বৃটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষে তখন বিকাশমান বাংলা গদ্যসাহিত্যে ‘বিলেত ফেরত’ চরিত্রদেরই নায়ক বানাতেন গল্পকার আর ঔপন্যাসিকেরা। যেমন নীহাররঞ্জন গুপ্ত। নীহাররঞ্জন গুপ্তের প্রায় সব উপন্যাসেই নায়কটি হতেন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। অন্যদিকে অভিনেতা বিকাশ রায় প্রায় ছবিতেই ব্যরিস্টার নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ওদিকে তখনকার পূর্ববাংলার আটাশ বছর বয়সি এক শহরের এক ছোট্ট লেনের বালক বুলবুল আহমদ এই লেখক আর অভিনেতাকে দুজনকে জীবনের নায়ক বানিয়ে বসে আছেন।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সিনেমার নায়ক বুলবুল আহমেদের জন্ম ঢাকার আগামসি লেনে ১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, শৈশব আর কৈশোর কেটেছে এখানেই। ফিল্মি চালু ভাষায় ড্যাশিং বা রোমান্টিক কিম্বা অ্যাংরি; কোনো ধরনের ইমেজই তার ছিল না। বাংলা সিনেমায় আটপৌরে চেহারার এই নায়ক বিশ্বাস করতেন ‘ভালো অভিনেতা হওয়ার জন্য ভালো মানুষ হওয়া জরুরি শর্ত’।
বুলবুলের আনুষ্ঠানিক নাম তাবাররুক আহমেদ। বাবা মরহুম খলিল আহমেদ ও মা মরহুমা মোসলেমা বেগম। খলিল আহমেদ চাকরি করতেন সরকারের আয়কর বিভাগে। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের নানা অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন বুলবুল। খলিল আহমেদ ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠক এবং শৌখিন নাট্যাভিনেতা, সে সুবাদে বাসায় বিভিন্ন সময়ে নাটকের মহড়া হত। কিন্তু বুলবুল আহমেদ ‘বাচ্চালোগ’, তার এইসব দেখার অনুমতি নাই। চুরি করে মহড়া দেখতে দেখতেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। একসময় পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম বানালেন দেবদাস, নায়ক হলেন বুলবুল।
১৯৭২ সালে ইউসুফ জহিরের (আব্দুল্লাহ ইউসুফ ইমাম এর ছদ্মনাম) ‘ইয়ে করে বিয়ে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুলবুল আহমেদের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এই চলচ্চিত্রে তিনি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। বুলবুল আহমেদ ছাত্র থাকাকালে ইউসুফ জহির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে তাকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ করে দেবেন। ‘ইয়ে করে বিয়ে’ চলচ্চিত্রের মূল নায়ক উজ্জ্বল হলেও বুলবুল আহমেদের ভূমিকাও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ‘ইয়ে করে বিয়ে’তে বুলবুলের অভিনয় দেখেই আলমগীর কবির তাকে ‘সূর্যকন্যা’ চলচ্চিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। ফলে বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসে সৃষ্টি হয় এক সফল যুগলবন্দির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে তিনি চাকরি নিলেন তখনকার ইউনাইটেড ব্যাংকে (বর্তমানে জনতা ব্যাংক)। ব্যাংকার হিসেবে দশ বছর (১৯৬৫-১৯৭৫) চাকরি শেষে ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় চাকরি ছেড়ে পেশাদার অভিনেতার জীবন বেছে নেন। ১২ বছর প্রেম করে তিনি ডেইজি আহমেদের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসেন। তাদের এক ছেলে শুভ ও দুই মেয়ে তিলোত্তমা আর ঐন্দ্রিলা। স্ত্রী ডেইজি আহমেদ ও মেয়ে ঐন্দ্রিলা অভিনয়ের জড়িত। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন বুলবুল আহমেদ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ক্লিশে কাহিনীর বাইরে টেকসই সব কাজ পাওয়া গেছে এই জুটির কাছ থেকে। বলা হয়; সত্যজিতের যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,মার্টিন স্করসিসের যেমন রবার্ট ডি নিরো,আকিরা কুরোসাওয়ার যেমন তোশিরো মিফুনি- তেমনি আলমগীর কবিরের বুলবুল আহমেদ। আর এই জুটি দর্শকদের উপহার দিল ‘সীমানা পেরিয়ে’,‘রূপালি সৈকতে’, ‘মহানায়ক’,‘মোহনা’,‘পরিনীতা’-র মত কালজয়ী চলচ্চিত্র। সবগুলো চলচ্চিত্রেই বুলবুলকে নতুন নতুন নিরীক্ষায় হাজির করেছেন কবির। এ যেন নিজের সাথে নিজের তুলনা-প্রতিতুলনা। ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭৭) পান। এরপর ‘বধূবিদায়’ (১৯৭৮) ও ‘শেষ উত্তর’ (১৯৮০) ছবিতে অভিনয়ের জন্য আরো দুই বার সেরা অভিনেতা হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
সব ধারার নিমার্তাদের কাছে তার গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী তার ‘বুলবুল আহমেদ : সীমানা পেরিয়ে’ শিরোনামের লেখায় বলেন, ‘ভিন্নধারার পরিচালক আলমগীর কবিরের একান্ত শিল্পী ছিলেন বলে এমনও নয় যে,তিনি অন্যদের কাছে আদরণীয় ছিলেন না। কাজী জহিরের মতো খুঁতখুঁতে বাণিজ্যিক ঘরানার পরিচালক আমি মূলধারার সিনেমায় কমই দেখেছি। কিন্তু অনেক ছবিতে আজিম ও রাজ্জাককে নিয়ে কাজ করার পরে যখন বধূবিদায় ছবিটির প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং যার চিত্রনাট্যের রচনায় আমিও নিয়মিত থেকেছি। তখন একদিন তিনি আমাদের জানালেন,এবার নায়ক হবেন বুলবুল আহমেদ,নায়িকা কবরী। মনে আছে,কাজী জহিরের যুক্তি শুনে আমরা কেউই ভিন্ন কথা বলার অবকাশ পাইনি’। কবিরের চলচ্চিত্রের আরেকটি পরিচিত মুখ জয়শ্রী কবির। যার সাথে বুলবুল বেশ কয়েকটি কাজ করেছেন। সেই জয়শ্রী কবিরের ভাষ্য মতে, মানুষ হিসেবে বুলবুল সাহেব এত অসাধারন ছিলেন যে তাকে বুঝে কাজ করা আমার জন্য খুব সহজ হত।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনীতে নির্মিত আলমগীর কবিরের ‘পরিণীতা’সহ আরো কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন বুলবুল। এর মধ্যে ‘দেবদাস’, ‘স্বামী’ ও ‘শুভদা’ পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ১৯৮২ সালে চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’ ছবিতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় তার জন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী চরিত্র দেবদাস বুলবুল আহমেদের সাথে মিশে গেছে যেন। বাঙালির কাছে শরৎ সাহিত্যের আবেদন কেমন তা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। শরতের নায়কেরা অতিসাধারণ, বুলবুল সেই সাধারণকে সাধারণভাবেই তুলে ধরলেন তার অসাধারণ অভিনয়ের মধ্যে। ১৯৮৭ সালে শরৎকাহিনী নিয়ে নির্মিত ‘রাজলক্ষী-শ্রীকান্ত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালকের খাতায় নাম লেখান বুলবুল আহমেদ। ছবিটির প্রযোজকও তিনি। শিল্পমানে উর্ত্তীণ এই চলচ্চিত্রটিতে তার চলচ্চিত্র বোঝাপড়া অসাধারণভাবে ধরা পড়ে। চলচ্চিত্রটি ব্যবসা সফল হয়। এটি চারটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বারোটি শাখায় বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এরমধ্যে আছে সেরা পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
চলচ্চিত্রের প্রতিটি স্থরেই তিনি সমানভাবে তার পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছিলেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের কয়েকটা চরিত্রের কথা না বললেই নয়- ‘সূর্যকন্যা’ চলচ্চিত্রে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বৈত সত্তায় ডুবে থাকা খেয়ালি যুবক,দেবদাস চলচ্চিত্রে তিনি ব্যর্থ প্রেমিক,‘শেষ উত্তর’ চলচ্চিত্রে একজন মানব দরদি শিক্ষক, ‘রাজলক্ষী-শ্রীকান্ত’-এ বাংলার উদাসি ভূবন সন্ধানি শ্রীকান্ত, ‘যাদুর বাঁশি’-তে চিকিৎসক (অতিথি চরিত্রে), ‘পয়সা পয়সা’ ছবিতে একজন মেধাবি চিকিৎসকের ভূমিকায় যিনি ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে অজ পাড়াগাঁয়ে অসহায় মানুষের সেবায় নিয়োজিত, ‘পুরষ্কার’-এ কিশোর সংশোধনাগারের শিক্ষক, ‘আরাধনা’ চলচ্চিত্রে দ্বৈত চরিত্র কিংবা ‘সীমানা পেরিয়ে’-তে একজন চাষা। তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে ভালো মানুষ (প্রথম প্রযোজিত ছবি), হারানো মানিক, কলমীলতা, এখনই সময়, দি ফাদার, লাভ ইন আমেরিকা (নায়িকা শবনমের সাথে অভিনীত একমাত্র ছবি), নওজোয়ান, ঘর সংসার, সোনার হরিণ, স্মৃতি তুমি বেদনা, ওয়াদা, শহর থেকে দূরে, অঙ্গার, অচেনা অতিথি, সোহাগ, পুরস্কার, অপমান, দুই জীবন, সময় কথা বলে,ফেরারী বসন্ত, রূপালী সৈকতে, জন্ম থেকে জলছি, স্বামী প্রভৃতি।
সবমিলিয়ে তিনি প্রায় শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সর্ব শেষ চলচ্চিত্র ২০০৯ সালে নির্মিত দুই নয়নের আলো। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের বেশিরভাগই ডিভিডিতে পাওয়া যায়।
মঞ্চ ও টেলিভিশিন নাটকেও ছিল বুলবুল আহমেদের শানিত পদচারণা। মামাতো ভাই খ্যাতনামা নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব নাজমুল হুদা বাচ্চুর হাত ধরে তিনি মঞ্চে প্রথম কাজ করেন। মঞ্চে তার প্রথম নাটকটির নাম ‘উল্কা’। ১৯৬৮ সালে তিনি টিভি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান। প্রথম টিভি নাটকটি ছিল আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও মুস্তফা মনোয়ার পরিচালিত ‘পূর্বাভাষ’। হুমায়ূন আহমেদের ‘এই সব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিকটিতে ‘টুনি’র বাবা ‘শফিক সাহেব’ চরিত্রের মাধ্যমে তিনি মধ্যবিত্তের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এছাড়া ‘বরফ গলা নদী’তে বড় ভাই, ‘ইডিয়ট’ এর আলাভোলা মানুষটি আর ‘শঙ্খ নীল কারাগার’ এর খোকা তার স্মরণীয় কাজ। ওই সময় নিয়মিত তিনি টিভি পর্দায় কাজ করে গেছেন। এছাড়া তার সাড়া জাগানো নাটকগুলোর মধ্যে ‘মালঞ্চ’, ‘মাল্যদান’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’ উল্লেখযোগ্য। তিনি তিনশরও বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সর্বশেষ টিভি নাটক ২০০৯ সালে নির্মিত ‘বাবার বাড়ি’।
রাজনৈতিক সম্পাদিত ও প্রকাশিত
____________________________________________
**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**