সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের জন্য রোমান পোলানস্কির জুড়ি মেলা ভার। ‘দি অ্যাপার্টমেন্ট ট্রিলজি’ এর ছবিগুলো-রিপালসন, রোজমেরি’জ বেবি আর দি টিনেন্ট তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পোলানস্কির প্রথম দিককার ছবি হলেও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তার জাত চিনতে কারো ভুল হয়নি। টানটান উত্তেজনা পূর্ণ পরিবেশ সঙ্গে নিখুঁত পরিবেশনা পোলানস্কির থ্রিলার ছবিগুলো শুধু এই গন্ডির মাঝেই থেমে থাকেনি। পোলানস্কি সিনেমায় দৃশ্যকল্পের সহায়তা নিতেন বেশি। টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য আজগুবি কোন বিষয়ের দ্বারগ্রস্ত হতেন না। ছবিতে হ্যাপী এন্ডিং রাখার ব্যাপারে তার যথেষ্ট অনাগ্রহ ছিলো। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো তুলে ধরে শেষ মেষ একটা রায়ে চলে আসা বা সমাধান দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না কখনই। মানুষের মনকে আর যাই হোক কোন সূত্র বা গন্ডির মাঝে সীমাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। আর মানুষ ভেদেই ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। আর সৃষ্টির সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয়ের নাম মানুষের মন।
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা মনে করেন আশ্চর্যজনকভাবে পোলানস্কির এই ট্রিলজিটির প্রভাব তার জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পড়েছে। কোন ক্ষেত্রে পূর্বের কোন ঘটনার ছাপ রেখে গেছে ট্রিলজির কোন একটি পর্বে। আবার কোন ক্ষেত্রে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরে তার জীবনে ঘটে অনাকাঙ্খিত ঘটনা যা তার এই চলচ্চিত্রগুলোতে উঠে এসেছিলো।
Repulsion (1965)
Stars:
Catherine Deneuve, Ian Hendry and John Fraser
বেলজিয়ান তরুনী ক্যারল জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছে লন্ডনে, তার বড় বোনের সঙ্গে। ক্যারল কাজ করে একটি বিউটি পার্লারে। বড় বোনটি বিবাহিত এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত । ক্যারল খুব নি:সঙ্গ। তার সবচেয়ে কাছের মানুষ বোনটি তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অনেক মিনতি করেও বোনটিকে আর কাছে পায়না ক্যারল। প্রেমিকের সঙ্গে ছুটিতে কাটাতে কিছুদিনের জন্য ইতালিতে যায় ক্যারলের বোন। একা একা অ্যাপার্টমেন্টে পড়ে থাকে ক্যারল। মানসিক বীকার দেখা দেয় তার মধ্যে। পুরুষকে অপছন্দ করার বিষয়টি রূপান্তরিত হয় ঘৃণায় । কেনই বা ঘৃণা করবেনা? পাশ্চাত্য সমাজও নারীর অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত করতে পরেনি। নানা বেড়াজালে নারী আবদ্ধ , শিকার যৌন ও মানসিক নির্যাতনের। আর নির্যানতনকারী বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে বোনের প্রেমিক বা স্বামী, রাস্তার বখাটে ছেলেগুলো আর ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকা কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকগুলোও যে বাদ পড়েনা! ভাবতে অবাক লাগে এরকম অসাধারন একটি চলচ্চিত্র যিনি বানালেন তিনিই নিজেই কিনা একজন নারী নির্যাতনকারী!!!
প্রবাস জীবনের নি:সঙ্গতাও উঠে এসেছে এ চলচ্চিত্রটিতে। এ চলচ্চিত্রটির টেকনিক্যাল দিকগুলো অনবদ্য। ফ্রেমিং, লাইটিং, লেন্সিং, ক্যামেরার কাজ আর নির্দেশনায় চলচ্চিত্রটিকে নিখুঁত মনে হয়েছে। ক্যারল চরিত্রে ক্যাথরিন ডেনেভু অসাধারন অভিনয় করেছেন। সংলাপ কম থাকা স্বত্ত্বেও শুধু অভিব্যক্তি দিয়েও যে দারুন অভিনয় সম্ভব ক্যাথরিন ডেনেভু এর অভিনয় থেকে সে সম্পর্কে একটা চমৎকার ধারণা তৈরি হয়।
আইএমডিবি
স্টেজেভু ডাউনলোড লিংক
Rosemary's Baby (1968)
Stars:
Mia Farrow, John Cassavetes and Ruth Gordon
রোজমেরি আর জন-এই নব দম্পতি অনেক দেখে শুনে নতুন একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠে। মূলত রোজমেরির অ্যাপার্টমেন্টটি এতই ভালো লেগে যায় যে খরচ বেশি হলেও জন উঠতে রাজি হয়। জন একজন মঞ্চ-বেতার-টিভি কর্মী। সবকিছু ভালোই চলছিলো কিন্তু একদিন বিল্ডিংয়ের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করে । মেয়েটির সঙ্গে রোজমেরির মাত্র সেদিন সকালেই পরিচয় হয়। সেই সূত্রেই পরিচয় ঘটে মেয়েটির অভিভাবকদের সঙ্গে। প্রতিবেশী হিসেবে তারা রোজমেরি ও জনের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। এরই মাঝে রোজমেরি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। এরপরই পাল্টে যেতে থাকে সব কিছু। কিছুদিন যেতেই রোজমেরি উপলব্ধি করে প্রতিবেশীরা লুসিফার বা শয়তানের উপাসক এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জন! তাকে নিয়ে যে একটি ষড়যন্ত্র চলছে রোজমেরি সেটি বুঝতে পারলেও কাউকে সে বিষয়টি বোঝাতে পারেনা। একটা পর্যায় রোজমেরি দ্বিধায় পড়ে যায় আসলে হচ্ছেটা কী? সত্যিই কী কোন ষড়যন্ত্র চলেছে না সবই তার মনের ভুল? অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে নিরাপদ আগমনের জন্যে এক মা যুদ্ধে নামে। এ ছবিতে সেই শাশ্বত সত্য- ‘মার কাছে সবার উপরে তার সন্তান’ একথাটিই ঘুরে ফিরে মনে হয়েছে।। মিয়া ফারো রোজমেরি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় দেখিয়েছেন।
একটি বিষয় উল্লেখ্য ১৯৬৯ সালে রেমান পোলানস্কির জীবনে অত্যন্ত মর্মান্তিক এক ঘটনা ঘটে। পোলনস্কির অন্ত:সত্বা স্ত্রী অভিনেত্রী শ্যারন টেইটকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী চার্লস ম্যানসনের অনুসারীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। চার্লস ম্যানসেনর অনুসারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেন তারা এ কাজটি করেছে? তাদের উত্তর ছিলো-
“I’m the devil, and I’m here to do the devil’s business.”
এ ঘটনার ঠিক এক বছর পর এই ছবিটি মুক্তি পায়। ম্যানসনরা এবার একটি পরিবারকে হত্যা করে। পরিবারের কর্ত্রীর নাম ধারণা করুন তো?
রোজমেরি!!!
আইএমডিবি
স্টেজেভু ডাউনলোড লিংক
The Tenant (1976)
Stars:
Roman Polanski, Isabelle Adjani and Melvyn Douglas
পোলানস্কিকে আমি ম্যান বিহাইন্ড দি স্ক্রীন বা বা মাস্টার মাইন্ড বিহাইন্ড দি স্ক্রিন হিসেবে দেখেছি। এবার দেখলাম পর্দার সামনে-অভিনেতা হিসেবে। ট্রিলজির আগের দুটো ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমরা দেখতে পাই নারীকে। নারীর মানসিক সমস্যাগুলো যেখানে চিহ্নিত হয় গূঢ়ভাবে। এ ছবিতে আক্রান্ত একজন পুরুষ।
ত্রকয়োস্কি নতুন একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যেখানে আগের ভাড়াটিয়া আত্মহত্যা করেছিলো। সাবেক ভাড়াটিয়াকে ছিলো একজন নারী এবং লেখক। এ অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে থাকতে প্রতিবেশীদের ব্যবহার আর অ্যাপার্টমেন্টে থাকার নিয়ম-কানুন দেখে তার ধারণা বদ্ধমূল হয় যে এই প্রতিবেশীরাই পরিকল্পিতভাবে আগের ভাড়াটিয়াকে আত্মহত্যা করতে প্রলুব্ধ করেছছিলো। এবার তাদের শিকার হতে চলেছে ত্রকয়োস্কি!
এ চলচ্চিত্রটিতে চার্চের একটি দৃশ্য রয়েছে যেটাকে অত্যন্ত অর্থবহ হিসেবে তুলনা করেছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। দৃশ্যটি ছিলো এমন-
অন্তেষ্ট্যক্রিয়া অনুষ্ঠানে চার্চে বসে আছেন ত্রকয়োস্কি। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে পেলেন বাচ্চা একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই মেয়েটির মা তাকে ডাকতেই সে মনযোগ দিলো ফাদারের বক্তব্যে। ত্রকয়োস্কি লক্ষ্য করলো একই সারিতে তার পরিচিত এক তরুণী বসে আছে। আস্তে আস্তে সে নিজের সারি পরবির্তন করে তরুনীটির কাছাকাছি একটি সারিতে গিয়ে বসলেন। তরুনীটি এক সময় তার দিকে ফিরে চাইলো। হালকা অভিবাদন বিনিময় হলো পরস্পরের মাঝে। মেয়েটি আবার মনযোগ দিলো অন্তেষ্ট্যক্রিয়া অনুষ্ঠানে। মেয়েটিকে দেখে খুশি হয়ে যাওয়া ত্রকয়োস্কি চোখ হঠাৎ আটকে গেলো যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ একটি ভাস্কর্যের দিকে। ভাস্কর্যটি তার মনে অদ্ভূত এক প্রভাব ফেলতে লাগলো। দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন ত্রকয়োস্কি । যীশুর মুখ যেন ইঙ্গিতে তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। ত্রকয়োস্কি আরো ঘাবড়ে গেলো। ছুটে পালাতে চাইলো চার্চ থেকে। কিন্তু চার্চের মূল ফটকটি বন্ধ । ত্রকয়োস্কি তখন তার পাগলপ্রায় দশা। অবশেষে ছোট্ট একটি দরজা দিয়ে সে পালিয়ে যেতে পারলো। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ত্রকয়োস্কি।
পোলানস্কির সেক্সুয়াল স্ক্যান্ডালের পর এ দৃশ্যটি নিয়ে ২৫ মিনিটের একটি প্রামান্য নির্মাণ করা হয় যেখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো এ দৃশ্যটির। যোগসূত্র তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিলো তার বাস্তব জীবনের কেলেঙ্কারীর সঙ্গে এই দৃশ্যের। কিন্তু পোলানস্কি তার এই দৃশ্যটির ব্যাখ্যা ধোঁয়াশার মাঝেই রেখেছেন।
Alt Screen পত্রিকার সম্পাদক Tom McCormack দৃশ্যটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-
Nearly everyone in the film is menacing to a greater or lesser degree, so the little girl’s demeanor is hardly surprising. The question is why that specific character is used to lead us into the theme of sexual anxiety, and why there’s a visual equivalence set up between her and the obvious object of desire, placed on the opposing end of the same bench.
Polanski, the artist, included this scene because he knows that a persecution fantasy can be all the more unsettling when paired with a guilty conscience.
আইএমডিবি
স্টেজেভু ডাউনলোড লিংক
রোমান পোলানস্কি : শৈল্পিক এক যোদ্ধা
বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেরা ট্রিলজিগুলো-পর্ব ১: ক্রিস্তফ কিওলোস্কির দি থ্রি কালার ট্রিলজি : ব্লু, হোয়াইট, রেড
**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**