাড় ভেঙে দিয়েও আরো কিছুক্ষণ শিকারকে কামড়ে ধরে থাকে বাঘ। তারপর কামড় ছেড়ে হাত দিয়ে একটা নাড়া দিয়ে দেখে নড়ে কি না। হরিণ নড়ে না। কিন্তু পুরুষ মানুষের দুই পায়ের ফাঁকের অঙ্গটা নড়ে। মামায় মনে করে এইটা বোধহয় কোনো একটা অস্ত্র কিংবা এইখানে এখনও জান আছে; আবার একটা থাবা দিয়া দূরে গিয়া দাঁড়ায়- নড়ে কি না। আর কিছুই নড়ে না। খালি ওইটা নড়ে। এইবার দেয় ঘপ করে ওইটাতে একটা কামড়। এক কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায় মুখের মধ্যে। মানুষ ধরলে ওইটাই খায় প্রথমে। অবশ্য পুরুষ মানুষ। বাঘে খাওয়া মহিলা মানুষ দেখেনি কাদের। মেয়েরা অতদূর বনে আসে না বলেই বাঘে কম খায় মেয়েদের
আরো কয়েক পা এগিয়ে আসে বাঘটা। নিশানার মধ্যেই এখন। কিন্তু এখন মারলে মারতে হবে বুকে। সবাই বলে বুকে মারটাই ভালো। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে বুকে মারলে ছেঁড়াফাঁড়া বুক নিয়েও বাঘ কয়েক মাইল দৌড় লাগাতে পারে। বাঘের পেছনে অতদূর দৌড়ানো সম্ভব না বলে অনেক শিকারিই মরা বাঘ খুঁজেও পায় না শেষ পর্যন্ত
বাঘের কাছ থেকেই কাদেরের বাঘ মারা শিক্ষা। ঘাড় ভেঙে শিকার মারে বাঘ। শিকারকে জায়গায় ফেলে দেবার জন্য ঘাড়ের হাড্ডিটাই একমাত্র জায়গা। কিন্তু ওইখানে টার্গেট করা অনেক মুনশিয়ানার কাজ। ঠিকঠিক কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝখানে চালিয়ে দিতে হয় গুলিটা। এক গুলিতে কাঁধের হাড্ডি ভেঙে ঢুকে চুরমার করে দেয় ঘাড়ের হাড্ডিটাও। কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে পুরাটাই উল্টে যেতে পারে। বড়োজোর বাঘের একটা পা ল্যাংড়া হয়। আর বাঘ ল্যাংড়া হলেও বাঘ। যেমন দৌড়ে- তেমনি থাবায়
বাঘটা আরেকটু সামনে এসে ডানে বামে তাকায়। আব্দুল কাদের টার্গেট ঠিক করে- বেয়াদবি মাপ কইরো মামা। কোনো শত্রুতা নাই। পেটের দায়ে করি। ...বিসমিল্লা...
-ঘুড়ুস
সেকেন্ডের মধ্যেই শোল্ডার ব্লেড ভেঙে গুলিটা গিয়ে লাগে বাঘের ঘাড়ের হাড্ডিতে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ধপাস। কাটাকুটা কাদা পানিতে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে বিশাল একটা বাঘ। আব্দুল কাদের নামে না। বাঘের দিকে তাকিয়ে এবার আওয়াজ করে বলে- মাপ কইরো মামা। কোনো শত্রুতা নাই...
রাইফেলটা গাছের ডালে গামছায় আটকে এবার প্রকাশ্যে একটা গাঁজা ধরায়। এখনই নামা ঠিক না। আশেপাশে আরো থাকতে পারে। গাঁজা টানতে টানতে আশপাশ তাকায়। অবশ্য মামারা একা একাই থাকে বেশিরভাগ সময়। মাঝে মাখে শুধু বাঘার সাথে বাঘিনি ঘোরে। ওইটা একটা বিপদ। ওইক্ষেত্রে গুলিটা করতে হয় বাঘিনিকে আগে। বাঘিনি পড়ে গেলে বাঘা দৌড়ায়। কিন্তু বাঘিনির সামনে যদি বাঘার কিছু হয় তবে দুনিয়াতে কিয়ামত ঘটিয়ে ছাড়ে বাঘিনি মামা...
গাঁজা শেষ করে কুড়ালটা পেড়ে নিয়ে গাছের ডালে বাড়ি দিয়ে হই হই করে আওয়াজ দিতে দিতে নেমে গিয়ে দাঁড়ায় বাঘটার কাছে। কুড়াল হাতে নিয়ে চারপাশ তাকায়। সামনা সামনি রাইফেল কোনো কাজের না। থাবার মধ্যে কুড়ালের কোপ ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নাই
আওয়াজ করতে করতে কোমরের পলিব্যাগ থেকে প্লায়ার্স বের করে পটাপট সামনের আঙ্গুলগুলোর গিঁটে চাপ দিয়ে আলগা করে চাকু দিয়ে চামড়া কেটে নখগুলো ব্যাগে ভরতে থাকে। একেকটা নখ ব্যাগে ঢোকায় আর আওয়াজ দিয়ে চারপাশ তাকায়। পেছনের নখগুলোও কাটা শেষ করে ছেনি বের করে গিয়ে দাঁড়ায় মুখের কাছে। প্লায়ার্সের বাড়িতে জায়গামতো ছেনি বসিয়ে চাড় মেরে বের করে আনে চার চারটা দাঁত। শেষ দাঁতটা হাতে নিয়ে তাকায় বাঘটার দিকে- তুমি এখন একটা ভেড়ার চাইতে বেশি কিছু না মামা। কাইল কসাইরা আসবো তোমার চামড়া ছিলতে...
নৌকায় উঠে আব্দুল কাদের পলিথিনের দাঁত আর নখগুলোতে হাত বোলায়। ধরে ধরে ধারগুলো দেখে। শুকিয়ে এগুলোর গোড়া থেকে মাংস আলাদা করা হবে। তারপর নখের গর্তে শিশা ঢুকিয়ে আর দাঁতের গোড়া সমান করে কেটে স্বর্ণ দিয়ে বাঁধিয়ে বানানো হবে লকেট
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে আব্দুল কাদেরের। ছেলে জন্মানোর পরে বৌ চেয়েছিল ছেলের গলায় একটা বাঘের দাঁত ঝোলাতে। সোনা না হোক। রুপা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলেই হবে। একবার একটা দাঁত লুকিয়ে সরিয়েও ফেলেছিল আব্দুল কাদের। কিন্তু পরে আবার বিক্রি করে দিতে হয়েছে অভাবের টানে। ...থাক। কী দরকার। জাইল্লার পোলার গলায় বাঘের দাঁত দেখলে সুন্দরবনের শুয়োরও হাসবো দাঁত দেখাইয়া...
বড়ো নদী পার হয়ে আরেকটা খালের ভেতরে ঢুকে পড়ে আব্দুল কাদেরের নৌকা। বনের মধ্যে দাঁড়ানো ট্রলারটায় উঠে দাঁত নখ দিয়ে চামড়ার ঠিকানা বলে তার ছুটি...
টাকাগুলো কোমরে গুঁজে কাদের বড়ো নদীতে আসতেই ভটটির আওয়াজ শুনতে পায়। ফরেস্টের ট্রলারটা ফিরে আসছে। কাছাকাছি এসে একজন চিৎকার করে- তুমি কি কোনো গুলির আওয়াজ শুনছ বিকালে?
- আপনাদের বন্দুকের একটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনি নাই
- আমরা তো কেউ আজ কোনো ফায়ার করিনি
- তাইলে আল্লা মালুম স্যার। আপনারা চইলে যাবার পরে একটা আওয়াজ শুনলাম। ভাবলাম আপনেরাই করছেন
ট্রলার চলে যাবার পরে পানিতে একদলা থুতু ফেলে আব্দুল কাদের- বালস্য বাল। বাড়ার তিন তিনটা রাইফেল নিয়া লেংটি পরা জাইল্লারে আইসা জিগায় গুলি করছে কেঠায়? নিজেরা গিয়া দেখতে পারে না? এরা বাঁচাইব বাঘ... আর বাঁচিয়েই বা কী লাভ? একটা বাঘ পাড়তে পারলে তার মতো মানুষের একমাস সংসার চলে। সে একা মারে বলে রাইফেলের ভাড়া দিয়েও যা থাকে তাতে অনেক টাকাই হয়। অবশ্য সে বুঝে পায় না। গাছে উঠে যেখানে একটা গুলি করাই কাজ সেখানে চামড়া ছাড়ানো ছাড়া একজনের বেশি লোকের দরকারটা কী?
সে নিজে কোনোদিনও চামড়া ছিলে না। চামড়া ছিলার সময় থাকেও না। চামড়া ছাড়া অতবড়ো শরীরটা দেখলে কষ্ট হয় তার। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঘ যদি নিজের নখ দাঁত আর চামড়া খুলে পোঁটলা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখতো তাহলে তাকে আর মরতে হতো না। দাঁত নখ চামড়া নিয়ে তার অত বড়ো শরীরটা বনেই ফেলে যায় সবাই। কেউ খায় না। ওখানেই পচে...
কোন কোন দেশের মানুষ নাকি সব কিছুই খায়? তাইলে বাঙালি খেলে ক্ষতি কী? ...যা থাকে কপালে আজ একটা কিছু করেই দেখবে সে
গাঁজা ভর্তি শেষ বিড়িটা ধরিয়ে ফেলে আসা প্রায় অন্ধকার বনের দিকে নৌকা ঘোরায় আব্দুল কাদের। হয়তো এর পর থেকে গুলি করার আগে সে বলবে পারবে- মাপ কইরো মামা কোনো শত্রুতা নাই। মাংস খাওয়ার লাইগা মারি পেটের ক্ষিদায়...
২০০৯.০৮.২১ শুক্রবার
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:১৩