একটা সময় ছিল যখন বিশ্ব বরেণ্য লেখকরা বিশ্বসাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করতেন অনুবাদ কর্মের দ্বারা।এই অনুবাদের ভাষা হত হতো ইংরেজী বা ফরাসী।রবীন্দ্রনাথ নিজ রচনার ইংরেজী অনুবাদের ব্যাপারে আগ্রহী হন যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ।প্রধানত বিদেশী বন্ধুদের আগ্রহেই তিনি অনুবাদ কর্মে হাত দেন।খুঁতখুতে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদের ক্ষেত্রে নিজের ওপরই ভরসা রাখেন।প্রকৃতপক্ষে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ কবিতা থেকে ১০৩টি কবিতা বেছে নিয়েছিলেন যেগুলি তার বিচারে কোনরূপ সংশোধন বা পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল না।এগুলি একত্রিত করেই নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ বের করার চিন্তাভাবনা চলল। কিন্তু বাংলা ভাষার এক অখ্যাত লেখক,যার কোনও ইংরেজী বই নেই, তাঁর প্রথম ইংরেজী বই ছাপানোর জন্য প্রকাশক পাওয়া একটু কঠিন ব্যাপারই ছিল।সমস্যার সমাধান হলো যখন ইন্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক ফক্স স্ট্র্যাংওয়েজ বললেন বইটির সীমিত সংখ্যক কপি(৭৫০টি) সোসাইটির সভ্যদের জন্য ছাপাতে তিনি রাজি। গীতাঞ্জলী , নৈবেদ্য, খেয়া, কাব্যগ্রন্থথেকে ১০৩টি নির্বাচিত কবিতার কাব্য সংকলন ছিল এই অনুবাদ গ্রন্থে।
আমেরিকান পাঠকদের সাথে কবিকে পরিচিত করে দেয়ার দায়িত্ব নেন এজরা পাউন্ড।তিনি গীতাঞ্জলির ছয়টি অপ্রকাশিত কবিতা আমেরিকার এক সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।এরপর রোটেনস্টাইনের মধ্যস্থতায় ম্যাকমিলান কোম্পানী রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী গ্রন্থাবলীর বানিজ্যিক সংস্করণ প্রকাশে সম্মত হয়।১৯১৩ সালের মার্চে গীতাঞ্জলি বা Songs of Offerings এর ম্যকমিলান সংস্করণ প্রকাশিত হয়।এই কাব্যগ্রন্থের অভূতপূর্ব সাফল্য প্রকাশককে আরও বই ছাপাতে আগ্রহী করে তোলে।গীতাঞ্জলির খ্যাতি আস্তে আস্তে বিশ্বময় ছড়িয়ে পরে।বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদও শুরু হয়।
ম্যাকমিলান কোম্পানী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা প্রকাশকদের কাছে গীতাঞ্জলির কপি পাঠায়, উদ্দেশ্য কবি পরিচিতি ও অন্যান্য ভাষায় কবির বই ছাপানো।এরই ধারাবাহিকতায় জার্মানীর এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ প্রকাশকের কাছে গীতাঞ্জলির এককপি পৌছে যায়।বইটি একটু দেখে প্রতিষ্ঠানটি মন্তব্য করে এই বইয়ের অনুবাদ জার্মানীতে চলবেনা।ইংরেজী যার মাতৃভাষা নয় এহেন এক ‘কালা আদমীর’ অনুবাদ কেইবা পড়তে চাইবে? সুতরাং বইটি/কপিটি ফেরত পাঠানো হয় ম্যাকমিলান কোম্পানীর কাছে।সেদিন অপরাহ্ণেই খবর পাওয়া গেল “গীতাঞ্জলি” নোবেল প্রাইজ পেয়েছে।প্রকাশক ততক্ষনাত পোস্ট অফিসে লোক পাঠিয়ে স্তুপীকৃত চিঠিপত্রের মধ্যথেকে খুঁজে গীতাঞ্জলি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলেন।সেই অনুবাদের পর এখন পর্যন্ত জার্মান সাহিত্যে রবীন্দ্র রচনার উপস্থিতি এত বেশী যে তা নিয়ে একটি মোটা বই লিখা যাবে।