বুয়েটের প্রথম ভিসি ডঃ এমএ রশিদ।
বুয়েটের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ছিলেন ডঃ এম এ রশীদ। ১৯৬২ সালের বুয়েট (তৎকালীন ইপিইউয়েট) প্রতিষ্ঠার সময় তিনি কতগুলো নীতিমালা তৈরি করেন, তার অন্যতম হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা (কিভাবে নেয়া হবে এবং কিভাবে খাতা দেখা হবে), শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোনরকম কোটা না থাকা (যার ফলে অনেক শিক্ষকের ছেলেমেয়েদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল পড়তে হয়)। বুয়েটের শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল এই নীতিমালায়।
বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র ভর্তি করা হয় কিনা তা এখনও জানা যায়নি। তবে বুয়েটে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতির দলাদলি ঢুকেছে ভিসি ডঃ নজরুল ইসলামের হাত ধরে। ১০ই আগস্ট,২০১০ সালে ভিসির দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিতর্কিত নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। বুয়েটে কোন প্রো-ভিসির পদ না থাকা সত্ত্বেও, কেবল রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে তিনি একজনকে প্রো ভিসি পদে নিয়োগ দেন, এবং শুরু হয় বুয়েটের সর্বস্তরে রাজনীতি। ভিসির দলের নাম হয় বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, অনেক শিক্ষক এতে যোগদান করেন। যারা যোগদান করেন না, তারা চিহ্নিত হন "জামাতি ইসলামী" বলে।
অবশ্য এমন না যে, বুয়েটের শিক্ষকরা কখনো রাজনীতি করতেন না। করতেন, কিন্তু ডঃ রশিদের তৈরি করা নীতিমালা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে তারা নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে যেতেন না। ডঃ মিজানুল হক ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন করার সিভিলের অধ্যাপক পদ থেকে ইস্তফা দেন। আবার ডঃ এনামুল হক, যিনি একইসাথে বুয়েটের অধ্যাপক এবং নাট্যাভিনেতা ছিলেন, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। বুয়েটের শিক্ষকদের রাজনীতি করাটা কি ধরনের ছিল, একটা ঘটনা বলি। ২০০৫ সালের ২৭ শে জানুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ্ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। এর একদিন, বা দুদিন পর ছিল বুয়েটে সমাবর্তন; খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হয়ে আসার কথা। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ডঃ এনামুল হক এবং অন্যান্য আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা জানান, খালেদা জিয়া সমাবর্তনে আসলে তারা তাতে যোগ দেবেন না বলে। কিন্তু পরে টিভিতে দেখলাম, খালেদা জিয়া বক্তৃতা দিচ্ছেন, বক্তৃতার মাঝে অন্যান্যদের মত ডঃ এনামুল হকও হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছেন। এটা কেন করলেন? শিক্ষকদের মধ্যে কোন দলাদলি থাকবে না, বুয়েটের এই ঐতিহ্য রক্ষা জন্য!! সে সময় শিক্ষকেরা বুয়েটের মর্যাদা রক্ষায় নিজেদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে যেতেন।
তবে ছাত্র রাজনীতি সব সময় ছিল, যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের ছাত্র সংগঠন থাকতো ক্ষমতায়। কিন্তু সে সময় রাজনীতি করা ছাত্ররা তেমন ক্ষমতাশালী বা সুবিধাভোগী ছিল না। শিক্ষকরাও কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য এদেরকে ব্যবহার করতেন না। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন টেন্ডারের টাকা থেকে কিছু অর্থ উপার্জন। মারামারি কামড়াকামড়ি যা করত তা নিজেদের মধ্যেই। ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েট ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন বিএনপি জামাত জোটের শাসনামলে ছাত্রদলের বুয়েট শাখার ছাত্রদল ক্যাডার মুকিত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল শাখা ছাত্রদল ক্যাডার টগরের মধ্যকার সংঘর্ষে পরে নিহত হন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার সনি। এরপর কিছুদিন বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকে।
কিন্তু বুয়েটের বর্তমানের এই ছাত্ররাজনীতি, যেখানে ছাত্রলীগ একক সাম্রাজ্য কায়েম করেছে হিংস্রতা, অন্যায়, অত্যাচার এবং নিপীড়নের মাধ্যমে, তার শুরু কবে হয় জানি না। মনে আছে দু-তিন বছর আগে একজন বলছিল বুয়েটের ছাত্রলীগের ভিপির খুব মন খারাপ, কারণ তার চাইতে তিতুমীর কলেজের ছাত্রলীগের ভিপির উপার্জন বেশি। ঘটনা হচ্ছে, নিউমার্কেট থানার অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, এবং বুয়েট। তাই টাকা যা আসে সব তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়, অথচ তিতুমীর কলেজের ভিপি তার এলাকার সমস্ত টাকা একাই পায়। তাই বুয়েটের ছাত্রলীগের ভিপির মন খারাপ! তার সঞ্চয় মাত্র ১০০ কোটি টাকা!!
২০/২৫ বছরের একটি ছেলের হাতে কোটি কোটি টাকা, আছে প্রচুর ক্ষমতা। সেই ছেলে তখন আর সুবোধ বালক থাকতে পারেনা অন্যের উপর অত্যাচার করে সে ক্ষমতা প্রদর্শন করবেই। ছাত্রলীগের ছেলেদের ক্ষমতার নমুনা আমাকেও দেখতে হয়েছে। একদিন আমার ড্রাইভার বুয়েট থেকে ফোন করে বললো, একটা ছেলে এসে হেলমেট দিয়ে বাড়ি মেরে আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙে দিয়েছে। তখন সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "আপনি এটা ভাঙলেন কেন?" উত্তর না দিয়ে ছেলেটা তাকে মারা শুরু করে, এবং একটু পরে একদল ছেলে হকিস্টিক নিয়ে আসে গাড়ি এবং ড্রাইভার কে মারবে বলে। সে সময় কর্তব্যরত সিকিউরিটি গার্ড তাদের নিরস্ত করে। আমি দেখতে গেলাম, সিকিউরিটি গার্ডরা জানাল যে ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করার সময় ছাত্রলীগের নেতার মোটরসাইকেল নিয়ে পেছনে এসে পড়ে, ড্রাইভারের দোষ ছিল না, মটরসাইকেলেরও কোনো ক্ষতি হয়নি, তবু উইন্ডশিল্ড ভাঙচুর করেছে।
আমি ডি এস ডব্লিউর সাথে দেখা করতে গেলাম। নালিশ নয়, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, অকারনে আমার গাড়িটা কেন ছাত্রলীগ নেতা এভাবে ভেঙে দিল! উনি অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থাকলেন। তারপর বললেন, "শক্তি প্রদর্শন করার জন্য।"
এখন বুয়েটে ছাত্রলীগের শক্তি প্রদর্শনের যেসব গল্প শুনছি তাকে এক কথায় বলে চলে "নারকীয়"!! একে একে যেসব কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে জানা গেছে অনেক ছেলেকেই তারা শিবির সন্দেহে মারধোর করত, প্রচন্ড মার; যেমনভাবে আবরারকে মারতে মারতে থেঁতলে ফেলেছিল!! একাজ করতে তাদের উৎসাহ যোগাত বুয়েটেরই কিছু প্রাক্তন ছাত্র!! এমন মার খেয়ে অনেকেই আধমরা হয়ে গেছে, অনেক যন্ত্রনা হয়ে বেঁচে থেকেছে; শুধু আবরারই একেবারে মরে গিয়ে বুয়েটের ছাত্রলীগকে কি যে বিপদে ফেলে দিল!
অবশ্য বিপদ হয়তো তেমন বেশি নয়। অভিযুক্ত ছাত্রলীগের উকিল যেমন বলছেন, আবরারের গায়ে যেসব দাগ দেখা যাচ্ছে তা চর্মরোগ। এটা যদি প্রমাণ করতে পারেন, তবে ছাত্রলীগের ছেলেরা সসম্মানে বুয়েটে ফিরে আসবে। আর যদি খুনের অভিযোগ প্রমাণ হয়েই যায়, তবে হয়ত সোনার ছেলেদের জামিন নিয়ে কয় বছরের জন্য বিদেশ যাওয়া লাগবে। তা সেটা আর এমন মন্দ কি!!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ১০:৪০