হাজার বছর ধরে ভাবছি নিজের ভ্রমন কাহিনীগুলো নিয়ে কিছু লেখব। ধীরে ধীরে স্মৃতিগুলোও ধুসর হয়ে আসছে। কারন সে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগেকার কথা। লেখি লেখি করেও আর লেখা হয়নি। তো আজ ভাবলাম - লেখা শুরু করি, দেখি কতদূর যাওয়া যায়। লেখার ও ছবির মান দুটোই নিম্নমানের হবে। ছবির মান খারাপ কারন যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার কাছে কোন উন্নত ক্যামেরা ছিলনা। আর লেখার মান খারাপ, কারন এখনও আমার মাঝে উন্নত মানের লেখনীশক্তি তৈরী হয়নি। লেখনীশক্তি তৈরি হওয়ার অপেক্ষায় আছি।
'৯৬ সালের প্রথমকার কথা। এসএসসি পরীক্ষা সামনে। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের ব্যাচেই প্রথম বই বদলে দেয়া হয়। সবাই চিন্তিত। আগের বছরের সাজেশন বলে কিছু আর নাই - আগের বই আর এবারের বইয়ে তো কোন মিল নাই, তো পুরানো সাজেশন দিয়ে হবেটা কি! সবার মাথায় হাত। আমার মাথায় হাতের সাথে সাথে পা! কারন পড়াশোনায় আমি বরাবরই ইসমার্ট। পড়ার কথা শুনলেই ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এই কাজ, ঐ কাজ - নাই কাজ তো খই ভাজ - কত ব্যস্ততা আমার! পড়ার টেবিলে বসে বসে সারাদিন শুধু ক্রিকেটের দল ঠিক করতাম। কাকে আগে ব্যাটিং-এ নামাবো, কে হবে ওপেনিং বোলার, আরো কত কি! আমি আবার জোর করে দলের ক্যাপ্টেন হইতাম তো তাই

পরীক্ষার আগে আগে যা হয় সবসময়, আমার আব্বুর মনে হলো, আমাকে শক্তহাতে "টাইট" দেয়া দরকার। আমার ধারনা এর পেছনে আম্মুর উসকানি আছে। তো আব্বু দেখি খালি আমার পড়াশোনার খবর রাখে, কোচিং কেমন চলছে, কোন স্যার কেমন, আর কোন বই লাগবে কি না - দিনে দুইবার করে এই জেরা শুরু হলো। আমি সামনের এসএসসি পরীক্ষার কথা ভেবে প্রমাদ গুনলাম। তখন তো সবে জেরা করা হচ্ছিল, যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে আমাকে যে রিমান্ডে নেয়া হবে - সেটা বুঝতে আর বাকী থাকল না

রিমান্ডের ভয়ে হোক আর নিজের ভবিষ্যৎের কথা ভেবেই কিনা জানি না, আমি পড়াশোনা করতে করতে ঝড় তুলে ফেলি। মনে হচ্ছিল পড়তে পড়তে সব উড়ায়ে ফেলব। রাস্তা দিয়ে কেউ হেটে গেল, ওকেও ধরে এনে পড়াটা ঝালাই করব - বুঝতেই পারছেন অবস্থা। তো এই রকম মারকাট পড়াশোনার মাঝে হঠাৎ জানতে পারলাম - আমার আব্বুর বিদেশ গমনের খবর। আসলে উনার বিদেশে যাবার কথা আরো আগেই। কিন্তু এটা তো বাংলাদেশ, এখানে তো কোথাওই সিরিয়াল মানা হয় না - সবার আগে সুযোগ পায় তারা, যারা কানেক্টেড। আব্বুর যেহেতু তেমন কোন কানেকশন নাই, তাই তাকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। পরে জেনেছি - প্রতি বছরই সিলেক্শন কমিটিতে তার নাম আসছিল, কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারনে তাকে কোনবারই সিলেক্ট করা হচ্ছিল না। আব্বু বয়স ও পদবী দুক্ষেত্রেই জৈষ্ঠ্য হবার পরও তাকে বাদ দেয়া হচ্ছিল।

সেবছর কমিটিতে উনার নাম ডাকা হয় এবং তাকে দলে নেয়া হয়, হয়ত তারা ভেবেছিলেন "এই লোক কে অনেক বছর আটকানো হয়েছে, এবার তাকে ছাড়ি"।
যাই হোক উনি বিদেশ যাচ্ছেন ১মাসের মাঝেই। অনেকে হয়ত ভাবছেন উনার এই বিদেশ যাবার খবরে আমি খুশিতে লাফ দিয়ে ছাদে টক্কর খেয়ে মাথা ফুলিয়েছে - কিন্তু না আমি ঠিক খুশি হইনি। মানে আমি আব্বুর জন্য খুশি ছিলাম, কিন্তু কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল - কিভাবে আমরা, ছোট ভাই, আম্মাকে নিয়ে চলব।
আব্বু যাচ্ছেন কুয়েত। খুব তাড়াহুড়া করে সব কিছু তৈরি করা হলো, ভিসা, মেডিকেল, তার অনূপস্থিতে ব্যাংকের কাগজপত্র - হাবিজাবি সব কিছু। তারপর তার যাবার দিন চলে এল। এয়্যারপোর্টে গেলাম সবাই। আব্বু সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন, আমার কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন - কিন্তু কিছু বলেননা। তারপর হুট করে ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে হনহন করে ইমিগ্রেশনের দিকে হাটা দিলেন।
বিমান বাংলাদেশের একটি প্লেন তাকে নিয়ে কুয়েতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। উনি চলে যাওয়ার পরপরই মনে হলো, কারো হাত মাথার উপর থেকে সরে গেছে। নিজেকে অনেক একা লাগছিল

তখনও অবশ্য জানিনা কিছুদিনের মধ্যেই আমাকেও প্লেনে চড়ে বসতে হবে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৬