মুক্তির তারিখ: ২৮ ডিসেম্বর ২০১২
চিত্রনাট্য, সম্পাদনা ও পরিচালনা : মাসুদ আখন্দ
চিত্রগ্রহণ : সাইফুল শাহীন
সঙ্গীত : ইমন সাহা ও এরশাদ ওয়াহিদ
প্রযোজনা : ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
অভিনয়ে: জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মাসুদ আকন্দ, কল্যাণ কোরাইয়া, বন্যা মির্জা, সায়না আমিন, উপমা, শামীমা নাজনীন, জুয়েল রানা প্রমুখ
নতুন বছরের প্রথম দিনটি শুরু হলো আমার অফিস ফাঁকি দিয়ে। পাঁচ সহকর্মী মিলে বলাকায় পিতা দেখে আসলাম । আগামী বছরটা বুঝি আমার ছবি দেখতে দেখতেই যাবে! সাধারনত সকাল থেকে দুপুর এই সময়টাতে হলগুলোতে দর্শক খুব কম হয়। কিন্তু অবাক হলাম বলাকায় ভীড় দেখে। মোটামুটি অনেক দর্শক লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে হলে ঢুকছে সিনেমা দেখার জন্য। না পিতা দেখার জন্য নয়, চোরাবালিতে আটকে যাবার জন্য। বলাকা-২ তে ঢুকে পুরা বেকুব বনে গেলাম। আমরা পাঁচজন ছাড়া আর কোন দর্শক নেই! সাড়ে বারোটার শো শুরু হলো আরো মিনিট দশেক পর। অবশ্য ইতোমধ্যে আরো কিছু দর্শক এসে জুটেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা সর্বসাকুল্যে জনা বিশেক দর্শক বলাকা-২ সিনেমা হলটিকে নিজের বাসার ড্রইংরুম বানিয়ে ছবিটা দেখা শেষ করলাম।
পিতা মুক্তিযুদ্ধের ছবি। চলচ্চিত্রটির কাহিনি গড়ে উঠেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুপ্রধান প্রত্যন্ত একটি গ্রামের দুই দিনের ঘটনা নিয়ে । যে গ্রামটিতে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তাপের ছোঁয়া লাগেনি। সেখানকার মানুষ ভালো করে জানেইনা যে স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আচমকা পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালায় গ্রামটিতে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে ঘর-বাড়ি, নির্বিচারে হত্যা করে গ্রামবাসীদের বিশেষ করে হিন্দুদের, তুলে নিয়ে যায় যুবতী নারীদের। আর পাক হানাদারদের সঙ্গ দেয় তাদের দোসর কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী রাজাকার। সেই গ্রামেরই হিন্দু ঘরে বেড়ে ওঠা এক মুসলিম ব্যক্তি যিনি চার সন্তানের পিতা, পাকি জুলুমের বিরুদ্ধে একলাই যুদ্ধ ঘোষণা করেন। নিজের সন্তানদের রক্ষায় দা-বল্লম-তীর ধনুকের মত দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকি হায়েনাদের বিরুদ্ধে।
পরিচালক একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, তিনি তার বাবার আদলেই পিতা ছবিটির চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। বাবাকে তিনি যে কয়টি রূপে দেখেছেন, সে অনুযায়ী বেশ কয়েকটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন এই চলচ্চিত্রে। পরে প্রেক্ষাপট হিসেবে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধকে । তাই মূল চরিত্রের পিতা জলিল ছাড়াও আমরা পিতা হিসেবে পাই বিপিনকে যিনি ছেলের জীবন রক্ষার জন্য পাক বাহিনীর কাছে মুসলমানের কালেমা বলতে দ্বিধা করেননা। আমার পাই জলিলের পালক পিতাকে যিনি হিন্দু হয়েও এতিম জলিলকে লালন পালন করেছেন। নি:সন্তান এই পিতা মৃত্যুর আগে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে যান মুসলমান হওয়া স্বত্ত্বেও জলিলই যেন তার মুখাগ্নি করে। আমরা দেখি তরুন পিতা শরৎকে যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করে তার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের জীবন। পরিচালক বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে পিতাকে সত্যিকার অর্থেই বৃহৎ আকারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ছবিটির বেশ কিছু দৃশ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক যা চলচ্চিত্রটির একটি ইতিবাচক দিক। চলচ্চিত্রটির শর্মিলী চরিত্রটি পুরো ছবি জুড়েই অসাম্প্রদায়িকতা নীতি লালন করে। ছবিতে শর্মিলীর 'হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিয়া হয় না কেন?' এই সংলাপটি যেন হাহাকারের মত শোনায় । আমাদেরকে বিবেকের তাড়নায় দংশিত করে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের নীচতা আর হীনতা, আমাদের বিভেদকে। ছবিটিতে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনার খোরাক রয়েছে।
ছবিটির প্রথমাংশে গ্রামটিতে পাক হানাদারদের হামলা হওয়ার আগের দিনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়। যদিও প্রথমদিকে গ্রামের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট গল্পগুলো শুনতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু পরিচালক গ্রামীণ সমাজের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে এত সময়ক্ষেপন করেছেন যে শেষ পর্যন্ত তা বিরক্তির উদ্রেক করে। দর্শকদের ধৈর্য্য পরীক্ষা নিয়ে অর্ধেকেরও বেশি সময় পর ছবিটি মূল কাহিনীতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। ইচ্ছে করলে এই সময়টুকু কমানো যেত। তাতে ছবির দৈর্ঘ্য কমলেও ছবির আবেদন আরো মজবুত হতো।
ছবির ক্যামেরার কাজ সর্বোপরি ভালো লেগেছে। কিছু কিছু জায়গায় দারুন লেগেছে। সূর্যাস্তের সময় ঠাকুরদার নাতিকে নিয়ে ধর্মীয় গান গাওয়ার দৃশ্যটি ছিলো খুবই সুন্দর। ছবির ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে রক্ত ছড়িয়ে পড়ার অংশগুলো ছিলো খুবই বাজে। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার দৃশ্যগুলোও জমেনি। তবে ছবির দ্বিতীয় বা শেষাংশে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোই ছবিটাকে উপভোগ্য করে তুলেছে। পিতার প্রতিশোধ নেওয়ার অংশটুকু প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত দর্শকদের দারুন আন্দোলিত করেছে।
ছবিটির সবচেয়ে ভালো অংশ হচ্ছে অভিনয়। আলাদাভাবে উল্লেখ করার মত কেউ অভিনয় দেখাতে না পারলেও কেউ খারাপ অভিনয় করেননি। প্রায় প্রতিটি চরিত্রের অভিনয়ে পেশাদারিত্বের ছাপ চোখে পড়ে। তবে পিতা চরিত্রে মাসুদ আকন্দের চাহনি আর মুখভঙ্গি দুর্দান্ত লেগেছে। যে এক্সপ্রেশন দিয়ে পাক হানাদারদের প্রতি তীব্র ক্রোধ আর ঘৃণা প্রকাশ করা দরকার তিনি একদম সেটাই করে দেখিয়েছেন। আর পাকিস্তানি কমান্ডারের চরিত্রে মইনকে দারুন মানিয়েছে।
ছবির গানগুলো বেশ ভালো। বিশেষ করে সূচণা সঙ্গীতে সায়ানের 'এইবার এইবার' গানটি খুব ভালো লাগলো। অন্য গানগুলো চলনসই। কিন্তু প্রত্যেকটি গানের চিত্রায়ণ ছিলো অপ্রয়োজনীয় যা চলচ্চিত্রটিকে শুধু দীর্ঘায়িত করেছে শোভাবর্ধন করেনি। প্রত্যেকটি গানের কিছু অংশ দেখালে বা দু-একটা গান কম হলে বরং ভালো লাগতো। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে আবহ সঙ্গীত প্রয়োজনীয় সিচুয়েশন ক্রিয়েট করতে সক্ষম হয়নি। আরো আকর্ষণীয় হওয়া দরকার ছিলো। আর সাউন্ড ও প্রজেকশনের কিছু কিছু জায়গায় বেশ ভালো সমস্যা ছিলো। কস্টিউম বেশ কিছু জায়গায় সময়োপযোগী হয়নি। বিশেষ করে নারী চরিত্রের কস্টিউমে অসংলগ্নতা চোখে পড়লো বেশি।
শেষ পর্যন্ত চমৎকার একটি স্টোরিলাইনের ছবি অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে সুনির্মাণের অভাবে। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি ছবির অপমৃত্যু ঘটেছে কাহিনীকে অহেতুক টেনে লম্বা করার প্রয়াস, কারিগরী ত্রুটি আর অপরিপক্ক নির্মাণকৌশলের কারণে। ছবিটি নির্মাণে পরিচালককে বেশ অগোছালো লেগেছে। তাই অনেক ভালো একটি ছবির স্বপ্ন দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত পিতা বেশ হতাশ করেছে।
যদিও নির্মানশৈলীর কথা বিবেচনা করলে মুক্তিযুদ্ধের উপর এর চেয়ে ঢের ভালো ছবি পূর্বে নির্মিত হয়েছে। তবে শিল্পের গুণগত মান, কারগিরী সফলতা ইত্যাদি চাহিদা তেমন একটা পূরণ করতে না পারলেও পিতা মুক্তিযুদ্ধের আবেগটাকে বেশ শক্তিশালীভাবেই ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে আবেগের এই জায়গাটা ফেলনা নয় মোটেও। তাই সবারই ছবিটা অবশ্যই দেখা উচিত। আমার এক সহকর্মী হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, এ ধরনের ছবি দেশের প্রত্যেকটি জায়গায় শিশুদের পিতা-মাতাসহ বাধ্যতামূলকভাবে দেখানো উচিত। আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সব ছবির ক্ষেত্রেই এ কথাটি প্রযোজ্য। উনি অবশ্য মজা করে আরেকটা কথা বললেন, পিতা না দেখলে চোরাবালি দেখতে দেয়া হবেনা এই মর্মে রুল জারি করা হোক। বলাকাতে পিতা দেখার পরই সবাই চোরাবালির টিকিট হাতে পাবে। মজা করে কথাটা বললেও খুবই দু:খজনক ব্যাপার মুক্তিযুদ্ধের ছবি দর্শক দেখছেনা। দায়ভার অনেকটাই চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা এবং পিতার পরিচালককে নিতে হবে। কারণ তারা চলচ্চিত্রটির তেমন কোন প্রচারনা চালাননি যেখানে হালের মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবিগুলো প্রচারনা পরিকল্পনা দুর্দান্ত। তারপরও মাসুদ আকন্দকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। পরবর্তী ছবিতে তিনি নিশ্চয়ই এ ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং আমাদেরকে দারুন কোন চলচ্চিত্র উপহার দিবেন।
পিতা চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ মার্কেটের বলাকা, মালিবাগের সুরমা, সেনানিবাসের শাহিন এবং গাজিপুরের বর্ষা প্রেক্ষাগৃহে। ভালো-মন্দের বিচার পরে, শিল্পমান উত্তীর্ণ কিনা সে হিসাবটাও না হয় পরে কষলাম। আগে আসুন জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত পিতা ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখি।
________________________________________________
'*চোরাবালি' দিয়েই শুরু হোক চোরাবালি থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের উত্তরন*
**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**