somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আব্বাস কিয়ারোস্তামি : চলচ্চিত্রের নান্দনিক এক কবি

২২ শে জুন, ২০১১ রাত ১২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সানগ্লাসপ্রিয় আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনি কী সবসময়ই সানগল্গাস পরেন?' মজা করে তিনি উত্তর দিলেন, 'চিন্তা করবেন না, অন্তত গোসলের সময় এটা খুলে রাখি।'

আব্বাস কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে জাপানি গ্রেট ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়ার আবেগী স্বীকারোক্তি, 'বাক্যের ক্ষমতা নেই আমার অনুভূতিকে প্রকাশ করার। আমি শুধু বলি তার চলচ্চিত্রগুলো দেখুন। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু কিয়ারোস্তামির ছবি দেখার পর স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি, সত্যজিতের অভাব পূরণের জন্য যথার্থ এক মানুষকে পাঠানোর জন্য।' সত্যিই আব্বাস কিয়ারোস্তামির নেতৃত্বেই ইরানি চলচ্চিত্রাঙ্গন পাল্টে গেছে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইরানি চলচ্চিত্রকে প্রভাবশালী ও স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রায়ই বলেন, 'ছবি আঁকতে গিয়ে যদি দেখ, কোনো রঙ বা জল এলোমেলো গড়িয়ে পড়ছে, নষ্ট করে দিচ্ছে নান্দনিকতাকে, তবে চিন্তার কারণ নেই। বরং তুমি গড়িয়ে পড়া রঙটাকেই অন্য একটা উপাদান ভাব, নতুন কিছু আবিষ্কার এখান থেকেই শুরু হোক।'

আব্বাস কিয়ারোস্তামির জন্ম ১৯৪০ সালের ২২জুন, তেহরানে। আঠারো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছেন। চিত্রকলার প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল করে যোগ দেন ট্রাফিক পুলিশের চাকরিতে। কিছুদিন পর আবার পরীক্ষা দিয়ে চিত্রকলায় উত্তীর্ণ হন। যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। ১৯৬০-৬৯ এর মধ্যে তিনি পঞ্চাশটিরও বেশি বিজ্ঞাপন তৈরি করেন। বিজ্ঞাপন বানাতে বানাতেই ক্যামেরার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে তার। আরো বড় কিছু করার চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত বানিয়ে ফেললেন জীবনের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দি ব্রেড এন্ড অ্যালেই’। এরপর তার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুই ছিলো চলচ্চিত্রে। হোক তা স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য বা প্রামাণ্যচিত্র।

আব্বাস কিয়ারোস্তামি এমন একটি নাম, যিনি নান্দনিকতা ও সৃজনশীলতার প্রশ্নে বরাবরই আপসহীন। তার চলচ্চিত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করে দর্শক। তিনি চান, ছবি দেখে দর্শক চিন্তা করবে, তার চলচ্চিত্রের ভেতরে প্রবেশ করবে। শেষমেশ নিজেরাই ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে। তাই আব্বাসের চলচ্চিত্রগুলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতো 'শেষ হইয়াও হইল না শেষ' ধরনের। আব্বাসের চলচ্চিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি অপেশাদার অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'পেশাদার অভিনেতা মানেই খারাপ কিছু তা আমি মনে করি না। তবে অপেশাদার অভিনেতা ব্যবহারের সুবিধা হলো, ছবিতে তারাই আমার চিত্রনাট্য ঠিক করে দেয়। আমি যেটা লিখি তা যদি তারা মুখে না-ই আনতে পারে বা ঠিকভাবে বলতে না পারে তাহলে আমি ধরে নিই, আমি যা লিখেছি তা ভুল। সঙ্গে সঙ্গে আমি চিত্রনাট্যে পরিবর্তন আনি।'

আব্বাস পরিচালিত সর্বশেষ ছবি 'সার্টিফাইড কপি' মুক্তি পায় গত বছর। এতে অভিনয় করে জুলিয়েট বিনোশি গত বছর কান উৎসবে সেরা অভিনেত্রী শাখায় পুরস্কার পান। আব্বাস এখন 'দ্য এন্ড' নামে একটি ছবি তৈরি করছেন। ছবি বানানোর পাশাপাশি আব্বাস কাজ করেছেন চিত্রকর, ইলাস্ট্রেটর, আলোকচিত্রী, ভিডিও সম্পাদক হিসেবে। সাহিত্যিক আর কবি হিসেবেও নিজ দেশে তার সুনাম আছে। আর চলচ্চিত্রকার হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রিক্স রবার্তো রসোলিনি (১৯৯২), ফ্রান্সিস ত্রুফো অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৩), পিয়ার পাওলো প্যাসোলিনি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৫), ইউনেস্কোর ফ্রেডরিকো ফেলেনি গোল্ড মেডেল (১৯৯৭), গ্রিসের গোল্ডেন আলেকজান্ডার অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৯), আকিরা কুরোসাওয়া অ্যাওয়ার্ড (২০০০), কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম উৎসবের ওয়ার্ল্ড’স গ্রেট মাস্টার্স (২০০৭), ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভেলের গ্লোরি টু দ্য ফিল্মমেকার অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) ইত্যাদি। এছাড়া ২০০৫ সালে দ্য ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে অর্জন করেন ফেলোশিপ।

কিয়ারোস্তামি নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- ক্লোজআপ (১৯৯০), থ্রৌ দ্য অলিভ ট্রিজ (১৯৯৫) টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭), দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯), এবিসি আফ্রিকা (২০০১), টিকেটস (২০০৫), চাকান অন সিনেমা (২০০৭) প্রভৃতি। ‘ফাইভ’ (২০০৩) আব্বাস নির্মিত খুবই বিখ্যাত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

*** টেস্ট অব চেরি ১৯৯৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পাম ডি ওর জিতে নেয়।


*** দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস ১৯৯৯ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয়।


দি ব্রেড এন্ড অ্যালেই





(তথ্যসূত্র: আইএমডিবি, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট, ফিল্মমেকারের ভাষা এবং দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)

(১৬ জুন ২০১১ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)

**চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার যত পোস্ট**
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১:০১
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×