২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর দেশের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশে অংশগ্রহণ ও প্রচারণা চালানোর অভিযোগে ইরানের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহিকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পানাহির বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রনাট্য রচনা, বিদেশে ভ্রমণ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ওপর ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরান সরকার। এ ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। স্টিভেন স্পিলবার্গ, মার্টিন স্করসিস, রবার্ট ডি নিরো, রবার্ট রেডফোর্ড, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলাসহ বিশ্বচলচ্চিত্রের রথী-মহারথীরা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন এ অবিচারের। ইরানের ৮৫ জন চলচ্চিত্র নির্মাতা তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। পানাহি নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে মানবতা, সাম্য, লিঙ্গ ও সামাজিক বৈষম্য, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের এবারের আসরে পানাহিকে বিচারক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু দণ্ডিত হওয়ায় তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তাই উৎসবে তার সম্মানার্থে বিচারকের একটি আসন খালি রাখা হয়। এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে জাফর পানাহি ও কারাবন্দি আরেক নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে জাফর পানাহি ও মোস্তফা মিরতাহমাস পরিচালিত 'দিস ইজ নট এ ফিল্ম' তথ্যচিত্রটি। পানাহির বিচারের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার অসহনীয় দিনগুলো নিয়ে তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে শেষ চিঠিতে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, 'ওদের বিচারে দোষী সাব্যস্ত আমাকে কাটাতে হবে শব্দহীনতার ২০ বছর। তা সত্ত্বেও আমার কণ্ঠ চিৎকার করে যাবে এমন এক কালের জন্য, যে কালে আমি-আমরা সহিষ্ণু হতে জানব, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে থাকব এবং একে অন্যের জন্য বাঁচব।'
পূর্ব আজারবাইজানের মায়েনাহ শহরে ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই জন্ম নেন ইরানি নিউ ওয়েভ মুভমেন্টের অন্যতম প্রভাবশালী নির্মাতা জাফর পানাহি। মাত্র ১০ বছর বয়সে তার লেখা বই প্রকাশিত হয় এবং বইটি এইটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। ছেলেবেলা থেকেই তার সখ্য গড়ে ওঠে আট মিলিমিটার ক্যামেরার সঙ্গে। ক্যামেরা নিয়ে খেলতে খেলতেই তারুণ্যে এসে মাথায় চাপল ফটোগ্রাফির ভূত। এ ভূত তাকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে, ১৯৮০ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধে তার কাঁধে রাইফেলের পাশাপাশি ক্যামেরার ব্যাগটাও সার্বক্ষণিক জায়গা করে নিল। ফলালফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই ১৯৮৮ সালে 'দি উন্ডেড হেডস' প্রামাণ্যচিত্রটি। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, শান্তিকামী এ মানুষটি ইরান-ইরাক যুদ্ধে স্বেচ্ছায় অংশ নেননি। সরকারি নির্দেশে বাধ্যতামূলকভাবে তাকেও মিলিটারি সার্ভিসে যোগদান করতে হয়। যুদ্ধফেরত পানাহি তেহরানের কলেজ অব সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশনে পাট চুকিয়ে ইরানি টেলিভিশনের জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে আব্বাস কিয়ারোস্তামির 'থ্রো দি অলিভ ট্রিজ' চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পান। পানাহিকে এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৯৫ সালে নিজের জাত চেনালেন 'দ্য হোয়াইট বেলুন' বানিয়ে। জয় করে নেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের সম্মানজনক ক্যামেরা ডি'অর। এখন পর্যন্ত তার নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা মাত্র পাঁচ, যার প্রত্যেকটিই কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। 'দ্য মিরর' (১৯৯৭) চলচ্চিত্রের জন্য লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লেপার্ড, 'দ্য সার্কেল' (২০০০)-এর জন্য ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন, 'ক্রিমসন গোল্ড' (২০০৩)-এর জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি পুরস্কার এবং 'অফসাইড' (২০০৬) ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার বিয়ার জেতে।
বেশিরভাগ ছবিই ইরানি প্রশাসনকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। জাফর পানাহি একবার বলেছিলেন, ' আমি কোনো রাজনীতিবিদ নই। রাজনৈতিক বিষয় উপস্থাপন বা রাজনীতির সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার কাজ নয়। আমার কাছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের অধিকার। সেজন্য আমি লড়বই এবং তা চলচ্চিত্র দিয়ে।'
(তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট, ফিল্মমেকারের ভাষা এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)
(৭ জুলাই ২০১১ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)