কোরবানীর ঈদের একটা বিশেষ আনন্দ হল গরু কেনা আর সেগুলোর গুনকীর্তন করা। আমার শৈশব থেকে তারুন্য কেটেছে বার্ড ক্যাম্পাসে। বাবার চাকুরি সুবাদে রকমফের মানুষের সাথে অনেকগুলো ঈদ করার সৌভাগ্য আমার জুটেছে। ছোটবেলা থেকেই কোরবানীর গরু কেনার পর দেখতাম সেগুলো আমাদের বড় মাঠে হাজির করা হতো। ঈদের দু'তিন দিন আগ থেকেই মাঠে চলতো গুরু প্রদর্শনী। কার গরুটা মোটা তাজা, কারটা জেতে? সিনা বড় কারটা, শিংওয়ালা গরু, কালো বিশেষ রংয়ের গরু এসবই থাকতো আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। কোরবানীর ঈদ এলে বাড়ি আসতেন আমাদের ক্যাম্পাস থেকে দূরে পড়তে কিংবা চাকুরীতে যাওয়অ বড় ভাইরা। আর যারা বার্ড ক্যাম্পাসের আসে পাশে বাড়ি করেছেন কাজের কারণে দূরে আছেন তারাও মিলিত হন ঈদে। বিশেষ করে কোরবানীর ঈদে যেন সবাইকেই পাওয়া যায়।
২০১৩সালের ঈদটি আমার জন্য অনেক ভিন্নতার। এ বছরই প্রথম আমি দূর থেকে ছুটিতে এসেছি বাবা মার সাথে ঈদ করতে। চাকুরী জীবনের ৫ম বছরে এসে আমাকে স্থান পরিবর্তন করে ঢাকায় যেতে হয়েছে। আর তাই ছুটি নিয়ে এসেছি ঈদ করবো প্রিয়জনদের পাশে। আমার আসা যেন অনেক ছোট ভাইকেই আনন্দিত করেছে। বিশেষ করে এলাকায় যখন থাকতাম অবসরে তাদের সবাইকে কম বেশি সময় দিতাম। কিন্তু দূরে যাওয়ায় ওরা আমাকে আগের মতো পায়না।ওরা আমাকে পায়না বড় কথা নয়, বরং আমিই তাদের পাইনা।
ঈদ পূর্বদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। রনি, হিমু, মুজাহিদ, কাউসার, রাজু, বোলন, সুজন, জুয়েল, নাদিম, সোহান, বাবু, বিজয় একসাথে হলাম। গল্প চলছিল। হঠাৎই রনি, কাউসার, বোলন (এবি হাবিব) আমাকে জিজ্ঞেস করলো আজ ঘুরতে যাবো কিনা। আমাদের ঘুরতে যাওয়াটা এমন যে হুট করে কোথাও বেরিয়ে পড়া। নিকট এলাকার অলিগলি গ্রাম পথে বাইক নিয়ে দূরের কোথাও গিয়ে চা খাওয়া জিলিপি খাওয়া আর আড্ডা মারার মাঝে যেন অন্য রকম আনন্দ পাই আমরা। উদ্যোগটা আমিই প্রথম নিয়েছিলাম। একদিন ওদের নিয়ে গিয়ে এক বেকারী থেকে গরম পাউরুটি আর হালকা স্ন্যাকস নিয়ে এসেছিলাম। পরে একসাথে বসে অন্যদের ডেকে আমাদের হালকা আপ্যায়নে শরীক করলাম। যার পর থেকে সবাই এমন ছোটখাটো শর্ট ট্যুর এ আগ্রহী হলো। যদিও এতে খরচ শুধু সিনিয়রদের। আর যারা বাইক চালায় তাদের।
আমরা সাড়ে ৮টায় যাত্রা শুরু করলাম। আজকের গন্তব্যের পথটা ভিন্ন। বার্ডের পূর্ব পাশ দিয়ে শালবন যাদুঘর হয়ে দক্ষিনের কাচা রাস্তা ধরে আদিনা মূড়া। তিনটি বাইক। রনির সাথে হিমু, মুজাহিদ, খোকনের সাথে বাবু, সুজনের সাথে রাজু আর আমার বাইকে কাউসার ও বোলন। মিটার রিস্টার্ট দিলাম।
মেঠো কাচা পথ ধরে গিয়ে থামলাম আদিনা মুড়া। তারপর সেখানে হারুন মিয়ার দোকানে চা। জায়গাটির নাম দরগানামা নামেই ডাকেন স্থানীয়রা। সেখানে যাওয়ার পথটিতে বাশবাগান আর পুরোটাই কালো বন। যেন ভেতরে হাড়মাংস খাওয়া ভুতেদের বসবাস। আমরা হই চই করতে করতেই পথটি পারি দিলাম। মাঝে মাঝে যদিও ভয় দেখানোর মতো কিছু চিৎকার আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউই ভয় পায়না। সবাই সাহসী। সিসিএন পলিটেকনিক ক্যাম্পাস এলাকাটি পার হবার পর প্রায় ৩/৪কিলোমিটার পথ পুরোটাই ভুতুরে। রাস্তার পাশে পাহাড়, কখনো বাঁশবন, কখনো কাঠাল বাগান। কোথাও জনবসতি নেই। হঠাৎ খোলা প্রান্তরের ছোট কাঁঠালগাছটির খোপটিকে মনে হয় দ্বীপের মাঝে বাড়ি। ওরা যখন ভয় পাচ্ছিলনা তখন আমি বাইক স্লো করে বললাম ভয়ংকর এক ছোট্ট কথা। রনি খোকনের বাইক সামনে আর আমি সুজনকে একপ্রকার সমান্তারালে রেখেই টানছিলাম। বললাম, ডান দিকে ওই দিকে কবরস্থানের দিকে তাকাও, দ্যাখো ধোঁয়া উড়ছে। ওরা যেন সেদিকেই তাকালো। বললাম চোখে পড়ে কিনা কে জানে, একটা বুড়ো লোক কবরস্থানের উপর বসে আছে। লোকটি গত ৩বছর আগেই মারা গেছেন রোড এ্যাক্সিডেন্টে। খুব গরমের কারণে লোকটি বসে আছেন, ভেতরে বিদ্যুৎ নেই তাছাড়া জেনারেটর ও অফ… আমার শেষ কথাটিতে ওরা অট্টহাসিতে পুরো পাহাড়ময় পথ গরম করে ফেললো। ওরা বুঝতে পারলো আমি দুষ্টুমি করছি। একা কিংবা দু’জনে এপথে রাত্তিরে কেন দিনের বেলাতেও যাওয়ার সময় ভয় পেতে হবে। আসলেই জায়গাটি খুব ভীতিকর। দু’পাশের পাহাড়গুলোই লালমাই পাহাড়।
দরগানামার চায়ের বিল দিল সুজন। চায়ের মাঝে একটা ভিন্ন স্বাদ ছিল। মাটির উনুনে লাকড়িতে রাধা চা। কেউ কেউ নাকি এটাই প্রথম পান করলো। চা শেষে আবার বাইকে। চলতে চলতে গিয়ে বাতাইছড়ি বাজার। ৪টি বাইক। এ পথে এ রাতে কেউ এভাবে আশা করে না। কারণ গ্রাম। আর ঈদ হওয়ার কারণে সবাই যার যার পরিবার আর গরু নিয়ে ব্যস্ত। রাজনীতিকরা এতো রাতে ঈদের পূর্বদিন আসবেন না। তাতে জরিমানা হতে পারে। আমরাও চলছি খুবী ব্যালেন্সড হয়ে। হর্ণ দিয়ে বাচ্চাসুলভ আচরন আমরা পছন্দ করিনা।হঠাৎ আমার চোখ পড়লো একটি জিলিপির দোকানে। যেই চোখ পড়লো অমনি বাইক থেমে গেল। গিয়ে সেখান থেকে হাফ কেজি জিলিপি কিনলাম। সবাই যে খুব জিলিপি পাগল কিংবা তা আর আগে দেখিনি বিষয়টা এমন নয়। আনন্দ আর একসাথে উপভোগ করার মতো কিছু যেন খুজে পেলাম আমরা। সেখানে নতুন তৈরী করা গজাগুলো বেশ লাগলো। সবাইকে বললাম গজা খাওয়ার জন্য। অনেকেই প্রথম গজা গেল। খুবই সুস্বাদু একটা পিঠা জাতীয় খাবার। এবারের বিলটা রনির নামে করতে চাইলাম। রনির অবস্থা যাই হোক পকেটের অবস্থা নাকি ভালো না। তাই সে আমার কাছে একান্তেই হাফ ছেড়ে বাঁচার আরজি জানালো। সবাই খুব মজা করলো রনির সাথে। এলাকার ছেলে বলে কথা।
আমরা আবার বাইকে চড়লাম। এবার আমি সবার সামনে আরো দ্রুত বেগে চলতে চলতে একটা তালগাছের নিচে গিয়ে দাড়ালাম। তারপর আসলো খোকন ও সুজন। কিন্তু রনির বাইক না দেখে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। ফোন দিয়ে জানলাম ওরা ছোটখাটো প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু দলকে বিচ্ছিন্ন রেখে এমনটা যেন না করে তা জানালাম তাদের। গ্রামের মানুষ আমাদের দেখে কৌতুহলী। আবার চলতে লাগলাম আমরা। এবার কাউসার আর এবি হাবিবের চোখ রাখতে বললাম দোকানের ঝুলে থাকা চিপসের সারিতে। কোথাও বোম্বের রিং চিপস পেলাম না। হলুদ প্যাকেটে চিপসটির বাজার কি শেষ হয়ে গেল। ছোট বেলা খুব খেতাম এটি। কিন্তু এখন আর পাচ্ছি না আগের মতো।
এ পথ ওপথ ঘুরে কালিরবাজার হয়ে আমরা পৌছলাম রায়চোঁ গ্রামের চৌরাস্তায়। সেখান থেকে অলিপুর গেলাম চা খেতে। খোকন আর বাবুকে বিদায় দিলাম সেখানেই। তাদের আপ্যায়নে আমরা খাটি দুধের চা খেলাম। কনডেন্সড মিল্ক সব জায়গায় পাওয়া যায়। কিন্তু এ চা সবখানে মিলেনা।
কখনো কাঁচা কখনো ভাঙা আবার কখনো মসৃণ পথ আমাদের যাত্রাটাকে মধুর করে রাখলো। কে আগে কে পরে তারও একটা ঠান্ডা প্রতিযোগিতা থাকলেও তা বিপদজনক ছিল না। রনিকে সামনে যেতে দেইনি যদিও সে সুযোগ খুজেছিলা অনেক। কারণ তার বাইকের দাপটানিতে বালু ওড়ে আমাদের পোয়া বারো।
অলিপুর থেকে আমরা আবার চলে আসলাম আমাদের চিরচেনা বোর্ড মার্কেটে। শেষ মুহুর্তে বিজিবি ক্যাম্পের পশ্চিমে লালমাই পাহাড়ের যে অংশে মুড়ার বাজার বসে সেখান পর্যন্ত উঠতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ আমার বাইকের জ্বালানী শেষ। কোন রকম উঠেই রিজার্ভে দিলাম। এরপর খোশ গল্প করতে করতে চলে আসলাম আঙিনায়। রনির বাইক কোন আপ্যায়নের সুযোগ পাবেনা তা কি হয়! তাই রনি আর হিমু মিলে স্প্রাইট খাওয়ালো সবাইকে। সাথে যোগ হলো- রানা, জিসান, আরাফাত।
আমরা পৌছলাম তখন প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে। কেউ কেউ যখন বলছে এপথে ঘুরতে গেলা তা আর এমন কি? আমার কথা হলো.. হয়তো আমরা সবাই একসাথে থাকবো না। চলে যেতে হবে অনেক দূরে প্রয়োজনের তাগিদে। তাই জীবনের তারুন্যের সময়গুলোকে স্মরণীয় রাখতে মাঝে মাঝে এমন ঘুরাঘুরির দরকার অবশ্যই আছে। আজ না হোক ৫বছর পরও যদি ওই পাহাড়ি পথে এদলের কেউ যায় তবে আজ রাতের কথা অবশ্যই স্মরণ করবে।
পথগুলো আমার জন্য নতুন নয় কিন্তু যাদের সাথে নিয়ে গেলাম তাদের জন্য কারো কারো নতুন। আবার কেউ নাকি এতো আনন্দের ট্যুর দুরে গিয়েও করতে পারেনি। আসলে আমরা এমনই করি। হুট হাট সিদ্ধান্ত তারপর বেরিয়ে পড়ি দূর অজানায়। যেমনটা এর আগে গিয়েছিলাম দিনাজপুর। সেদিন সকালে ঝুম বৃষ্টিতে সফর নিয়ে কনফিউশন তৈরী হলেও দুপুরে ঠিকই ঢাকায় পৌছে গেলাম। এরপরটা কি হয়েছিল তা না হয় আরেকদিন বলবো।