somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্যামেরা, আমার হাতিয়ার: কার্লোস রেগাদাস (৩য় কিস্তি)

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(গত বইমেলায় (২০১০) ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রুদ্র আরিফ ও বিজয় আহমেদ সম্পাদিত ‌‌ফিল্মমেকারের ভাষা বইটিতে একটি অধ্যায় অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বইটি দশজন বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রকারের জীবনী ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সংকলন। আমার অনূদিত অধ্যায়টি ছিলো মেক্সিকান ফিল্মমেকার কার্লোস রেগাদাস কে নিয়ে। সামু ব্লগাদের জন্য কিস্তি আকারে অনুবাদটা প্রকাশ করলাম। এ পর্বে থাকছে ফিল্মের কলাকৌশল সম্পর্কে তার চিন্তা-ভাবনা)
১ম কিস্তি ২য় কিস্তি


সাক্ষাৎকারক : আপনার নির্মাণ পদ্ধতি জানান আমাদের।
কার্লোস রেগাদাস : আমি বলবো, আমার ব্যতিক্রমি দিকটি হচ্ছে ‘কুলেসোভ এফেক্ট’। এটা আমার ক্ষেত্রে ফিল্মে চরিত্র গঠনের জন্য প্রধান অন্তর্জ্ঞান হিসেবে কাজ করে। আমার কাছে এ পদ্ধতি থিয়েটারে চরিত্র গঠনের মতো নয়; যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো থিয়েটার পদ্ধতিতেই ফিল্মে চরিত্র গঠনের কাজ চলছে। মূলত পদ্ধতিটি হচ্ছে অভিনেতাদের চরিত্র সম্পর্কে কোনোরকম মানসিক জ্ঞান না দিয়ে তাদের বরং বাস্তবসম্মত, সময়গত এবং ব্যাপনস্থল সংক্রান্ত কিছু তথ্য দেওয়া। আর বাকিটা সম্পাদনা এবং অন্যান্য ফিল্মি পদ্ধতির মাধ্যমে চরিত্র গঠন করা। এ জন্য আমি কখনোই অভিনেতাদের স্ক্রিপ্ট দেই না এবং কোনো রিহার্সেল করাই না। আমি বরং তাদের নিজস্ব ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখি। সে যা, তা-ই যেন ফুটে উঠুক। এটাই পদ্ধতি।
আমি মনে করি, তারা কৃত্রিম এক্সপ্রেশন দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকলেই একটা সুন্দর এক্সপ্রেশন ফুটে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেবে।
অবশ্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো এ বিষয়টি বেশিরভাগ দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি; কেননা, এতে অভ্যস্থ না তারা।

সাক্ষাৎকারক : ফিল্মের অভিনেতা ঠিক করেন কীভাবে?
কার্লোস রেগাদাস : এটা ঠিক যে, কাস্টিং ঠিকঠাক না হলে ফিল্মটিও ঠিকমতো হবে না; কেননা, এটা কোনো টেকনিক্যাল ব্যাপার না। সর্বশক্তি বিনিয়োগ করতে না পারলে ফিল্ম দাঁড়াবে না। তবে মজার ব্যাপার হলো, কাজটি আপনি আপনার সহজাত বুদ্ধি দিয়েই করতে পারবেন। ‘ব্যাটল ইন হেভেন’-এর মার্কোস অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আমি তাকে ২৫ বছর ধরে চিনি এবং তার সম্পর্কে এত কিছু লিখেছি যে, জানতাম আমার ভুল হবে না। অন্য চরিত্রগুলো নিয়ে বলতে গেলে, আমি যখনই তাদের দেখেছি, তখনই মনে হয়েছে তারা চরিত্রের জন্য উপযোগী।
এটা অনেকটা ফটোগ্রাফারের মতো। আপনি যদি ছবি তোলার জন্য সঠিক গাছটি খুঁজতে থাকেন, তাহলে বন-বাদাড়ে খুঁজতে খুঁজতে একটা গাছ আপনার সমনে ঠিকই পড়বে যেটা দেখে আপনার মনে হবে, এই গাছটিকেই খুঁজছিলেন।

সাক্ষাৎকারক : অভিনেতার সঙ্গে ফিল্মমেকারের সম্পর্ক তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। যাদেরকে আপনার ভালোলাগে, কেবল তাদের সঙ্গে কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে এমনটা কি হয়?
কার্লোসে রেগেদাস : হ্যাঁ, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি কাউকে পছন্দ না করেন, তাহলে তার সঙ্গে বান করে সময় কাটাবেন, এবং এটা আসলে কোনো কাজে আসবে না। উদাহরণ হিসেবে আপনাকে বলতে পারি, ‘জাপান’-এর প্রধান চরিত্রের অভিনেতা আমি পছন্দ করতাম; কিন্তু সে ছিল খুব যন্ত্রণাদায়ক একটা মানুষ। তাই মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে বসে আলতু ফালতু কথা বলা দরকার হয়ে পড়ে। আপনি জানেন, এটা কাজেরই একটা অংশ। এক্ষেত্রে আমি অন্য ফিল্মমেকারদের চেয়ে আলাদা। আপনি হয়তো কাজের জন্য তাকে আনবেন। তারপর তাকে দিয়ে যদি ঠিকমতো কাজ না হয়, আপনি তারপরও তারসঙ্গে যেচে কথা বলতে যাবেন না। কিন্তু আমি সবসময়ই অভিনেতাদের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করি।

সাক্ষাৎকারক : ফিল্মে গল্পকথন বা আখ্যান বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
কার্লোস রেগাদাস : গল্প নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি জানি, একই গল্প মাঝামাঝি মানে হাজির করতে পালে তা মাঝামাঝি মানের গল্প, আর সঠিকভাবে বানাতে পারলে অসাধারণ গল্প হয়ে উঠবে। তাই আমি এটাকে ছবি আঁকা বা মিউজিকের কাছাকাছি একটা উপাদান হিসেবে অনুভব করি যেখানে গল্প খুববেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকে ছবি আঁকায় আখ্যানকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবলেও আমি ভাবি না।
আমার সাইকলোজিস্ট মায়ের সঙ্গে পেইন্টিং দেখতে গেলে তিনি সবসময় রুবেন্সের২৩ পেইন্টিং দেখে জানাতেন, ঠিক কোন পেইন্টিংটা মিথ-উপজীব্য করে আঁকা। আমি বলতাম, কোনটা কীসের ভিত্তিতে আঁকা, তা না ভেবে পেইন্টিং দেখুন, আর অনুভব করুন।

সাক্ষাৎকারক : আপনাকে ফিল্মে ডকুমেন্টারি ও ফিকশনের দৃষ্টিনির্ভর অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন স্টাইল মিশ্রণে আগ্রহী দেখা যায়। এটা কেন?
কার্লোস রেগাদাস : স্টাইল সম্পর্কে ভাবি না আমি। ফিল্মিভাষাই ফিল্মকে পরিবেশন করবে, অন্যকিছু না। আমার নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে প্রত্যেকটা দৃশ্য চিত্রায়নের পথ খুঁজি। প্রত্যেকটা শট নেওয়ার সময় নিজেকে অনেক স্বাধীন ভাবি। শক্তিশালী ভাষাগত ঐক্য বজায় রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি শটের অভ্যন্তরীণ কিছু বদলাই না। আমি নির্দিষ্ট শট থেকে প্রামাণ্য শটে যাই না।

সাক্ষাৎকারক : নান্দনিকতার প্রশ্নে আপনি কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেন?
কার্লোস রেগাদাস : আমি চরিত্র ও ক্যামেরার মুভমেন্টগুলো আগে থেকেই ভেবে রাখি। অ-অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করাই আমিচরিত্রগুলো তাদের সংলাপ ঠিকমতো আত্মস্থ করেছে কি-না, সে বিষয়টা আগে নিশ্চিত হয়ে নিই। তবে আমি রিহার্সেল করাই না। অনেক সময় প্রথম শটটাই সবচেয়ে বালো হয়।
আমি বিশ্বাস করি, আমার ফিল্মের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো পথ। একজন অ-অভিনেতা আমার ফিল্মের চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারে। মুভমেন্টের উপর প্রচুর শট নিতে পছন্দ করি আমি। অনেক শটের চিন্তা মাথায় হুট করেই চলে আসে। এটা অনেকটা প্রতিমুহূর্তে একটু একটু এগিয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। এটা আপনার ফিল্মকে ফ্রেমের মধ্যে প্রবেশ করার জায়গা করে দেয়, এবং কী ঘটবে তা চিন্তা করতে সাহায্য করে আপনাকে।

সাক্ষাৎকারক : আমি একটা বিষয় জানতে আগ্রহী। কীভাবে আপনি ফিল্মের সেটে অভিনেতাদের জন্য কাজের উপযুক্ত ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেন? কারণ, অনেক সময়ই লং-টেক নেওয়া হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। বিশেষ করে, সেন্সরড দৃশ্য, অর্থাৎ যৌনদৃশ্য বা নগ্নদৃশ্যের চিত্রায়নের সময় সেটের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে কি কোনো বেগ পেতে হয়?
কার্লোস রেগাদাস : অভিনেতাদের সঙ্গে আমি গভীর সম্পর্ক তৈরি করে নিই, যা বাইরে থেকে দেখে খুব একটা বোঝা যায় না। সম্পূর্ণ বিশ্বস্ততা স্থাপন করা গেলেই তারা আমার জন্য সবকিছু করতে রাজি হবে এবং ভেবে নেবে, সবকিছু ঠিকঠাকই হচ্ছে। তারা কাজটা করে তো বটেই, খুশি মনে স্বাভাবিকভাবেই চরিত্রগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করে। ফিল্মের যে চরিত্রটি তারা করবে, আমি অভিনেতাদের সে সম্পর্কে কোনো মনোস্তাত্ত্বিক ধারনা দেওয়ায় আগ্রহবোধ করি না। আমি তাদেরকে তাদের মতো করেই কাজটি করতে দিই। আমি চাই তারা তাদের সর্বোচ্চ শ্রম ও অনন্যতা নিজের মতো করেই দিক। আর সঠিক সময়ে সঠিক কথাগুলো বলুক।
এসব করতে পারলেই সব মিলিয়ে ফিল্মের একটি আবহ সৃষ্টি হয়। তাই কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সুষ্টি করা মোটেও কঠিন কিছু না।

সাক্ষাৎকারক : আপনার দেশ আপনার ফিল্মের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
কার্লোস রেগাদাস : মেক্সিকো খুব গুরুত্বপূর্ণ শুধু এ কারণে যে, ফিল্মটি মেক্সিকোতে বানানো হয়েছে। এছাড়া আমি খুব বেশি মেক্সিকানিস্ট না। আমাকে ইংল্যান্ডে দেশান্তরি হতে হবে এবং সেখানে ফিল্ম বানাতে হবে। আমি তখনো একই বিসয়ে আগ্রহী হবো; তবে ইংল্যান্ড তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, আর আমি প্রাসঙ্গিক বিষয়আশয়ে যথেষ্ট অনুগত থাকবো। আমি যদি একজন ধর্মযাজককে নিয়ে ইয়র্কশায়ারে ফিল্ম বানাই, তাহলে পুরো ব্যাপারটাতে ইংরেজ ছাপ থাকবে। যেহেতু এটা ধর্মযাজকের আত্মিক দিন নিরূপন করবে, সেহেতু প্রসঙ্গটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে।
(চলবে...................)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:২০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×