''ভালোবাসার মূল্য কত
আমি কিছু জানিনা
এ জীবন তুল্য কি তার
আমি সে তো বুঝি না'' ...... বাংলা চলচ্চিত্র ''এপার ওপার '' ছবির এই গানটির কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভাসে হাসিমুখে কমলা বাগানে হেটে যাওয়া এক তরুনের ছবি যে গানে গানে তাঁর প্রিয় মানুষটাকে প্রেম নিবেদন করছে । সেই তরুণটিই হলো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি আজকের সোহেল রানা ।
আমরা যারা সিনেমা হলে বাংলা ছবি দেখার পাগল ছিলাম তাদের কাছে 'মাসুদ পারভেজ' ও 'সোহেল রানা' নাম দুটি খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় । এই নাম দুটি একটি মানুষেরই যাকে সবাই অভিনেতা সোহেল রানা নামে চিনেন । স্বাধীনতার পর বাংলা চলচ্চিত্র যে কজন তারার আলোয় আলোকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে অন্যতম এক নক্ষত্রের নাম 'মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা' । প্রযোজক,পরিচালক ও অভিনেতা তিন ক্ষেত্রেই সফল একজন এই সোহেল রানা । বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ''পারভেজ ফিল্মস'' এর কর্ণধার এই সোহেল রানা ।
মাসুদ পারভেজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকাতে। তাঁর জন্ম ঢাকাতে হলেও পৈতৃক বাসস্থান বরিশাল জেলায়। তাঁর স্ত্রী ডা. জিনাত পারভেজ এবং একমাত্র সন্তান পুত্র মাশরুর পারভেজ জীবরান। প্রযোজক কামাল পারভেজ ও নায়ক রুবেল তার ছোট ভাই। সোহেল রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। পরে এলএলবি করেন
১৯৬১ সালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন মাসুদ পারভেজ। তখন তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের সভাপতি ছিলেন। ওই সময় দুটো রাজনৈতিক দল ছিল একটি ছাত্র ইউনিয়ন অপরটি ছাত্রলীগ। ১৯৬৫-তে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বৃহত্তর ময়মনসিংহের। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন বিষয়ে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন ।১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করেন। দেশ স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এলেন তিনি। প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'ওরা ১১ জন' ছবি দিয়ে। এই ছবির নায়ক ছিলেন খসরু। তার আসল নাম কামরুল আলম খান। তিনিও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সোহেল রানার নিকটতম বন্ধু ছিলেন খসরু। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে সোহেল রানা, তার বন্ধুরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন_ কী করবেন? এর মধ্যেই মাথায় এলো চলচ্চিত্রের কথা। তারা ভাবলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই তৈরি করা হবে চলচ্চিত্র। সেই ভাবনা থেকেই চলচ্চিত্রে নাম লেখালেন সোহেল রানা। শুরুটা ঠিকই ছিল তার। মাসুদ রানা নামেই প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি। কিন্তু পরে হয়ে গেলেন নায়ক। মজার ব্যাপার হলো 'মাসুদ রানা' ছবির জন্য প্রধান চরিত্রের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। চরিত্র নির্বাচনের জন্য এসএম শফি, সুমিতা দেবী, মাসুদ পারভেজ আর আহমেদ জামান চৌধুরীকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। সারাদেশ থেকে অনেকেই ছবি পাঠালেন মাসুদ রানা চরিত্রটির জন্য। কিন্তু ঘটল মজার ঘটনা। এসএম শফি, সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরী হঠাৎ একদিন মাসুদ পারভেজকে বললেন, 'তুমিই হবে মাসুদ রানা।' আহমেদ জামান চৌধুরী তখনই নায়ক হিসেবে তার নাম ঠিক করলেন সোহেল রানা।এই ছবিটি মুক্তির মাধ্যমে দর্শকরা তাঁকে পর্দায় দেখতে পান ১৯৭৪ সালে। । তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি হচ্ছে ‘এপার ওপার’ এবং এই ছবির মাধ্যমেই তিনি প্রথম নায়ক ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এপার ওপার’-এ তার নায়িকা ছিলেন সোমা মুখার্জি। ‘’এপার ওপার’’ ছবি সম্পর্কে ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ‘’ এপার ওপার ছবিতে অভিনয় করার জন্য দুই তিনজন নায়িকা সিডিউল দিতে পারল না। ছবিতে মারামারির দৃশ্য থাকবে, সম্ভবত এজন্য ববিতা ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হলেন না। সুচরিতাকে ঠিক করা হলো। এদিকে শুটিংয়ের চারদিন আগে সে বলল, তার নানী অসুস্থ তাই ছবিতে কাজ করতে পারবেন না। সেই মুহূর্তে সুমিতা দেবী কলকাতার সোমা মুখার্জির কথা জানালেন। তিনিই সোমাকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করলেন। সোমার বাবা সোমাকে নিয়ে সরাসরি সিলেটের জয়ন্তিয়াপুরে চলে এলো। সেখানেই সোমাকে প্রথম দেখলাম। বেশ পছন্দ হলো। তাই সোমাকে নায়িকা হিসেবে নিলাম। ছবির একটি দৃশ্যে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় আমার দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে আসছিল। তখন সোমা দৌড়ে এলো আমার কাছে, ও বেদনার স্বরে বলল, ‘দাদা কোন জায়গায় ব্যথা পেয়েছেন।’ ও নিজ হাতে রক্তাক্ত স্থানে ডেটল লাগিয়ে দিল। বেদনার স্বরে—‘যাক হাত-পা ভেঙে তো যায়নি—ভগবান আপনাকে রক্ষা করেছেন।’ । সোহেল রানার প্রথম নায়িকা কবরী ও অলিভিয়া। ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে এরা দু’ জনে তার বিপরীতে ছিলেন। সোহেল রানা ও ববিতা জুটি এক সময় জনপ্রিয় হয়েছিল। এই জুটির ‘গুনাহগার’ ছবিটি ১৯৭৬ সালে রিলিজ হয়। এরপর ববিতার সঙ্গে অভিনয় করেন শরীফ বদমাস, মিন্টু আমার নাম, হাইজ্যাক, আসামি হাজির, তিন কন্যা, প্রতিহিংসা, চ্যালেঞ্জ, নাগপূর্ণিমাসহ আরও কয়েকটি ছবিতে।
সোহেল রানা প্রযোজিত ‘ওরা এগারোজন’ ছবিতে শাবানা অভিনয় করেছিলেন। ওই ছবি থেকেই শাবানার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে শাবানার সঙ্গে রাজরানী, জবাব ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। সুচরিতা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনা প্রমুখ নায়িকার বিপরীতে ছিলেন সোহেল রানা। সুচরিতার সঙ্গে দোস্ত দুশমন, জীবন নৌকা, যাদুনগর, রোজিনার সঙ্গে বিদ্রোহী, অমর বন্ধন, জারকা, হুমকি, অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে নকল শাহজাদা, রাজ ভিখারী, অঞ্জনার সঙ্গে আখেরি নিশান ছবিতে অভিনয় করেন। তার প্রযোজিত ছবিগুলো হলো—গুনাহগার, জবাব, এপার ওপার, জীবন নৌকা, যাদুনগর, নাগপূর্ণিমা, মারকশা, লড়াকু, বীরপুরুষ, বজ্রমুসঠি, ঘেরাও, চোখের পানি, টপ রংবাজ , ঘরের শত্রু, শত্রু সাবধান, ভালবাসার মূল্য কত, খাইছি তোরে, রিটার্ন টিকিট, মায়ের জন্য পাগল, ইত্যাদি।
নিজের প্রযোজিত ছবি ছাড়াও অভিনয় করেন দোস্ত দুশমন, জিঞ্জির, বারুদ, 'ওস্তাদ সাগ্রেদ', জনি, অস্বীকার, আসামি হাজির, আখেরি নিশান, শরীফ বদমাশ , মিন্টু আমার নাম , বাঁধনহারা , আলী আসমা , জারকা , পেনশন, বাহাদুর মেয়ে, আদালত, প্রতিহিংসা, প্রেমনগর, চ্যালেঞ্জ, বড় মা, নাম বদনাম, প্রেম বন্ধন, গাদ্দার, মহারাজা, সেলিম জাভেদ, স্ত্রী, প্রহরী, প্রেমের দাবি, অপহরন, অজান্তে , কমান্ডার, বিশ্বপ্রেমিক সহ অনেক ব্যবসাসফল ছবিতে । অজান্তে ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আশির দশকে বাংলাদেশের দর্শকরা ভিডিও/ ভিসিপি'র মাধ্যমে যখন হলিউড এর মার্শাল আর্ট ভিত্তিক ব্রুস্লির ছবির ভক্ত হয়ে পড়ে তখন এই সোহেল রানা ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম কে দিয়ে নির্মাণ করেন 'রক্তের বন্দী' ছবিটি । যদিও ছবিটি সেই সময়ে ফ্লপ হয়েছিল । এরপর নিজের ছোট ভাই রুবেল'কে নায়ক চরিত্র দিয়ে শহিদুল ইসলাম খোকন'কে দিয়ে নির্মাণ করেন 'লড়াকু' ছবিটি যা বক্স অফিসে ঝড় তোলে আর বাংলার দর্শকরা মার্শালআর্ট ভিত্তিক ছবি গ্রহন করে নেয় । এইভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি মার্শাল আর্ট / কংফু'কে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন । আমরা যারা সেই সময়ে সিনেমা হলে ছবি দেখতাম তারা সিনেমার পোস্টারে মাসুদ পারভেজ / সোহেল রানা এই দুটি নামের যে কোন একটি থাকলেই সেই ছবি আর না দেখে থাকতে পারতাম না ।
আজকের বাংলা চলচ্চিত্র নতুন একজন মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা'র অপেক্ষায় আছে যিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন ।
সোহেল রানা অভিনীত কিছু জনপ্রিয় গানের লিঙ্ক-
ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়
তুমি তো এখন - জীবননৌকা
মন রেখেছি আমি - এপার ওপার
ভালোবাসার মূল্য কত - এপার ওপার
ভালোবাসা জীবন থেকে অনেক বড়- অজান্তে
এই বুকে কান পেতে শোন - অপহরণ
জীবনের আরেক নাম ভালোবাসা- অপহরন
চোর আমি ডাকু আমি - জনি
তুমি থাকলে কাছে - টপ রংবাজ
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, সাপ্তাহিক চিত্রালি, পাক্ষিক ছায়াছন্দ ও দৈনিক সমকাল ।।