somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যিনি শুধু বিদ্যার-সাগরই নন : (প্রয়াণ দিবসের বিলম্বিত শ্রদ্ধাঞ্জলি)

০১ লা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জন্মের পর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ নাম রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।তিনি নাকি স্বপ্নের মাধ্যমে আগেই জেনেছিলেন তার অনাগত বংশধর পরবর্তীজীবনে মহান একটা কিছু হবে।পড়ালেখা শেষে সেকালের নিয়ম অনুযায়ী সম্ভাব্য তিনটি পদবীর/ডিগ্রী মধ্যে একটি ‘বিদ্যাসাগর’ পদবীটা তিনি নিজেই পছন্দ করেছিলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষও সেটার অনুমোদন দেন।সেই থেকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।তাঁর পরে এই পদবী আরও অনেকেই প্রাপ্ত হয়েছেন তবে “বিদ্যাসাগর” বলতে আমরা এখনো সেই একজনকেই চিনি।গরিব ব্রাহ্মনের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একটু গোয়ার প্রকৃতির।সেই গোয়ার্তুমির ধারাটা সারা জীবনই ধরে রেখেছিলেন, তবে ব্যবহার করেছেন সমাজের কল্যানে,মানবতার পক্ষে।ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই- সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাজ্য করে তিনি বিধবা-বিবাহ আইন পাশ করিয়েছেন তদানিন্তন ইংরেজ সরকারকে দিয়ে এবং নিজের একমাত্র ছেলের জন্য বউ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন একটি বিধবা কন্যাকেই।

প্রকৃতিতে কিছুটা গোয়ার হলেও তিনি কিন্তু একাধারে ছিলেন দয়ার সাগর ও অসম্ভব রসময় ব্যক্তিত্ব। সারাজীবন একটি কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন আর সেটা হল-মাতাপিতার সেবা।এব্যাপারে সেকালে এবং আজকের ওল্ডহোম-কালচারের যুগেও তিনিই আইকন।ধর্মকর্ম বা ঈশ্বর ভক্তি কতটা ছিল জানা যায় না,সম্ভবত ছিলেন কিছুটা অজ্ঞেয়বাদী স্বভাবের অথবা বলা যায় এড়িয়ে চলতেন প্রচলিত মূর্তিপুজা, ভুলে গিয়েছিলেন সান্ধ্যমন্ত্রও(যেটা তাঁর মতো অসম্ভব স্মৃতিধর ব্যক্তির পক্ষে প্রায় অসম্ভব)-শুধু পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনই ছিল তাঁর আচরিত ধর্ম তারসাথে অবশ্যই মানবপ্রেম।কর্মই তাঁর ধর্ম ছিল।

গরিবের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র গরিবি হালতে চলতেই পছন্দ করতেন।সারাজীবন মায়ের হাতে ঘরে তৈরী মোটা কাপড়ের বস্র পরতেন- মানের দিকদিয়ে বলাযায় যেগুলি সেআমলে সমাজের অন্তজশ্রেনীর(মেথর/ডোম) লোকেরাই পড়ত অথচ নিজের প্রাপ্ত ছাত্রবৃত্তির টাকায় অসহায় ছাত্র বন্ধুদের তিনি জামা-কাপড় কিনে দিতেন এবং সেগুলি অবশ্যই পাতলা মিহি কাপড়ের তৈরীই।সারাজীবন কোলকাতা থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরের বিরসিংহ গ্রামে হেঁটেই যেতেন,বাড়ির/গাঁয়ের সাথে যোগাযোগ কমে যাবার ভয়ে কোলকাতায় বাড়ি করার পক্ষপাতি ছিলেন না।ভাড়া বাড়িতে নিজের গড়া লাইব্রেরীর বই রাখা কস্টকর বলে অনেক বয়সে কোলকাতায় একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন তবে তারআগে বাবার অনুমতি নিতে ভুলেননি।

নিজের কাজ নিজহাতে করতে পছন্দ করতেন।বহুবার এমন হয়েছে তাঁর খোঁজে কোন দর্শনার্থী বাসায় এসে তার বেশভূষা দেখে তাঁকেই বাড়ির মালি বা চাকর মনে করেছে কারন তখন তিনি ব্যস্তছিলেন বাগান পরিচর্যায় বা করছিলেন ঘরের কোন কাজ(অবশ্য এব্যাপরে তাঁর বিখ্যাত চেহারাটিরও একটি ভূমিকা থাকতে পারে!) মাঝেমাঝে রেল স্টেশনে চলে যেতেন কুলির কাজ করতে। মাথায় উঠিয়ে নিতেন বোঝা তবে বোঝা নামিয়ে বিনিময়ে পয়সা নিতেন না।একবার তেমনি এক ঘটনায় সেকালের এক বিখ্যাত ডাক্তার তাঁকে পয়সা দিতে গেলে তিনি বলেছিলেন আমার নাম ঈশ্বর চন্দ্র শর্মা,ভদ্রলোক বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চিনতে পেরে লজ্জা পেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এখন থেকে বাকীজীবন নিজের কাজ নিজ হাতেই করবেন।

অন্যের বোঝা সহাস্যে বয়েছেন সারাজীবন ধরে,সেটা আক্ষরিক অর্থে বোঝাই হোক বা আপাতঅর্থে।ইংরেজ সরকারের বড় কর্তাদের সাথে দেখা করতে গেলে তাঁকে কখনো অফিসের দরজায় অপেক্ষা করতে হতো না।অনেক দর্শনার্থী ডিঙ্গিয়ে তিনি আগেই চলে যেতেন।একবার তেমন এক পরিস্থিতিতে কোন এক দেশী হোমরাচোমরা (রাজা/জমিদার) ইংরেজ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন ঈশ্বরচন্দ্র সবার আগে যায় আর তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা দরজায় অপেক্ষা করেন?সাহেব উত্তরটা দিয়েছিলেন বেশ সোজা- বিদ্যাসাগর মহাশয় কখনোই নিজের দরকারে আসেন না,তোমরা আস নিজের দরকারে।

দানখয়রাতের কথা আলাদা করে বলবো না।একটি ঘটনা শুধু বলছি যেটা থেকে তাঁর টনটনে কর্তব্যবোধের কিছুটা আঁচ করতে পারা যায়।অকালপ্রয়াত একবন্ধুর মা এসে বায়না ধরলেন তিনি বাকী জীবন কাশিতে কাটাতে চান এবং খরচটা অবশ্যই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছেই প্রত্যাশী।যথারীতি তিনি বন্ধুর মায়ের কাশিবাসের ব্যবস্থা করেন।এমনকি মৃত্যুর আগে নিজের সর্বশেষ উইলেও বন্ধুর মায়ের জন্য নির্দিস্ট মাশোহারা রাখতে ভুলেননি।ভদ্রমহিলা প্রায় চল্লিশ বছর কাশিতে বাস করে যখন মৃত্যুবরণ করেন ততদিনে বিদ্যাসাগর মহাশয় পরপারে চলেগেছেন দেড়-দু বছর হলো।

শুধু একটা ব্যাপারে তিনি কৃপণ ছিলেন-কাউকে বই ধার দিতেন না।কারন একবার তাঁর এক বন্ধু একটা দূষ্প্রাপ্য বই নিয়ে আর ফেরত দেয়নি(বইটির কয়েকটা কপি শুধু জার্মানীর লাইব্রেরীতে পাওয়া যেত),পুরাতন বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পরে পুরাতন বইয়ের দোকানে তিনি বন্ধুকে দেওয়া ঐ কপিটি খুঁজে পান এবং কিনে নেন।তারপর থেকে লাইব্রেরীতে বসেই সবাইকে পড়তে হতো,বাড়ি নেওয়া বন্ধ।

আমজনতাকে ভালবাসতেন তিনি।সমাজের নীচু শ্রেনীর মানুষের সাথে মিশতে পারতেন খুব সহজে।জীবনের শেষ দিনগুলি তাঁর কেটেছে শহর কোলকাতার ভদ্রসমাজ থেকে বহুদূরে সাঁওতালদের সাথে।দেহরক্ষাও সেখানেই।কারনটা সহজেই অনুমেয়- সেদিনের বাঙ্গালী সমাজের জঞ্জালের বোঝা সাফ করতে গিয়ে কিছু নামিদামি শিক্ষিতশত্রুও তাঁর জুটেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সেকালের গ্রামের বিয়ের বর দেখা

লিখেছেন প্রামানিক, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওবায়েদুল কাদের কি মির্জা ফখরুলের বাসায় আছেন?

লিখেছেন রাজীব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

"পালাবো না, পালিয়ে কোথায় যাবো? দরকার হলে মির্জা ফখরুলের বাসায় আশ্রয় নেবো। কি ফখরুল সাহেব, আশ্রয় দেবেন না?" ওবায়েদুল কাদের একটি জনসভায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। ৫ই আগষ্টের পরে উনি মির্জা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যোগ্য কে???

লিখেছেন জটিল ভাই, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪১

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)




(সকল... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতান্ত্রিকভাবে লীগকে ক্ষমতার বাহিরে রাখা যাবে আজীবন।

লিখেছেন শাহিন-৯৯, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:১৩



লীগ সদ্য বিতাড়িত কিন্তু তাদের সাংগঠিক কাঠামো এখনো পূর্বের মতই শক্তিশালী শুধু ছোবল দিতে পারছে না, স্থানীয় নেতারা বিএনপির নেতাদের বড় অংকের টাকার বিনিময়ে ইতিমধ্যে এলাকায় প্রবেশ করছে তবে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেললেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৪১


মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী লম্বা রেইসের ঘোড়া মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া হতে বেডরুমে যার নিয়োগ নিয়ে অস্বস্তি আছে তিনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন কিভাবে মানুষের মাথা ঠান্ডা করতে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×