আমাদের মতো দুর্নীতিবাজ দেশে দুর্নীতি দিয়ে যে কোনো সরকারের সমালোচনা করাটা নিতান্তই অর্থহীন। একটা বিষয় মেনে নিতে হবে যে, আমরা জাতিগতভাবেই দুই নাম্বার। কেও দুই নাম্বারির সুযোগ পায় না, তাই করে না। এরাই আবার দুর্নীতিবাজদের প্রধান সমালোচক।
অনেকে এই বলে আফসোস করেন যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দুই নাম্বার।এটাও ভুল কথা। বলতে হবে আমাদের পুরো সমাজটাই দুই নম্বর। আর রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সমাজেরই অংশ। আমাদেরই বাপ-চাচা খালা, আত্মীয় বা প্রতিবেশীরাই গ্রামে চেয়ারম্যান মেম্বর হন বা সাংসদ হন। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ দুই নম্বর তাই নেতা দুই নম্বর। আমাদের সোশ্যাল মেকানিজমটাই এরকম। তারপরও কর্পোরেট দুর্নীতির চেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি তূলনামূলক কম খারাপ। গ্রামের কোনো চেয়ারম্যান কোনো প্রকল্প থেকে এক লাখ টাকা মেরে দিলে তার ৮০ হাজার টাকাই বিভিন্ন স্তরে বিলিবন্টন করে দিতে হয়। আর গ্রামীণফোন যখন কর ফাঁকি বা কোনো দুই নাম্বারির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা মেরে দেয় তাঁর একটা টাকাও জনগণ পায় না। এমনকি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও পান না। যাইহোক, হিসাবটা সোজা। আমাদের মেনে নিতে হবে আমাদের সমাজটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এবং সমাজ ঠিক হলে আলটিমেটলি নেতাও ঠিক হবে। এজন্য হয়তো কয়েকটি প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে।
‘পরিবেশ দূষণের দায়ে অমুক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা’ এ ধরনের খবর আমরা পত্রিকায় প্রায়ই দেখতে পাই। শিল্প কারাখানাগুলোতে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায়ই অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেন। ইটিপি পরিচালনা করার খরচ বাঁচাতে অনেকে ইটিপি থাকার পরও তা চালু রাখে না। ব্যক্তিস্বার্থের জন্য তারা পরিবেশ দূষণ করে। অর্থাৎ জনগণের একটা বড় অংশেরই নীতিবোধ নাই বললেই চলে। রাষ্ট্রের পক্ষে কি সম্ভব প্রায় সব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর সার্বক্ষণিক পুলিশ রাখা? আমাদের সমাজে যারা দুর্নীতি করার সুযোগ পায় না তারাও মানসিকভাবে দুই নম্বর। আমাদের সমাজের বয়স্ক বাবা মায়েরা তাঁদের ছেলে নামাজ পড়লে খুশি হন। কিন্তু ছেলে কিভাবে টাকা আয় করছে সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। অনেক বাবা মা জানে ছেলে দুর্নীতি করে টাকা আয় করছে, কিন্তু তারা জেনেও না জানার ভান করে বসে থাকে। ছেলে আমার অমুক পীরের মুরিদ এই কথা ভেবেই তারা গর্বিত। যাইহোক , আমাদের সমাজটাই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই রাজনৈতিক দলগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত, তথা নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত। ভালো মানুষ যারা আছেন তারা ব্যতিক্রম উদাহরণমাত্র। সামরিক শাসনের আমলগুলোও ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দুর্নীতি দূর হবে সেদিনই যেদিন আমাদের সমাজ পরিবর্তন হবে। নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কাজেই দুর্নীতি যেহেতু সামাজিক সমস্যা সেহেতু আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে দুর্নীতি দিয়ে বিচার না করে আসুন তাঁদের কাজ দিয়ে বিচার করি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মন্দের ভালো কোনো দল বাছাই করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। কারন আমাদের সামনে এখন প্রধানত দুটি দল। এক হলো জামায়াতের মহব্বতে গদগদ বিএনপি এবং দুই হলো আওয়ামী-বাম ও অন্যান্য । আর একটি অপশন হলো সেনা শাসন। যেহেতু অপশনগুলোর কোনোটিই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বাছাই করার উপায় নেই এবং আমাদের সামনে আর কোনো অপশনও খোলা নেই, সেহেতু আমাদের মন্দের ভালো ঠিক করতে হবে।
আমি একজন সাধারন ভোটার এবং আমি তিনটি শাসনামাল দেখেছি ভালোভাবে। ২০০১ এ আমি বিএনপিকে ভোট দিয়েছি। গত নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছি। এবার আমি কাকে ভোট দিব সেটা নিয়ে চিন্তা করেই আমার এই পোস্ট।
আমি মনে করি, আমরা যদি এবার আওয়ামী লীগের দুর্নীতির জন্য বিএনপি-জামায়াতকে বাছাই করি তবে ভুল হবে। কারন অনেক। প্রথমত বিএনপি-জামায়াত আসলে দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং বিএনপি এখন না-খাওয়া দল।আর আওয়ামী লীগের পেট ভরা। বিএনপির আমলে দুর্নীতি ছিল সমন্বিত। যে কারনে প্রকাশ হয়েছে কম। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে ৭০ লাখ টাকা নিয়েও ধরা খেয়েছেন সুরঞ্জিত। কাজেই বলা যায় আওয়ামী লীগের দুর্নীতি সমন্বিত নয়। তাই ধরাও পড়েছে বেশি। বিএনপির আমলে ভারত থেকে আনা এক লাখ টাকার সিএনজি বিক্রি হয়েছে চার লাখ টাকায়। এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সমন্বিত হওয়ায় তা প্রকাশ পায়নি।
আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো জামায়াত। বিএনপি আসলে জামায়াতের উত্থান ঘটবে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে। দেশে জঙ্গিবাদ চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আমরা গত বার দেখেছি, বিএনপির সঙ্গে সামান্য ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও জামায়াত কি পরিমাণ সহিংস হয়ে ওঠেছিল। তখন জেএমবিসহ বিভিন্ন ইসলাম নামধারী জঙ্গি গোষ্ঠী চেতে উঠেছিল। আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো জামায়াতের পক্ষে। কারন তারা চায় আমাদের মতো দেশে আফগানিস্তানের মতো উগ্রবাদ চালু থাকুক । এতে তারা এ দেশের ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারবে। এবং ভবিষ্যতে মনে চাইলে আফগানিস্তানের মতো দখলও করে নিতে পারবে। লাদেন ও তালেবান যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি।
বিএনপি-জামায়াতের আমলে উন্নয়মূলক কাজ কতটুকু হয়েছিল সেটাও আমাদের দেখতে হবে। আমার মনে হয় না উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল। দুই দলেরই দুর্নীতির বিষয়টি অগ্রাহ্য করে তাদের ভালো কাজগুলোকে দেখতে হবে। তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বর্তমান সরকারের আমলে কৃষিখাত খুবই ভালো। কৃষিমন্ত্রী তার খাতে অত্যন্ত যোগ্য ও সৎ। যোগ্যতা অনেক বেশি প্রয়োজন।দুর্নীতিবাজ নেতার যোগ্যতা থাকলেও তাঁর দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট খাতের উন্নতি হয়। বাংলাদেশে আমার মনে হয় এই একটা মন্ত্রীই আছেন যিনি তাঁর খাত সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দক্ষ। বর্তমানে কৃষি উৎপাদানও ভালো। উৎপাদন ভালো হওয়ায় অন্তত জরুরি কিছু খাদ্যপণ্যের দাম তূলনামূলক সহনীয়। গরিবের জন্যই এটাই দরকার। বাইরে বের হওয়ার পর বিড়ি সিগারেট ও বাস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ এখন অনেক বেশি হয়। সেই তুলনায় কিন্তু খাওয়ার খরচ কম।
অনেকে কৃষক দাম পায় নি, বলে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন । তবে সেক্ষেত্রে আমি বলবো, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কৃষক প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পায়নি। কারন উৎপাদন বেশি হলে দাম কমবে সেটাই স্বাভাবিক।আর সরকার তখন চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি নানা কারনে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত না নেওয়াটা নাচতে নেমে ঘোমটা পড়ার শামিল।
গ্রামে গিয়ে এক কৃষক চাচার সঙ্গে আলাপ হলো, ধানের দাম কম পাওয়ায় তিনি আক্ষেপ করলেন।কিছুক্ষণ অন্য প্রসঙ্গে গল্প করার পর আমি তাকে বললাম, চাচা পাঁচ বিঘা জমি থাকলে মনে হয় তার আর কিছু লাগে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তা যা বলেছো! পাঁচ বিঘা জমি থাকলে আর কি লাগে??
পরে যেটা বুঝলাম, তিনি আগের বছরের দামের প্রত্যাশা করে ধান বেঁচতে গিয়েছিলেন এবং সেই দাম পাননি। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই কৃষক প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পায়নি। উৎপাদান বেশি হলে সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাইহোক, মতিয়া চৌধুরি তাঁর খাত সম্পর্কে অত্যন্ত সিরিয়াস। তিনি ইউরিয়া সারের উৎপাদানের জন্য চট্টগ্রামে অন্য কারখানাগুলোতে গ্যাস বন্ধ রাখতে সরকারকে বাধ্য করেছিলেন। এবং শহরে লোডশেডিং বাড়িয়ে কৃষিজমিতে বিদ্যুৎ দিয়েছেন। যাইহোক কৃষিটা নিয়ে অনেক প্যাচাল পারলাম কারন এই খাতটি বিশাল একটা ব্যাপার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুই নম্বর শিক্ষা খাতটাও তূলনামূলক ভালো। এখন খারাপ ফলাফল হয় না। এর মানে শিক্ষার মানের খুব উন্নয়ন হয়েছে, তা নয়। কিন্তু একজনকে খারাপ ফল দিয়ে তাকে শিক্ষাজীবন থেকে বের করে দেওয়াটাও মোটেই ভালো ছিল না। অনেকে দেখেছি কাজ জানে কিন্তু সার্টিফিকেটের অভাবে কাজ পায় না। বিদেশে কাজে যেতেও সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। আগের ফেল করানোর সিস্টেমটা ছিলো খুবই খারাপ। পিয়নের চাকরি পেতেও এখন ইন্টার পাশ লাগে। অথচ লিখতে পড়তে পারলেই পিয়নের চাকরি করা যায়। আগে শুধু অংকে ফেল করার কারনে অনেককে বছরের পর বছর পরীক্ষা দিতে হতো। সেটা অত্যন্ত অমানবিক এবং বিশ্বের কোনো দেশেই এ সিস্টেম নাই।
বিদ্যুতের সমস্যাও কিছুটা প্রাথমিকভাবে সরকার সামাল দিয়েছে। এনার্জি বাল্ব চালু করে দিতে পেরেছে। এটা বেশ বড় অর্জন। যদিও অনেকের অভিযোগ সিএফএল বাল্বে দুর্নীতি হয়েছে। ফ্রি দেওয়া বাল্বগুলো খারাপ ছিল। সেক্ষেত্রে আমি আগেই বলেছি, আমাদের দুর্নীতিকে বাদ বিচার করতে হবে।
যাইহোক মোট কথা, যেভাবেই হোক এনার্জি বাল্ব চালু হয়ে গেছে। মানুষ টাকা দিয়ে হলেও এই বাল্ব ব্যবহার করছে। আর বিদ্যুতের স্থায়ী সমাধানে অনেক সময় প্রয়োজন হয়। সরকারকে সময় দিতে হবে। রুপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে স্থায়ী সমাধানে একধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
জেলা শহরগুলোতে বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ বেশ ভালো। বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মালটা একেবারে খারাপ নন। তার যোগ্যতা আছে।
সুরঞ্জিত রেলের দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রেনের সময়সূচি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি দুর্নীতির অভিযোগে পড়ে গেলেন। দুর্নীতি বাদ দিয়ে আমি যদি যোগ্যতা দেখি, তাহলে অবশ্যই বলবো সুরঞ্জিত মালটাও খারাপ ছিলেন না।
মন্দের ভালো হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বেছে নেওয়া উত্তম হবে তার আরেকটি কারন হলো , আমাদের দেশে একটি সরকার সময় পায় মাত্র চার বছর। পাঁচ বছরের শেষ এক বছর থাকে আন্দোলন সংগ্রামের বছর। ফলে চার বছরে কোনো বড় প্রকল্প দাড় করানো সম্ভব নয়। মূলত চার বছর পর পর ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ার কারনে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে।
অনেকে বলে থাকেন আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করছে। কিন্তু আওয়ামী কেন এ চেতনা বিক্রি করছে?? জামায়াত আওয়ামী লীগকে এ চেতনা বিক্রি করতে সাহায্য করছে। জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় সঠিক ভূমিকা পালন করেছে বলে দাবি করে এখনো। আমাদের দেশ যেহেতু স্বাধীন হয়েছে সেহেতু তাঁদের রাজনীতি করার কোনো অধিকারই নেই। জামায়াত যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী সেহেতু আওয়ামী লীগও সুযোগ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করার। আমাদের দেশের সব দলই যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী থাকতো তাহলে কোনো একটি দল এ চেতনা বিক্রি করার সুযোগ পেত না।
আমি আগামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার পক্ষপাতী এর সবচেয়ে বড় কারন:
আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসলে বিএনপি-জামায়াত অনেকটা পঙ্গু হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সরকারের বিকল্প ভালো দলের উদ্ভব ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমাদের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমি একজন সাধারন ভোটার । যারা এ পোস্টটি পাঠ করেছেন তারা যদি মনে করেন বিএনপিকে ভোট দেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে , তাহলে সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝান। আসুন আমরা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধভক্ত ব্যক্তিদের আমি মন্তব্য না দেওয়ার আহবান জানচ্ছি।