দড়ির মতো পেশি নিয়ে লিকলিকে একজন মানুষ শুইয়ে ফেলছে পুরো এক ঝাক ষন্ডামার্কা গুন্ডাকে। সরল কিন্তু ক্ষুরধার চাহনি, সঙ্গে অদ্ভূত এক কৌশল প্রয়োগ করছে লোকটা! রূপালি পর্দায় লোকটার কান্ডকীর্তি দেখে সবাই ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। স্বকীয় একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সময় লাগেনি তাঁর। খুব অল্প সময়েই এশিয়ায় সুপারস্টার হয়ে উঠেন পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চির এই হ্যাংলা যুবক। যার ধ্যান জ্ঞান মার্শাল আর্ট।
সেই মার্শাল আর্ট সুপারস্টার প্রায় চার দশক আগে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু আজও তিনি এক ও অদ্বিতীয়- ব্রুস লি। একাধারে একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্য রচয়িতা, শিক্ষক, দার্শনিক এবং ‘জিৎ কুনে দো’ নামক নতুন ধরনের মার্শাল আর্ট এর প্রতিষ্ঠাতা; তাকে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালি মার্শাল আর্ট শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টকে উপজীব্য করে যে ধারার সূচনা ঘটে তার রূপকার ব্রুস লি।
ব্রুস লির জন্ম ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর। পুরো নাম ব্রুস ইয়ুন ফান লি । জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে হলেও গায়ে বইছিলো চীনা রক্ত। শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে হংকংয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সিনেমা ও টিভিতে শিশু শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। বারো বছর বয়সে একদিন রাস্তার কিছু বখাটে ছেলে শত্রুতাবশত তাকে মারধর করে। আর এ ঘটনাটাই আমুলে পাল্টে দেয় তার জীবন, সেই সঙ্গে মার্শাল আর্ট আর বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতও। পরবর্তী সময়ে মনপ্রাণ ঢেলে মার্শাল আর্টে তালিম নেন তিনি। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আয়ু মাত্র পাঁচ বছর। এই শিল্পে যোগ করেন নিজস্ব ধাঁচের কুংফু কৌশল। মার্শাল আর্টের সঙ্গে আরো অনেক শারীরিক কলা জুড়ে দিয়ে তৈয়ার করেন নতুন আর্ট ‘জিৎ কুনে দো’। নাচে দক্ষ লি ১৮ বছর বয়সে জাতীয় প্রতিযোগিতায় হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহি চা-চা নাচের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
এই জিনিয়াসের মেজাজটা ছিলো বেশ কড়া । সে কারনে বেশ কয়েকবার হংকং পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই বাবা-মা তাঁকে পাঠিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রে । ১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের চায়নাটাউনে আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন। কদিন বাদেই তিনি ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এসে দর্শনশাস্ত্রে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। জীবনে আসে প্রেম লিন্ডা এমেরি, যিনি পরবর্তীতে সহধর্মিণী। সিয়াটলেই তিনি তাঁর প্রথম কুংফু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় লি টিভিতে টুকটাক কাজ করতে থাকেন। ক্যালফোনির্য়ার ওকল্যান্ডে তিনি দ্বিতীয় কুংফু স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। টিভিতে কাজ করার সুবাদে তার নাম ডাক হতে শুরু করে এবং তিনি আস্তে আস্তে হলিউডের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেখানে স্ট্যান্টম্যান ও পার্শ্বচরিত্রে কিছু কাজও করেন। সেভাবে নজর কাড়তে না পারলেও আর্থিকভাবে লাভবান হন। ফিরে আসেন হংকংয়ে। হংকংয়ে বেশ কয়েকটি ছবি নির্মিত হয় তাকে নিয়ে। দি বিগ বস (১৯৭১), ফিস্ট অফ ফিউরি (১৯৭২) ও দি ওয়ে অব দ্য ড্রাগন (১৯৭২) তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাতারাতি সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে যায় তাঁকে নিয়ে। হলিউডে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ (১৯৭৩)। হলিউডে ব্রুস লি তখন এক সিনেমা দিয়েই বিশাল তারকা।
সারা বিশ্ব যখন কাঁপছে ব্রুস লি জ্বরে, এন্টার দ্য ড্রাগনের প্রিমিয়ারের কিছুদিন আগে হঠাৎ হংকংয়ে মারা যান ব্রুস লি। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৩২ বছর বয়সে। তাঁর মৃত্যু রহস্য আজও অমিমাংসিত। কেউ বলে ড্রাগ ওভারডোজ, কেউ বলে বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো।
মারা যাওযার এক বছরের মধ্যেই সিনেমায় নেমে পড়েন একগাদা নকল ব্রুস লি, যারা অল্প-বিস্তর মার্শাল আর্ট জানতেন। ব্রুস লি, ব্রুস লে, ড্রাগন লি সবাই মিলে এমন এক নকল ধারা তৈরি করেছিলেন যে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা সেই ধারার নাম রাখলেন ‘ব্রুস এক্সপ্লোটেশন’। ব্রুস লির নাম বেচে খাওয়া এসব সিনেমার বেশির ভাগই ছিল কম বাজেটের নিম্ন গ্রেডের সিনেমা। এর পরপরই আবির্ভাব ঘটে জ্যাকি চ্যান ও জেট লি'দের এবং সিনেমায় নতুন মার্শাল আর্টের প্রচলন ঘটে।
ব্রুস লি'র পরপরই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন জ্যাকি চ্যান ও জেট লি। তার আগে এক চলচ্চিত্র জ্যাকির ঘাড় মটকে দিচ্ছেন ব্রুস।
ভক্তদের কাছে ব্রুস লি এখনো মার্শাল আর্ট আইকন যিনি চলচ্চিত্রে আসার আগ পর্যন্ত মার্শাল আর্ট ছিল স্কুলের গণ্ডির ভেতর। মার্শাল আর্টকে উপজীব্য করে নির্মিত তাঁর সিনেমাগুলো আজও চুটিয়ে ব্যবসা করছে। তিনিই প্রথম চীনাদের প্রতি হলিউডের প্রচলিত ধারণা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। গোটা এশিয়ার তরুণদের দেখিয়েছেন নতুন স্বপ্ন। শিখিয়েছেন ঐতিহ্যবাহি মার্শাল আর্ট নিয়ে গর্ব করতে। শিখিয়েছেন মার্শাল আর্ট শুধু মারামারির বিদ্যা নয়- এর মধ্যে আছে দর্শন, কঠোর শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাস, অ্যারোবিক্স, এমনকি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে মাংসপেশীর গঠনকৌশল।
'জিৎ কুনে দো’-তে লি মারামারির নানা কৌশলকে এই জায়গায় একত্রিত করেছেন। এ পদ্ধতি জীবন বাঁচানোর দার্শনিক পদ্ধতিও বটে। বর্তমানে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রুস লি উদ্বাবিত এই পদ্ধতি পড়ানো হয়! দেশ, জাতি, সমাজে তার কাজ কল্পনাতীত প্রভাব ফেলছে। শুধু মার্শাল আর্ট শিল্পী আর চলচ্চিত্র অভিনেতারাই নন সঙ্গীত শিল্পী, বক্সার, নৃত্যশিল্পী, কমেডিয়ান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের অনুপ্রেরণা ছিলেন ব্রুস লি। ‘মিশন ইম্পসিবল ২, ফেস অফ, ব্রোকেন অ্যারো’ খ্যাত সিনেমা নির্মাতা জন উ স্বীকার করেই নিয়েছেন ব্রুস লি না জন্মালে কম্মিনকালেও তার ফিল্ম বানানো হত না। আরেক মার্শাল আর্ট সুপার স্টার জ্যাকি চ্যানের ভাষ্য, ‘আমি কখনো ব্রুস লি হতে হতে চাইনি। আমি জ্যাকি চ্যানই হতে চেয়েছিলাম। কারন ব্রুস লি হওয়া সম্ভব নয়। ব্রুস লি একজনই এবং সে সবার সেরা’। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও তিনি প্রভাববিস্তারকারি, যদিও এসবের কোন কিছুতেই ব্রুস লির সরাসরি অংশগ্রহণ ছিলোনা। বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে তিনি ছিলেন আইডল, তাদের চেতনায় ব্রুস লি অবিসংবাদিত নেতা, তাদের পথপ্রদর্শক। তাই ব্রুস লি শুধুই চীনের প্রতীক নন। তিনি সর্বজনীন ।
বিশ্বব্যাপী ভক্তরাও লিকে স্মরণে রাখতে নিয়েছেন নানা ব্যবস্থা। ২০০৬ সালে হংকংয়ে ব্রুস লির স্মৃতির উদ্দেশ্যে ব্রোঞ্জের একটা মূর্তি স্থাপন করা হয়। মৃত্যুর ৩৭ বছর পর তাঁর ঠাই হয় মাদাম তুসোর জাদুঘরে। ২০০৫ সালে বসনিয়ার মোসতার শহরে ব্রুস লির প্রমাণ আকৃতির একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। কেননা দেশটির দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে জাতিগত দ্বন্দ্ব দূর করতে ব্রুস লির অবদান ছিল অনন্য। দক্ষিণ চীনের শুনদে প্রদেশের একটি পুরনো চায়ের দোকান ঘিরে তৈরি হয়েছে ব্রুস লি জাদুঘর। ব্রুস লির শৈশব কেটেছিল সেখানেই। শুনদে শহরে একটি ব্রুস লি থিম পার্কও আছে। প্রিন্ট ও ভিজুয়াল মিডিয়াতেও ব্রুস লির জয়জয়কার। ব্রুস লির জীবন নিয়ে ১৯৭৪ সালে লেখা ‘দ্য লিজেন্ড অব ব্রুস লি’ অবলম্বনে ২০০৮ সালে সিসিটিভি তৈরি করেছিল ৫০ পর্বের প্রামাণ্যচিত্র। ১৯৯৩ সালে হলিউডের পরিচালক রব কোহেন তৈরি করেছিলেন ‘ড্রাগন : দ্য ব্রুস লি স্টোরি’। তাতে ব্রুস লির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জ্যাসন স্কট লি। অবশ্য এই দুই লিয়ের মাঝে পারিবারিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। এক কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত সিনেমাটি আয় করেছিল সাড়ে তিন কোটি ডলার। তার ৩৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের হিস্ট্রি চ্যানেল ব্রুস লিকে নিয়ে দুই ঘণ্টার একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে যার নাম ‘হাউ ব্রুস লি চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’। ব্রুস লির স্ত্রি লিন্ডা লির প্রতিষ্ঠান কনকর্ড মুন ব্রুস লিকে নিয়ে তৈরি করতে যাচ্ছে বিশেষ স্পেশাল ইফেক্ট সিনেমা, অ্যানিমেশন মুভি, টিভি সিরিজ ও একটি ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল শো। বাবার সম্পত্তিকে ভোগে উড়িয়ে না দিয়ে ও তার স্মৃতি রক্ষার্থে মেয়ে শ্যানন লি ‘ব্রুস লি অ্যাকশন মিউজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছেন যা এখন নির্মাণাধিন। ব্রুস লিকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে অনেক ভিডিও গেম, বিজ্ঞাপনচিত্র আর ব্র্যান্ড প্রমোশনাল প্রোডাক্ট।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসেই লি আবার পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হন । তার একটি কোট নিলামে ৭৭ হাজার মার্কিন ডলার বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা! হংকংয়ে অনুষ্ঠিত নিলামে প্রত্যাশিত মূল্যের ৯ গুণ বেশি দামে কোটটি কিনে নিয়েছেন মার্কিন দম্পতি সিলভানা এবং গ্রেগ ম্যানিং। পশুর লোমের তৈরি এই কোটটি ব্রুস লি পরেছিলেন ১৯৭৩ সালে ‘গেম অফ ডেথ’ ছবির শুটিংয়ের সময়। ছবিটির কাজ অসমাপ্তই রেখেই অন্য ভুবনে চলে যান তিনি। এই কোটটি পরেই মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ ছবির হংকং প্রিমিয়ারে উপস্থিত হয়েছিলেন ব্রুস লি। অংশ নিয়েছিলেন ফটোশুটেও।
২০০০ সালে জন লিটলের পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য ওয়ারিয়রস জার্নি’তে ব্রুস লিকে বলতে শোনা গেছে‘, সবার মতো তুমিও জেতার কৌশল শিখতে চাও; কিন্তু হার স্বীকার করতে জানলে, মরতে শিখলে তুমি মুক্তি পাবেই। এগুলোকে স্বীকার করে নিলেই তুমি মুক্তভাবে ছুটতে পারবে, ভেতরে ছন্দ তৈরি করতে পারবে। তারল্যই একটি সরল মনের একমাত্র পথ। এজন্য তোমাকে অবশ্যই উচ্চাভিলাষী মনকে মুক্ত করতে হবে এবং শিখতে হবে মৃত্যুর কলা।’
(রাজনৈতিকে প্রকাশিত)
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা
_____________________________________________
**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**