সময়টা ২০০৫ এর শেষের দিক । স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে কলেজের রেলিং ধরেছি । দেশে তখন মোবাইল ফোনের বিপ্লব হবো হবো করছে । কিছু বন্ধুদের হাতে বাহারি মোবাইল । আড্ডার মাঝে দুয়েক জনের বেজে ওঠা রিংটোন মনের মধ্যে বারবার রিমাইন্ডার দেয়, এই মহার্ঘ্য বস্তুটি আমার না হলেই নয় । বাসায় এসে ড্রয়ার খুলে কানাকুনি চেক করে, মাটির ব্যাংক ভেঙে, মায়ের কাছ থেকে জমানো টাকা উদ্ধার করে, দাদুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেখি ৩০০০ এর বেশি হয় না । কিন্তু যে সেট পছন্দ করেছি তার দাম ১০৫০০ (Siemens M65) । বাবার কাছ থেকে চাইতেও ভয় লাগে । সব সময় মা কে বলি বাবাকে বলতে । আবার বাবা সামনে আসলে চুপ হয়ে যাই । যা হোক, পরের দিন রাত্রে খেতে বসেছি । যথারীতি বাবাও বসেছে ।
কিছুক্ষণ পর বাবার প্রশ্ন,
-- কিরে মোবাইল কিনবি বলে নাকি তোর মাকে জ্বালাচ্ছিস ?
-- ............. (আমি চুপচাপ)
-- তা কোনো মডেল পছন্দ আছে ।
-- Siemens M65 (আমি আস্তে করে বলি).
-- দাম কত ?
-- ১০৫০০ টাকা.
-- তোর বাবার মোবাইলের দাম কত জানিস ?
-- ............ (আমি চুপচাপ)
-- ৩০০০ টাকা ।
-- ............ (আমি চুপচাপ)
-- আমার স্কুলের একমাসের বেতন কত জানিস ??
-- ............ (আমি চুপচাপ)
-- ৯৬৫৩ টাকা ।
এই কথা বলার পর আর কিছু বলার থাকে না । মুখ ভার করে চোখে জল কোনোমতে আটকিয়ে রাখলাম । নিজেকে মধ্যবিত্ত করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য হাজারবার বিধাতাকে দোষারোপ করলাম । পরের দিন বিকালে কলেজ থেকে বাসায় ফিরে দেখি মায়ের মুখে টিপটিপ হাসি । যেন কিছু লুকাতে চাচ্ছে এমন । রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের উপর মোবাইলের প্যাকেট । হ্যাঁ, অবশ্যই Siemens M65. চিৎকার দিয়ে বলি, মা এইটা কি আমার মোবাইল ।
এই হচ্ছে আমার বাবা । কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেদের ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করেন না। আমার বাবা সেই গোত্রের মানুষ । তিন সন্তানকে মানুষ করতে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি । চাপের ভারে হয়ত কখনো কখনো ভেঙে পড়েছেন কিন্তু সে চাপ পড়তে দেননি আমাদের তিন ভাই বোন দের কারো মাঝেই । শিখিয়েছেন মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে, শত্রুকে ভালবাসতে, বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলতে আর প্রচুর বই পড়তে ।
শুভ বাবা দিবস, বাবা ।