আলমারীতে কিছু পুরনো ফাইল পত্র ঘাটতে গিয়ে আব্বার ডায়েরী (১৯৭৭ ও ১৯৮৪), ডায়েরীর ভেতর আমার ছোটবেলার ছবি এবং ওনার টোব্যাকো পাইপ(Half bent billiard) খুজে পেলাম। এটা ছিল একটা হ্যান্ড মেড টোব্যাকো পাইপ যা দিয়ে তিনি স্মোক করতেন। তার মাঝে ওনার ডায়েরীর কিছু লেখাও চোখে পড়ল । ১৯৭৭ সালের মার্চ ১৯ তারিখে তিনি লিখেছেন "কুমিল্লা টাউন হলে মিটিংরত কালে চেয়ারম্যানদের রেডিও উপহার দেওয়া হইলো।" যদিও তা বুঝতে পারিনি রেডিও কে দিয়েছে। অনেকের কাছেই শুনেছি তিনি খুব শৌখিন ছিলেন। কেন যেন মনে হয় তিনি যদি এখন বেচে থাকতেন সিগারেট খাওয়া হয়তো ছেড়ে দিতেন তবে লেটেস্ট সব টেক ডিভাইস তিনি ইউজ করতেন। কারন যখন বিয়েতে যৌতুক হিসেবে রেডিওর প্রচলন ছিল, তখনকার দিনে তিনি টিভি কিনেন। অনেক দূরের এলাকা থেকে নাকি মানুষ আসতো এই আজব জিনিষ দেখতে। প্রতি মাসে একবার রাত ৯ টায় ফিল্ম দেখাতো, ঐ ফিল্ম দেখে মানুষ নাকি আমাদের বাংলো ঘরেই থেকে সকালে যেতো। আব্বার কেনা ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের ঐ টেলিভিশনটা আমার টিনএজ পর্যন্ত ঘরে ছিল। নকশী করা পিতল-তামার গ্লাস,পানের বাটা,জগ,বাসন, অথবা কারুকার্যমন্ডিত কাঠের আসবাব ছিল আব্বার সৌখিনতার নিদর্শন। হয়তো এরকম আরো অনেক কিছু.......যা আমার জানা নেই। উনার অনেক কিছুই আমি জানিনা কারন ছোটবেলা থেকেই উনার একটা সাদাকালো ছবি দেখে আব্বার একটা ফর্শা অবয়ব কল্পনা করে ফেলেছিলাম। ভাবতাম আব্বা ফর্শা কিন্তু উনি নাকি কালো ছিলেন,পেট বড় ছিল, হাতে একটা টাইট রাবার আর সিকো ফাইভ ঘড়ি পড়তেন, এবং ছিলেন প্রচন্ড রকম রাগী!! এই সব কিছুই আম্মার কাছ থেকে শোনা কথা। অবশ্য এ ছাড়া আর উপায় নেই। কারন তিনি যখন মারা যান তখন এই দুনিয়ার সব কিছুই আমার "আম্মা" ছিল। কারন আম্মা ছাড়া আর কোন শব্দ আমি তখনো শিখিনি । আব্বার একটা খেদ ছিল, কেন আমি উনাকে "আব্বা" ডাকি না। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন উনার সময় আর বেশী নেই। আম্মা বলছে, আব্বার সাথে শেষ দেখা উনার যখন হার্ট এটাক হয় তার আগের দিন, উনি কোথাও যাবার জন্য পরিপাটি পাঞ্জাবি পড়েছেন, আমি নাকি ওনার কোলে উঠতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার গায়ে ধুলো বালি থাকায় আব্বা কোলে নেননি বলেছেন "আব্বু কাল নিবো" । তারপর আর কোলে নেওয়া হলো না আমাকে, কারন তার পরদিন আব্বার হার্ট এটাক হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায়, উনাকে ট্রলার যোগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। উনার যখন হার্টে তীব্র ব্যথা হতো তখন তিনি কাঁদতেন আর বলতেন "হেয় মনে হয় আমার আদরডা আর পাইলোনা,তারে কিন্তু দেইখা রাইখো" হ্যা তা যথার্থই দেখে রেখেছে এই নিষ্ঠুর দুনিয়া আর ঘৃনিত মানুষ গুলো। যাইহউক তিনি মারা গেলেন তারপর উনার লাশ যখন আনা হয় কোন এক আত্নীয় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো আব্বার লাশ দেখাতে কিন্তু আমি নাকি বিস্কুট খাওয়ায় এতই ব্যস্ত ছিলাম, আমি আব্বার দিকে তাকাই নি!! অথচ আব্বার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করে ,এখন উনি থাকলে নিশ্চয় আমাকে সব সময় খুজতেন,আমি খেয়েছি কিনা খবর নিতেন,জ্বর আসলে নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন ইত্যাদী। যদি অসুস্থ হয়েও বেচে থাকতেন নিশ্চয় উনার সেবা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যেতাম!! হা হা হা, কিন্তু উনার একটা ডাক যে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত, পেতাম পরম নির্ভরতা!!! সমূদ্রের যাত্রাকারী নাবিকের কাছে, জাহাজে অনেক সঙ্গী থাকা পরও এবং ধ্রুবতারা লক্ষ মাইল দূরে থাকা সত্বেও ঐ ধ্রুবতারা ই আপনজন কারন ধ্রুবতারাই পথ দেখায়, সে পথের দেখা আমি পাইনি। যাইহউক একজন লোক মারা গেছে কিন্তু সবাই মৃতের বাড়ীতে বিস্কুট নিয়ে আসতো!!! বিষয়টা ভাবলে তাজ্জব বনে যাই !! যাইহউক, তখন নিশ্চয় আমার বিড়ালের দিন কাল খুব ভাল কেটেছে, কারন বিস্কুট নাকি সব বিড়ালের পেটেই যেতো!!! ঐ বিড়াল গুলো(বিড়ালের বংশ পরম্পরা) ২০১০ পর্যন্ত আমার সাথেই ছিল। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের হিংস্রতায় শেষ পর্যন্ত বিড়াল গুলোকেও আমি হারিয়েছি। যাইহউক আব্বার সাথে আমার রিল্যাশন বেসিক্যালি দেড় বছরের,অর্থাৎ ঐ দেড় বছর আমি ছিলাম অবুঝ । তাই আমার দুনিয়ায় আব্বা শুধুই একটি শব্দ, আর কিছুই নয়। মোটামুটি ১১ বছর বয়স থেকে অবিবেচক এই দুনিয়ার কঠিন বাক গুলো আমার চেনা হয়ে গেছে, তাই অনেক কিছু নিয়ে আফসোস আছে কিন্তু আব্বাকে নিয়ে আমার কোন ফিলিংস নাই। তবে তিনি যদি আরো কিছুকাল বেচে থাকতেন হয়তো জীবনের গতিপথ অন্যরকম হতে পারত। তবে এটা শুধুই হালকা চালে একটা ভাবনা কোন আফসোস নয়। কারন যা পাইনি তা আব্বার কারনে পাইনি বলাটা ভুল। সব কিছুর মালিক যেহেতু উপরওয়ালা তিনি কি খেলায় মেতেছেন তা শুধু তিনিই জানেন, ঐ বিবেচনাটাও ওনার। যা পাইনি , তা পাই-ই- নি, তা আর কোন কালেই পাবনা। এইখানে পাওয়ার প্রশ্নটাও অবান্তর। কারন যা না পাওয়ার কথা বলতেছি তা আদৌ হয়তো আমার কপালে ছিলই না । হা হা হা । জীবনের কষ্টযাত্রায় চলতে চলতে চলতে.... কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি সে সুখ তার নাগাল হয়তো কোনদিন ই পাবো না। সব কিছু তার ইচ্ছে। তিনি অবশ্যই মহান।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:০০