পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন আছে কিনা তা আমার জানা নেই। যে একজন প্রকৃতি খুনি বা অপরাধীর বিচার না করে ভিকটিমের ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে ডেকে দেয় আসল অপরাধীর বিচার। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, আইন-শৃঙ্খলা, বিভিন্নগণমাধ্যম, এছড়াও দেশের মন্ত্রী-এমপিরা বাদ পড়ছেন না এই সব অকৃতকার্য কর্মকান্ড থেকে।
রুনিঃ
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে সাংবাদিক দাম্পতি সাগর-রুনিকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যার আসামিদের বিচারের দরজায় না এনে এনেছে ভিকটিম রুনির মিথ্যা পরকীয়ার কথা। রুনির বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ এনে কুরুচিপূর্ণ তথ্য ছড়িয়ে দেয় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে। কিন্তু প্রধান আসামিরা পার পেয়ে গেছে, আর বন্ধ হয়ে গেছে সাগর-রুনির বিচার কার্যকর্ম। আট বছরের এই দাম্পতির হত্যার বিচার হচ্ছে না। বিচার পাচ্ছে না তাদের রেখা যায় সন্তান মেঘ এবং তাদের বাবা-মা আত্ময়-স্বজনার। বিনা দোষে দোষী বানালো একজন নির্দোষ নারীকে। আর পার পেয়ে গেছে হত্যাকারীরা।
সোহাগী জাহান তনুঃ
২০ মার্চ ২০১৬ সালে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী এবং সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়াতে যেতেন। ধর্ষণে স্বীকার হয়ে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়। মেয়েটির অপরাধ কোনটি তা পুরুষ বা সমাজের কাছে আজো আবছা হয়ে আছে। তনুর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ, বিভিন্ন গণমাধ্যম ছড়িয়েছে ” হিজাব পরা মেয়ে থিয়েটারে কাজ করে সেতো ধর্ষণ হবেই” এই ভাবেই একজন ভিকটিমের বিচার হয় বাংলাদেশে। কারণ নারীতো, সে তো অবলা।
আয়েশা আক্তার মিন্নিঃ
২৬ জুন, ২০১৯ বগুড়ার শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফ দুর্বিত্তদের হাতে হত্যায় স্বীকার হয়। যদিও স্ত্রী মিন্নি তাকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়, তারপরও স্বামীকে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু এই দোষটা এসে পরেছে একজন মিন্নি, একজন নারীর কাঁধে। মিন্নিকে এদেশের জনগণ, এদেশের মিডিয়া, এদেশের আইন খুব ভালো একটি উদাহরণ দিয়েছে। খুনি নয়ন বন্ডের সাথে মিন্নি কে পরকীয়ায় জড়িয়ে ক্যাসটি ধামাচাপা দেয় এদেশের আইন। আর মিন্নির নামে পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে অশ্লীল ভিডিও, ছবি, বাজে মন্তব্য এবং বাজে কথাবার্তা। বিচার হয় না খুনিদের, বিচার হয়না এই সব মানুষদের যারা এই রকমভাবে অশ্লীল ভিডিও, ছবি, বাজে মন্তব্য করে। এই ভাবে দোষ হয় একটি মেয়ের, কারণ মেয়ে বলে কথা। মেয়ে তুই কিছুই পারবি না। তোর সব দোষ।
এই ভাবেই হত্যায় স্বীকার হয় নুসরাত জাহান রাফি, মিতু, খাদিজা, আয়েশা, রুপা, ফাতেমাসহ হাজারও নারী। আর এদেশের কিছু সাধারণ মানুষ, কিছু গণমাধ্যম, কিছু আইন, কিছু পুরুষ মনে করে এর জন্য দায়ী ভিকটিম নিজেরাই, অর্থাৎ নারীরাই। যারা প্রকৃতি অপরাধী তারা দায়ী নয়, কারণ তারা পুরুষ। সাবাস বাংলাদেশ। কিন্তু কেনো?
ডঃ সাবরিনা শারমিন হুসেনঃ
ডঃ সাবরিনা শারমিন তিনি একজন বড় ডাক্তার। তিনি জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান। এই মহিলা অপরাধ করেছেন? হ্যা করেছেন। তবে তার বিচার হয় না কেনো? চরম ভাবে বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু বিচার না করে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সবাই পরে রয়েছে কেনো? যখন কোন মানুষ অপরাধ করে তখন সেই অপরাধের জন্য সে দায়ী। সেই অপরাধের জন্যই তাকে জেল, জরিমান, যাবতজীবন বা মৃত্যুদন্ড যেটা হওয়ার কথা সেটা হবে। তবে কেনো সেই অপরাধীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে এই সমাজ, মানুষ, গণমাধ্যম এতো এতো নাটক করে বেড়ায়? সাবরিনা অপরাধ করেছেন, সে যে অপরাধ করেছে সেই মতো বিচার তার হবে, এবং হওয়া উচিত। কিন্তু তাকে নিয়ে কেনো সাধারণ মানুষ, মিডিয়া এইভাবে অশ্লীল ছবি, ভিডিও, মন্তব্য। এইসব করার অধিকার কি তাদের আছে? অধিকার নেই। সাবরিনা মেয়ে বলে তার দোষ? সাবরিনার থেকে বড় বড় মাফিয়ারা পার পেয়ে যাচ্ছে। যারা এইসব করে বেড়ায় তারা কি সিলিব্রিটি হতে চায়? সিলিব্রিট তারা হতে পারবে না, কারণ ডাঃ সাবরিনার মেধা আর এই সব মূর্খ্যলোকদের মেধা এক নয়। তাই সিলিব্রিটি হওয়া এতো সহজ নয়। “প্রতিটি অপরাধীর অপরাধের বিচার হওয়া দরকার, কিন্তু তার ব্যক্তি জীবন অপরাধের সাথে জড়ানো উচিত না।”
শ্রিপা দেবনাথঃ
এরপর গত কয়েকদিন যাবত আলোচনায় আসে শ্রিপা দেবনাথ। মেয়েটির অপরাধ ও “মেয়ে বলে”। গত ৩১শে জুলাই পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে খুন হয় মেজের সিনহা মোঃ রাশেদ খান। সামাজিক কাজের জন্য সিনহার একটি টিম নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমেণের উদ্দেশ্যে যায়। কিন্তু সিনহাকে ফিরতে হয় মায়ের বুকে লাশ হয়ে। আর সেই ক্যাস ধামাচাপা দিতে এদেশের সাধারণ মানুষ, গণমধ্যমগুলো এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহীনিরাও জড়িয়ে ফেলে শ্রিপা দেবনাথকে। শ্রিপার নামে বিভিন্ন অশ্লীল ভিডিও, ছবি ছড়িয়ে দেয় ইউটিউব, ফেসবুক এবং অন্যান্যা সামাজিক মিয়িডাগুলোতে। শ্রিপার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জড় তুলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। মেয়েটিকে হয়রানি শিকার হতে হয় সমাজে, পরিবারের কাছে।
এই ভাবে চলতে থাকলে দেশে, তবে মেয়েরা কোথায় যাবে? কোথায় যেয়ে বিচার পাবে? পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই ভিকটিমরা সমান ভাবে বিচারের অধিকার পায়, আইন প্রকৃতি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনে এবং শাস্তি দেয়। কিন্তু এই দেশে বিচার ব্যবস্থা আজ নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দেখে তারপর বিচার করা হয়। বিচার ব্যবস্থা খুজে মেয়েটির ব্যক্তিগত জীবন ভালো না খারাপ! খারাপ হলে তো আরো খারাপ বানিয়ে ছাড়ে। আর ভালো হলে কিভাবে খারাপ তৈরি করবে সেটাই খুজে। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশ। “মেয়ে তুমি কবে বুঝবে তোমার অধিকার থাকা সত্যেও পুরুষ নামের কাপুরুষরা তোমার অধিকার কেড়ে নেয়।”
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:৪২