রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ফরাসী ফিল্মমেকার Costa-Gavras (কোস্তা গাভরাস) একটি সেরা নাম। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালে, গ্রীসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাঁর বাবাকে কমিউনিস্ট সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। পিতার রাজনৈতিক জীবন পুত্রের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীসের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হারান কোস্তা। আমেরিকায় ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আবেদন করেও ব্যর্থ হন। তাই হাই স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন এবং আইন বিষয়ে পড়তে শুরু করেন। চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ থাকায় তিনি আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পিতার অতীত ইতিহাসের জন্য এখানেও তাঁকে চরমভাবে মুল্য দিতে হয়। আমেরিকান ফিল্ম স্কুলগুলো তাঁকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৫৬ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হন। এরপর তিনি পর্যায়ক্রমে ফরাসী পরিচালক Yves Allégret, Jean Giono এবং René Clair এর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন The Sleeping Car Murders (French title: Compartiment tueurs) । মিস্ট্রি-থ্রিলার-সাসপেন্স ঘরানার ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কোস্তা-গাভরাস ধীরে ধীরে নিজেকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রায় ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি বিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, জিতে নিয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মানজনক পুরষ্কার।
২০০৯ সালে গার্ডিয়ানে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে কোস্তা-গাভরাস চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর দর্শন অভিহিত করেন এভাবে-
All cinema is political, even action movies showing "heroes saving the Earth only with a gun".
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত দুটো চলচ্চিত্র হচ্ছে Z এবং Missing
Z (1969)
Country: Algeria, France
Director: Costa-Gavras
Stars:Yves Montand, Irene Papas and Jean-Louis Trintignant
জেড সর্বকালের অন্যতম সেরা পলিটিক্যাল ড্রামা ফিল্ম হিসেবে স্বীকৃত। তৎকালীন গ্রীসের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নিয়ে নির্মিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রটি। ছবির নামটি নেওয়া হয়েছে একটি প্রচলিত গ্রীক স্লোগান থেকে । Z এর মানে হচ্ছে He Lives। ১৯৬৩ সালে বামপন্থী গ্রীক রাজনীতিবিদ Grigoris Lambrakis প্রকাশ্যে আততায়ীর হাতে নিহত হন। চরমপন্থীদের মদতে তাদের দুজন কর্মী খুনের কাজটি সমাধা করলেও এ ঘটনার নেপথ্যে ছিলো চিফ অফ পুলিশ সহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন হর্তা-কর্তারা। তদন্ত শুরু হলে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। তদন্ত কমিটির প্রধানকেও সত্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য ভীতি ও চাপ প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু তিনি পিছু না হটে সত্যকে প্রকাশ করেন। যার ফলে তৎকালীন সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনের তারিখ যখন ঠিক, তখনও সবার ধারণা ছিলো বাম রাজনীতি সমর্থনপুষ্ট দলটি নির্বাচনে জয়লাভ করবে । ঠিক সে সময় অতর্কিত অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গ্রীক সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। রাজনীতিবিদ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের বেশিরভাগই সেনাবাহিনীর সহায়তায় পার পেয়ে যায়। ধারনা করা হয়ে থাকে গ্রীসের তৎকালীন এই রাজনৈতিক সংকটে কূট চাল চেলেছিলো আমেরিকা। কোন প্রমাণ না থাকায় গ্রীসের সাধারন নাগরিকদের কাছে বিষয়টি একটি অমীমাংসিত রহস্যই রয়ে যায়।
কোস্তা-গাভরাস যখন চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তখন গ্রীসে সামরিক শাসন চলছিলো। তাই পরিচালককে ছবিটি নির্মাণে অত্যন্ত সাহসীকতার পরিচয় দিতে হয়েছে। তিনি দুর্দান্তভাবে চলচ্চিত্রটির গল্প ও চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। রাজনীতিবিদের হত্যার পুরো ঘটনাটি তিনি যেভাবে বাস্তবসম্মতভাবে সেলুলয়েডে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তদন্ত কমিটির প্রধান বা বিচারপতি চরিত্রে Jean-Louis Trintignant অসাধারন সাবলীল অভিনয় করেছেন। ইউরোপীয়ান অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে ফ্রেঞ্চ ও ইতালীয় অভিনেতাদের বড় একটি গুণ তাদের সাবলীলতা ও চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার প্রবণতা। Trintignant সেটাই করে দেখিয়েছেন। ছবিটি দেখার জন্য রাজনৈতিক মারপ্যাচ বোঝার দরকার নেই। কারন পরিচালক প্রতিটি ঘটনা ও তার নেপথ্যের ঘটনাটি একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ছবিতে ক্যামেরা চালিয়েছেন Raoul Coutard যিনি ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। চলচ্চিত্রটি দেখে একটা কথাই মনে হয়েছে নিখুঁত চলচ্চিত্র বুঝি একই বলে! কাহিনী-চিত্রনাট্য-নির্মাণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিলো দারুন মুন্সীয়ানার ছাপ।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বলেছেন
Z is at the same time a political cry of rage and a brilliant suspense thriller. It even ends in a chase: Not through the streets but through a maze of facts, alibis and official corruption.
*চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা বিভাগে অস্কার জিতে নেয়। এছাড়া আরো তিনটি বিভাগে মনোনয়ন পায় (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য)।
*চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার জিতে নেয়।
*কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (Jean-Louis Trintignant) এবং জুরি প্রাইজ (Costa-Gavras ) জিতে নেয় এবং পাম ডি'অর এর জন্য মনোনয়ন পায়
আইএমডিবি
টরেন্ট লিংক
Missing (1982)
Country: United States
Director: Costa-Gavras
Stars: Jack Lemmon, Sissy Spacek
সত্য ঘটনা অবলম্বনে কোস্তা-গাভরাসের আরেকটি মাস্টারপীস পলিটিক্যাল ড্রামা। চলচ্চিত্রটি Thomas Hauser এর The Execution of Charles Horman: An American Sacrifice (1978) গ্রন্থ অবলম্বনে নির্মিত। ১৯৭৩ সালে ল্যাটিন আমেরিকার চিলিতে সামরিক অভ্যূত্থান সংঘটিত হয় । চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে কে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল অগাস্টো পিনোসে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি কমিউনিস্ট বা বামপন্থী বিরোধী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অভ্যুত্থানে সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করা হয়। এই অভ্যুত্থানের সময় মার্কিন এক সাংবাদিকের নিখোঁজ হওয়ার সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে মিসিং চলচ্চিত্রটি।
মার্কিন সাংবাদিক চার্লস হরমান চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সস্ত্রীক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের কারনে রাজনৈতিক কোন কূটচালে না জড়িয়েও চার্লস জেনে ফেলেন অভ্যুত্থানের নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ফলশ্রুতিতে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। আমেরিকা থেকে ছেলের খোঁজে চলে আসেন বাবা এডমুন্ড হরমান। স্ত্রী আর বাবা মিলে খুঁজতে থাকে চার্লসকে। ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে তারা জেনে ফেলেন অভ্যুত্থানের হোতা ছিল সিআইএ!
ছবিটিতে মার্কিনিদের চিরচেনা সেই মোড়ল স্বভাবেরই বহি:প্রকাশ ঘটেছে। কোন দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে এ দেশটির যেন নাক না গলালেই নয়! এই একটা দেশ বিশ্বব্যাপী কত না অপকর্মের হোতা! এডমুন্ড হরমান মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে মামলা করেছিলেন। মামলার আসামীর তালিকায় ছিলেন স্বয়ং হেনরি কিসিঞ্জার। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই মামলার কোন নিষ্পত্তি হয়নি।
এ ছবিতে চার্লসের স্ত্রী চরিত্রে সিসি স্পেসেইক এবং বাবার চরিত্রে জ্যাক লেমন পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। পিতা আর পুত্রবধূ দু'জনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দিয়ে চার্লস হরম্যানকে খুঁজে ফেরার যাত্রা শুরু হয়। এই যাত্রায় পদে পদে নাজেহাল হতে হয় তাদের। প্রতি মূহুর্তে সম্মুখীন হতে হয় রাজনৈতিক মারপ্যাচের ।কিন্তু প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পাবার আশায় তারা সব মুখ বুঝে সহ্য করেন। আমেরিকান এম্বেসি থেকে যথাযথ সহয়তা না পেয়ে নিজেরাই অচেনা একটি শহরে অজানা বিপদকে সঙ্গী করে ছুটতে থাকেন কারাগার-শরণার্থী ক্যাম্প-হাসপাতালের মর্গ থেকে নানা জায়গায়। মর্গে বেনামী লাশের পর লাশ পরে থাকার দৃশ্য দেখে বেথ আর এডমুন্ডের মত দর্শকরাও শিউড়ে উঠবে। তাদের কাতরতা স্পর্শ করবে দর্শকদের। এ ছবিটির আরো বেশ কিছু দৃশ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে তাজা করে তুলবে। হঠাৎ কার্ফুতে আটকে পড়া কর্মজীবী মানুষ, গোলাবর্ষণের মধ্যে আতংকিত মানুষের ছুটাছুটি, যানবাহন থামিয়ে সিকিউরিটি চেকের নামে যাকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া, রাস্তায় যত্রতত্র লাশ পড়ে থাকার দৃশ্যগুলো মনে করিয়ে দিবে একাত্তরের বিভীষিকার কথা। ছবিটি দেখতে দেখতে বারবার মনে হবে মানুষের বিবেক কোথায় হারিয়েছে? মানুষ এত নির্মম- নিষ্ঠুর হয় কী করে?
পুত্রবধূকে প্রতিনিয়ত সান্ত্বনা ও শক্তি যোগাতে থাকা এডমুন্ড যখন বিশাল স্টেডিয়ামে মাইক্রোফোন হাতে ছেলেকে সম্বোধন করতে চায়, তার কন্ঠ ব্যর্থ হয়। তিনি পিতৃত্বের কাছে সকল শক্তি হারান। হঠাৎ ছেলের মত কাউকে দেখেতে পেয়ে তার নাম ধরে চিৎকার করতে করতে এডমুন্ডের ছুটে যাওয়া যেন পিতৃত্বের শাশ্বত ভালোবাসার প্রতীক। যে সন্তানের প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে দূরে সরেছিলেন সেই ছেলেকেই তিনি আবিষ্কার করেন নিজের আরেকটি স্বত্ত্বা হিসেবে। পুত্রবধূর প্রতি ক্ষোভ থাকেনা আর। সেখানে জায়গা করে নেয় আকুন্ঠ মমতা। তাই তীব্র হতাশাবোধের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও আবার নতুন করে সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় বুক বাঁধেন। পরিচালক চার্লসের বাবা ও তার পুত্রবধূর মধ্যে সম্পর্কটি খুব চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
চলচ্চিত্রটি চিলিতে নিষিদ্ধ করা হয় যদিও ছবিতে সরাসরি চিলির কোন উল্লেখ নেই। শুধু চিলির দুটো শহর ভিনা আর সান্তিয়াগোতে কাহিনী বিস্তার ঘটেছে। ছবির পুরো শুটিং চরম গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে মেক্সিকোতে সম্পন্ন হয় ।
*চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য বিভাগে অস্কার জয় করে এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে মনোনয়ন পায়।
*কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পাম ডি'অর পুরষ্কার এবং এবং জ্যাক লেমন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার জিতে নেয়।
আইএমডিবি
টরেন্ট লিংক
____________________________________________
**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**
_____________________________________________
পোস্ট উৎসর্গ:
ফেলুদার চারমিনার - প্রিয় বন্ধু-সহপাঠী-সহব্লগার
এ পোস্টটা আমি ফেলুর মত করে লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছবির পর্যালোচনা অংশে এসে ফেল মেরে গেছি।