(গত বইমেলায় (২০১০) ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রুদ্র আরিফ ও বিজয় আহমেদ সম্পাদিত ফিল্মমেকারের ভাষা বইটিতে একটি অধ্যায় অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বইটি দশজন বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রকারের জীবনী ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সংকলন। আমার অনূদিত অধ্যায়টি ছিলো মেক্সিকান ফিল্মমেকার কার্লোস রেগাদাস কে নিয়ে। সামু ব্লগাদের জন্য কিস্তি আকারে অনুবাদটা প্রকাশ করলাম। এ পর্বে থাকছে ফিল্ম এর নানা দিক সম্পর্কে কার্লোসের ধ্যান-ধারণা )
১ম কিস্তি
আমার ভাবনা
আমি যা নিয়েই ফিল্ম বানাই না কেন, এটা ভাবার কারণ নেই যে, শ্রেণী বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাচ্ছি আমি। এটা শুধুই দেখানোর জন্য। আমি যদি আকাশকে চিত্রায়ণ করি, তাহলে মেঘকে বাদ দিতে পারবো না। যদিও আমি হয়তো মেঘের ব্যাপারে চিন্তিত নই; কিন্তু আকাশের একটা অংশই হচ্ছে মেঘ।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমি পরিষ্কার করেই বলছি, আমি গল্প বলার মতো কোনো ফিল্মমেকার নই। তবে আমার ফিল্মে যে একেবারেই যে গল্প বা প্লট থাকে না, তা কিন্তু নয়। বর্ণনা বা গল্পটা জরুরি, কারণ, শেষমেষ আপনি কিছু নিয়ে কথা বলবেন। আমি জানি না আপনি কোয়েনদের শেষ ছবি ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’ দেখেছেন কি-না। এটাকে আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছি। কেন করেছি, বলি।
ফিল্মটির শুরু হয়েছে টেক্সাস প্রদেশের অপরূপ সূর্যোদয়ের দৃশ্য দিয়ে। কিন্তু আপনি যখন অদ্ভুত নামের আজব উচ্চারণের ব্যক্তিটিকে দেখবেন খুন খারাবিতে ব্যস্ত থাকতে এবং তার কথা শুনবেন, তখন বুঝবেন টেক্সাসের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য ধারণ করার কোনো ইচ্ছে তাদের ছিল না। তারা তিন মিনিটের জন্যও দৃশ্যটা রাখেনি যাতে আপনি দেখতে, অনুভব করতে এবং স্পর্শ করতে পারেন। তারা একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এটা দেখিয়েছে যে, টেক্সাসে এটা ঘটে এবং তা অনেক সুন্দর। জায়গাটির বিশেষত্ব কোথায়? আমার মনে হয়েছে তারা প্রত্যেকটা মানুষকে শুট করতে গিয়ে এবং যাই করেছে সবক্ষেত্রেই এটা ছিল মূললক্ষ। তারা চরিত্রগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিল না, যা তাদের মাথায় ছিল এবং যেটা তারা খুবই আনন্দদায়ক ভেবেছিল।
আমি যখন নিজেকে গল্পকথক ফিল্মমেকার বলি না, তখন আসলে গল্প যে থাকে না, তা কিন্তু নয়। যখনই ফিল্ম বানাচ্ছেন আপনি, সেটা যেরকম, সেভাবেই স্পর্শ করতে চাইবেন। একজন পেইন্টার কিংবা ফটোগ্রাফার যেভাবে তার বিষয়কে ভালোবাসে, ঠিক সেভাবেই।
ফিল্মের মূলকথা
বস্তুগতভাবে অবশ্যই এগুলো বিদ্যমান। কিন্তু ফিল্মের মূলকথা ভিন্ন। এটাকে শিল্প হিসেবে মূল্যায়ন করতে হলে ফিল্মের মূলভাবকে অবশ্যই যথাস্থানে রাখতে হবে। ফিল্ম এসব বিষয়কে নিজস্ব কিছু সৃষ্টিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
ফিল্ম প্রসঙ্গে
আমরা আসলে যাকে ফিল্ম মনে করি, তা প্রকৃতপক্ষে ফিল্ম নয়; এটা ফিল্ম-থিয়েটার, অথবা তারচেয়ে বাজে কিছু। এ ফিল্মগুলোর উদ্দেশ্য গল্প বলা এবং এর অভিনেতারা কোনো কিছু প্রদর্শন করার টেকনিক্যাল কিছু মানুষ। বেশিরভাগ ফিল্মই কমিকস বইয়ের মতো। আমি এগুলোকে ফিল্ম বলি না। আসল ফিল্ম মিউজিকের কাছাকাছি। মিউজিক কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা কেবল অনুভূতিকে প্রকাশ করে। এর কোনো মানে নেই। শিল্পের অর্থ খোঁজা বয়ঃসন্ধির মতো অপ্রাসঙ্গিক।
ফিল্ম নিমাণের পর আমি পর্যালোচনামূলক মনোঃসমীক্ষণ করি, যাতে জার্নালিস্ট ও ফিল্মের লোকদের তা ব্যাখ্যা করতে পারি। আসলে আমি কিন্তু নিজেই নিজের সেসব ব্যাখ্যা বিশ্বাস করি না!
থিয়েটার
আমি থিয়েটার পছন্দ করি না। কারণ, আমি থিয়েটারের শিল্পীদের পছন্দ করি না। থিয়েটারের মানুষ কিছু হাস্যকর পোশাক পড়ে একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে উঠেপড়ে লাগে। যেহেতু তারা সবসময় একটু চরিত্রকে প্রদর্শন করার কাজে নিয়োজিত থাকে, আমি এটা একদমই বুঝি না। আমার প্রচণ্ড বিরক্ত ও অবাক লাগে। এই শিল্পীদের জন্য দুঃখ অনুভব করি আমি। থিয়েটার দেহের দূষিত পদার্থের মতো আবেগকে নির্গমন করে; কারণ, এভাবে একজন অভিনেতা বেকুব হতে পারে।
আমি আসলেই, আসলেই থিয়েটার অপছন্দ করি এবং এটা থেকে দূরে থাকতে চাই।
আর্টিস্টের ভূমিকা
কয়েকদিন আগের ছুটিতে আমি তারকোভস্কির সবগুলো ফিল্ম দেখেছি। একই অভিনেতাদের ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার মনোযোগ নষ্ট করেছে। আমি মনে করি এটা ফিল্মের শক্তিকে নষ্ট করে দেয়। আপনি যখন ফিল্মের প্রধান চরিত্র হিসেবে একাধিক ফিল্মে নিকোলাই গ্রিঙ্কোকে দেখবেন, তখন ফিল্মটি ঐ অভিনেতাকেন্দ্রিক হয়ে যাবে এবং এর সম্পূর্ণ শক্তি নষ্ট নষ্ট করে দেবে।
কয়েকদিন আগে আমি বার্গম্যানের ‘আওয়ার অব দ্য উল্ফ’ দেখেছি। আমার মতে, বার্গম্যানের সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা হচ্ছে, একই অভিনেতাদের বারবার ব্যবহার করা। ড্রেয়ারের ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটেনি। তারপরও আমি ‘আওয়ার অব দ্য উল্ফ’ দেখা শুরু করি। এর শুরুতে একটি অসাধারণ সাদাকালো দৃশ্য ভেসে ওঠে। দৃশ্যটি গ্রামাঞ্চলের এক কুঁড়েঘরের। দেখতে দেখতে মনে হলো, দৃশ্যটির অদ্ভুত সৌন্দর্য ও শক্তিতে অন্য এক স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গেছি। ঠিক তখনই কুঁড়েঘর থেকে লিভ উলম্যান বেরিয়ে এলেন। আমি তাকে বার্গম্যানের আরেকটি ফিল্মেও দেখেছি। আর তখনই এটা আমার কাছে সাদামাটা মনে হলো।
আর্টিস্ট : পেশাদার ও অপেশাদার
পরিচিত কোনো মুখকে ক্যামেরার সামনে আনা মানে ফিল্মে মারাত্মক বিভ্রম সৃষ্টি করা। একটি ফিল্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রে যদি ব্র্যাড পিট ও নিকোল কিডম্যানকে কল্পনা করেন, তাহলে তো আপনি ফিল্মটিকেই নষ্ট করলেন। তার মানে আপনি বুঝে গেলেন মেন্নোনিতেদের পোশাকে ব্র্যাড পিট ও নিকোল কিডম্যানকে দেখছেন। তার মানে কিন্তু এই না যে, আমাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন ব্যাপার। পেশাদার অভিনেতাদের বারবার ব্যবহার করার যে প্রচলিত সার্কাস, তা আমি পছন্দ করি না। আমার কাছে ফিল্ম আসলে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ পার্টির মতো। আমি প্রথমে জিল গার্সিয়া বার্নেলকে চেগুয়েভারা সাজে দেখলাম। তারপর দেখলাম বেনিসিও দেল তোরোকে। পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা হয়তো অন্য একজনকে দেখবো।
আমার মনে হয় তাদের ত্বকে অন্যের পোশাক ধার করা উচিত।
আর আমার পছন্দ অপেশাদার আর্টিস্ট। এবং যেহেতু তারা কখনো অভিনয় করেনি, তাই অনেক সময় আমি তাদের পায়ে দড়ি বাঁধি এবং দড়ি টেনে তাদের ইঙ্গিত দিই সংলাপ বলতে হবে বা নড়াচড়া করতে হবে। এ অনেকটা পাপেটের মতো। অনেকে একে অধিকার হরণ বললেও আমি এর বিপরীত চিন্তা করি। আমি তাদের কাছ থেকে যা চাই, তা হলো, তাদের অভ্যন্তরীণ উপস্থিতি ও শক্তি।
আমার বিশ্বাস, কেউ যখন অভিনয় করে বা কোনো চরিত্রকে বোঝার চেষ্টা করে, তখন তার নিজস্ব অস্তিত্ব আর সেখানে উপস্থিত থাকে না।
শরীর
আমরা যা বলি এবং অভিনয় করি, তা শিখতে হয়। কিন্তু তা যতোই ন্যাচারাল বা বাস্তবসম্মত হোক না কেন, আমরা সব সময়ই একটা চরিত্রকে তুলে ধরি। কিন্তু শরীর অভিনয় করতে পারে না। শরীর আপনাকে মানুষের অন্তর্নিহিত জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। অসাধারণ পেইন্টারদের কথা ভাবুন। তাদের পেইন্টিংয়ে কী আছে? ভেলাকুয়েজ ও তার ‘স্প্যানিশ কিং’ পেইন্টিংটার কথা ভাবুন। টেকনিক বা আলোর ব্যবহার কাজটাকে সুন্দর করেনি।
এই ছবিতে মানুষটির অভ্যন্তরীন ক্রিয়াকে দেখা যায়।
সম্পর্ক
আলফানসো কোরন, আলেহান্দ্রে গঞ্জালেস ইনারিতু আমরা একে অপরকে সাহায্য করছি। শুধু ফিল্মমেকারদের নয়, অভিনেতাদেরও। এরমধ্যে আছেন জিল গার্সিয়া বার্নেল, দিয়েগো লুনা ও সালমা হায়েক। আমরা বুঝতে পেরেছি, আমাদের একজনের জন্য যা ভালো, তা সবার জন্যই ভালো। এভাবে আমরা একত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু শৈল্পিন দিক দিয়ে আমরা একে অপরের কাজকে সম্মান করি এবং কাজগুলো আমরা আলাদাভাবে নিজেদের মতো করেই করি। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক বিষয়টি মুখ্য নয়।
আমি তো মনে করি, আমি লিথুনিয়ান বা আফ্রিকান কিংবা অন্য কোন অঞ্চলেরও হতে পারতাম।
যৌনদৃশ্য ও আমি
আমরা প্রতিদিন নগ্ন হয়ে গোসলখানায় যাই। দিনে কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার আমরা নগ্ন হই। সপ্তাহে একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কে জড়াই। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ফিল্মে এটা দেখানো হয় না। তাই আমাকে জিজ্ঞেস না করে অন্য ফিল্মমেকারদের জিজ্ঞেস করা উচিত, কেন তারা যৌনদৃশ্য প্রদর্শন করে না।
আমিই একমাত্র স্বাভাবিক নির্মাতা।
(চলবে...............)