(গত বইমেলায় (২০১০) ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রুদ্র আরিফ ও বিজয় আহমেদ সম্পাদিত ফিল্মমেকারের ভাষা বইটিতে একটি অধ্যায় অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বইটি দশজন বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রকারের জীবনী ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সংকলন। আমার অনূদিত অধ্যায়টি ছিলো মেক্সিকান ফিল্মমেকার কার্লোস রেগাদাস কে নিয়ে। সামু ব্লগাদের জন্য কিস্তি আকারে অনুবাদটা প্রকাশ করলাম। এ পর্বে থাকছে নিজের তিনিটি ফিচার ফিল্ম সম্পর্কে কার্লোসের বক্তব্য)
কিস্তি ১
কিস্তি ২
কিস্তি ৩
কিস্তি ৪
বিষয়: নিজের নির্মিত ফিচার ফিল্ম জাপান ও ব্যাটেল ইন হ্যাভেন : পর্ব ২
সাক্ষাৎকারক : ২০০৭-এর কান উৎসবে আপনার ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ ফিল্মটি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত বলে মনে করছেন বেশির ভাগ সাংবাদিক। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
কার্লোস রেগাদাস : আমি উস্কানি পছন্দ করি না। কারণ, এটা বিতর্ক ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। তাই ব্যাপারটা খুব ক্ষুদ্র, এবং এ নিয়ে আমার তেমন কোনো অনুভূতি নেই। এই ফিল্মে যা ঘটেছে, তা আমি খুব গভীরভাবে উপলব্দি করেছি। আমি ব্যাপারটা নিয়ে আমার নীতিতে অটুট। যদি এটা নিয়ে বিতর্ক হয়েই তাকে, তার মানে সবাই এ ফিল্ম নিয়ে ভেবেছে। আর মানুষের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারা তো খুবই আনন্দদায়ক ব্যাপার। আমি ব্যাপারটি নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হতেই পারি, কী বলেন?
আমি আশা করি, এ বিতর্ক ফিল্মটির বাহ্যিক দিক স্পর্শ না করে এর গভীরতর দিকে প্রবেশ করুক।
সাক্ষাৎকারক : ফিল্মের শুরুতে আপনি উচ্চস্বরে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শুনিয়েছেন, আবার বলেছেন, পুরনো সময়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আবার দেখিয়েছেন সেটাই। কীভাবে আপনার ফিল্মটি ‘সময়’ ধারনাকে ব্যর্থ করে দিলো?
কার্লোস রেগাদাস : আমি মনে করি, ফিল্মে নিজের একটি জগৎ তৈরি করে সেখানে স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারাটা অসাধারণ একটা ব্যাপার। আমরা গল্প বলার জন্য সময়কে থমকে দিয়েছি। এমন একটি গল্প, যা শুধু আমাদের মাথার মধ্যেই থাকে। এ ফিল্মে যখন বৃদ্ধ লোকটি ঘড়ি ঠিক করছিলেন, তখন তিনি শুধু ঘড়িটিই ঠিক করছিলেন, যাতে সঠিকভাবে তা সময় দেকাতে পারে। তিনি কিন্তু সময়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
যখনই আমি বোকার মতো বা খারাপ কিছু করি, তখনই আমার মনে হয়, যদি আমি আমার আগের সময়ে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো এমনটা ঘটতো না। হয়তো জীবনটাকে আরেকটু সুন্দর করতে পারতাম। তার মানে এই নয় যে, আমি অতীতকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। কারণ, জীবন যেমনই, আমি তাকে গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ ফিল্মে তা ছিল না।
আমি আমার নিজস্ব অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি। অনেকে ভেবেছিল, মেয়েটির মৃত্যু কল্পনা ছিল, সে আবার ফিরে আসবে। হ্যাঁ, এটা ছিল উদ্ধৃত্তি এক, ড্রেয়ারের ‘অর্ডেট’ ফিল্মটির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। আমি কথিত অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি মনে করি, বাস্তবতাই প্রকৃতপক্ষে অলৌকিকতা। এমনকি বাইবেলে যা ঘটেছে, তাকে আমি বাস্তব থেকে আলাদ মনে করি না। যদিও বাইবেল আমি নীতিগতভাবে বিশ্বাস করি না।
সাক্ষাৎকারক : তাহলে আপনার বিশ্বাস?
কার্লোস রেগাদাস : যখন ছোট ছিলাম, আমি আমার মাকে মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী বিষয়আশয় নিয়ে প্রশ্ন করতাম। কখনো কখনো নাস্তিক হওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটা হয়নি। কিন্তু তাই বলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসও করিনি কখনো।
নাস্তিক হতে চাওয়া সত্ত্বেও আমার কিছু বিশ্বাস ছিল।
সাক্ষাৎকারক : আর তা সত্ত্বেও ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ এই বিশ্বাসকে প্রতিপাদন করতে পারেনি। কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি?
কার্লোস রেগাদাস : দু’টি ফিল্মেই পরিত্রাণ পাওয়ার স্পর্শ আছে। দু’টি ফিল্মেই দেখানো হয়েছে, জীবন অনেক কঠিন হতে পারে, কিন্তু জীবন অসাধারণ সুন্দরও।
সাক্ষাৎকারক : আপনার ফিল্ম তীব্র হতে এখনো একটু বাকি, মনে হয়।
কার্লোস রেগাদাস : ফিল্মের কাজ গল্প বলা এই ধারণাকে ঘৃণা করি আমি। ফিল্মের প্রধান অংশই হচ্ছে অনুধাবন করানো; কিন্তু তা বর্ণনা বা গল্প দিয়ে নয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমার ফিল্মের প্রথম দৃশ্যটিই ছিল সিনেমাটিকÑ চমৎকার আলোয় পূর্ণ। সাহিত্যে এর কোনো জায়গা নেই। আপনি লিখে দিতে পারেন, ‘সূর্য ওঠলো’। আমার ফিল্মের সৌন্দর্যই হচ্ছে সূর্য। আপনাকে সেটা নতুন করে বানাতে হবে না। এ ফিল্মে মেয়েটি ঘুম থেকে ওঠার পর যে ধবধবে সাদা রঙটাকে দেখে, সেটাকেও আমি খুব পছন্দ করি।
আমাদেরকে প্রতিটা আলোর জন্যই আলাদা আলাদা লেন্স ব্যবহার করতে হয়।
সাক্ষাৎকারক : আপনার সূর্য ওঠার ওপেনিং শটটি এবারের কান উৎসবের সবচেয়ে সুন্দর শট হিসেবে ধারনা করা হচ্ছে।
কার্লোস রেগাদাস : আমি তারার আলোয় ফিল্মটি শুরু ও শেষ করেছি। এখানেই গল্পটির শুরু ও শেষ। এখানে রয়েছে সুবিশাল ও সুপ্রশস্ত জগৎ। তিনটি চরিত্র নিয়ে গল্পটি চলতে শুরু করে আবার বিশ্বজগতে ফিরে আসে। এটা আমাদের জীবনের মতো। আমরা মনে করি, আমরা বিশ্বজগতের কেন্দ্রে রয়েছে। আর এরপর আমরা আর কিছুই না!
সাক্ষাৎকারক : এ ফিল্মের ভূমির দৃশ্যায়নও চমৎকার। ফিল্মটির ল্যান্ডস্কেপ আপনি খুব পছন্দ করেন মনে হয়?
কার্লোস রেগাদাস : শিশুকালে মেক্সিকোর এক গ্রামে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠেছিল। আমাদের নিজেদের খামার ছিল। ফিল্মটির মতো নিজেও ট্রাক্টর চালিয়েছি। বৃষ্টির দৃশ্যটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। বৃষ্টির দৃশ্য ব্যবহারের কারণ, মেক্সিকোর মতো সেখানেও আমি প্রচুর বৃষ্টি পেয়েছি।
সাক্ষাৎকারক : আপনার ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ কতোটা দৃষ্টিনির্ভর, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সম্পাদনের আগে তুলনামূলকভাবে প্রস্তুতির গুরুত্ব কতোটা ছিলো?
কার্লোস রেগাদাস : যখন আমি স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম এবং গল্প সাজাচ্ছিলাম, তখনই ৯৮% কাজ ভেবে রেখেছি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর বাকিটা চমক হিসেবে প্রকৃতি আমাকে দিয়েছে। তার মানে এটা না যে, আমি ভবিষ্যতের খুব কাছাকাছি ছিলাম। এর মানে, আমি আমার মাথার ভেতরে আগে ফিল্মটা বানাই, তারপর বাস্তবে রূপায়ন করি। এটা অনেকটা হিচককের২৪ মতো। পার্থক্য শুধুÑ তিনি পেশাদার অভিনেতা ও স্টুডিও ব্যবহার করতেন এবং আর্থিক কোনো সঙ্কট তার ছিল না।
যেহেতু আমার ভাগ্যে এই তিনটি ব্যাপার ছিল না, তারপরও আমি অনেক চমক পেতাম এবং ইচ্ছে করেই গ্রহণ করতাম।
এডিট খুব জরুরি; তার মানে এই না যে, সবকিছুই এডিটিং টেবিলে হতে হবে।
সাক্ষাৎকারক : ‘ব্যাটল ইন হেভেন’ নির্মাণের ক্ষেত্রে কি কোনো সুনির্দিষ্ট অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?
কার্লোস রেগাদাস : হ্যাঁ, মেক্সিকো সিটিতে একটি ফিল্ম বানানোর ইচ্ছেই এর প্রধান কারণ। তাছাড়া, এবারের আইডিয়া ছিল ‘জাপান’-এর চেয়ে বেশি সিকুয়েন্সের মাঝে ইন্টারকাটিং করবো। ‘জাপান’-এ ছিল ক্যামেরার মুভমেন্ট। কিন্তু এবারেরটা কাটিং নির্ভর। আমি এবার প্রতিটা মটের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আলাাদাভাবে গঠনম সম্পাদনা, স্থান প্রদান, রঙের কাজ ও শব্দের কাজ করতে চেয়েছি। এগুলোই প্রকৃতপক্ষে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
সাক্ষাৎকারক : আপনি কি মনে করেন ফিল্ম নির্মাণে ‘জাপান’ এবং ‘ব্যাটল ইন হেভেন’-এর মধ্য দিয়ে বিবর্তনমূলক পরিবর্তন এনেছেন?
কার্লোস রেগাদাস : এটা কারিগরি বিবর্তন। আমি আসলে কী করতে চাই, সে বিষয়ে সম্যক ধারনা আমার ছিল। আমি ফিল্ম নির্মাণের উপকরণগুলো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে জানি। বাস্তবায়নের কাজটাও ভালো পারি আমি। আরো গভীরভাবে বলতে গেলে, বিবর্তনটি মৌলিকভাবে ফিল্মিভাষা ও নির্মাণ পদ্ধতিতে। আর আমি অভিনেতাদের চেয়ে নির্মাণশৈলীকে বেশি গুরুত্ব দিই।
মোটকথা, আমি এটাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছি। যদিও অনেকে মনে করে, আমি একটু বেশি দূরেই চলে গেছি!
সাক্ষাৎকারক : ‘ব্যাটল ইন হেভেন’-এ শব্দগ্রহণের ক্ষেত্রে আপনি প্রচুর কাজ করেছেন।
কার্লোস রেগাদাস : এ ফিল্মটি মূলত অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে। ভেতরে ভেতরে মার্কোস শেষ হয়ে যাচ্ছিল। মানুষটির বাইরেরটা আমাদের নির্মিত সব অসাধারণ কাঠামোর অনুগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত এবং সমাজ, ইতিহাস, রাষ্ট্র, আইন, বিনোদন ইত্যাদি পরিবেষ্টিÑ যা আমাদের জীবনকে সহায়তা করে। কিন্তু মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। মিউজিক মার্কোসের বাইরেরটার প্রতিনিধিত্ব করে। এজন্য মিউজিকের খুবই শক্তিশালী ও ব্যাপক আবেগপূর্ণ আবেদন রয়েছে। কিন্তু এই পলায়নপর মেকানিজম কোনো কিছুই সমাধান করে না। এটা এক ধরনের নীরবতাÑ রাস্তায় বিচ্ছিন্ন হলে যেমন মিহি শব্দ শোনা যায়, তেমনি।
কিছু শব্দের ক্ষমতা খুবই বেশি; কারণ, উন্মাদনা মার্কোসকে ধীরে ধীরে তাড়িয়ে নিতে থাকে চেনা জগৎ থেকে অন্য কোথাও। কখনো তা খুববেশি দূরে, কখনো বা খুব কাছে খুব আগ্রাসীভাবে।
(চলবে.........)