আমার এক বন্ধু বলেন, যারা ব্যর্থ; তারাই ব্লগ জগতে বিচরণ করেন।
কথাটা খুব নিষ্ঠুরভাবে বলা। এমন কথা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। মনে করি বাংলা ব্লগ একটি সৃজনশীল ও স্বাধীন চিন্তাচেতনার জায়গা। কিন্তু হিমু সাহেব সচলায়তনে যেভাবে কয়েকমাস ধরে খেললেন, তা দেখে সন্দেহ হয়। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট জয় নিয়ে তার এই তথাকথিত যুক্তিবাদী পোস্ট বাংলা ব্লগিং জগত সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। হিমুর ব্লগ, তার সাঙ্গপাঙ্গ আর ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাদের আস্ফালন দেখে মনে হয় বাংলা ব্লগ একটা আজাইরা তর্কের জায়গা। তাও ভালো সাম হোয়্যারে হিমু সাহেবের কোনো ব্লগ প্রকাশ পায় নাই। সচলায়তনে তো এক ব্লগ ৪৮ ঘণ্টা থাকে।
হিমু গংদের যুক্তিগুলো যে কু এবং আজাইরা তা একটু বোঝার চেষ্টা করি। তার আগে বলে নেই, সর্বশেষ যে পোস্টে হিমু পিছিয়ে গেছে তার অবস্থান থেকে, সেখানেও কিন্তু সে অবান্তর কিছু পয়েন্ট এনে মুসার এভারেস্ট জয় নিয়ে এখনও সন্দেহ প্রকাশ করছে। সে লিখেছে, ত্রিমাত্রিক মডেলিং করে দেখা গেছে ছবি গুলো ৮৭৫০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতা থেকে তোলা। আরও রেন্ডারিং হলে নাকি ডিটেইলস বলা যাবে।
তুই ব্যাটা কে সিদ্ধান্ত দেবার?
মুসার এভারেস্ট নিয়ে প্রথম সন্দেহ করে ফেসবুকে নোট লেখেন জনাব সজল খালেদ। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তিনি মেনে নেন যে মুসা এভারেস্ট জয় করেছে। একই সময়ে প্রথমে সন্দেহ প্রকাশকারী বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ক্লাড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) প্রধান ইনাম-আল হক স্বীকার করেন মুসা উঠেছিল। এসএমএস দিয়েছিলেন ২৬ মে। কিন্তু সেই এসএমএসে http://www.8000ers.com ওয়েবসাইটের রেফারেন্স ছিল। যাতে মুসার বিজয় নিয়ে কিছু লোকের সন্দেহ আছে নয় এমন কথা ছিল। ঘটনার পরম্পরায় এই সাইটে বিএমটিসির লোকজনই যে সন্দেহ করেছিল তা বোঝা যায়। আর সন্দেহটি ২৩ মে করা। এর পরে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে সাইটটি থেকে সন্দেহের বিষয়টি অপসারণ করা হয়।
২৩ মে বাংলাদেশের সব মিডিয়া মুসা ইব্রাহীমের গাইড সংস্থা, নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের সোর্স উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করেছিল। এভারেস্ট জয়ের প্রাথমিক খবর এভাবেই কনফার্ম করা হয়। বিবিসি ২৩ মে সন্ধ্যা সাতটার খবরে এ সংবাদটি দেয়নি। কারণ তারা নিজেদের সোর্স থেকে কনফার্ম না হয়ে কোনো নিউজ করে না। রাত ১০টা খবরে তারা মুসার এভারেস্ট জয়ের নিউজটা দেয়। ২৪ মে প্রধানমন্ত্রী মুসাকে অভিনন্দন জানান। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই অভিনন্দন জানানোর রীতি।
এরপর আসি তিব্বত কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি বিষয়ে। চাক্ষুস ও ছবি তোলার কিছু নির্দিষ্ট সাক্ষ্মের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ সনদপত্র দেয়। সেই সনদ মুসার আছে। ছবি মুসার আছে। সনদপত্রের ছবি প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। সেইটার বঙ্গানুবাদও ছাপা হয়েছিল। কিন্তু হিমু ও গং এসব কিছুর কথা উল্লেখ না করে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত খবরে লেখা সনদের বর্ণনায় বেশি জোর দেয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ব্লগেরই নানা আলোচনায় এসেছে স্টারের রিপোর্টার পিনাকি ফোনে বলেছেন সনদে কী লেখা আছে তা শুনে আরেকজন তা শ্রুতিলিখন করেছেন। কিন্তু এই ব্লগাররা প্রথম আলোয় যে স্ক্যান করা সনদ ছাপা হলো তা নিয়ে কথা বলে নাই।
ইনাম আল হক ১ জুন মুসা ঢাকায় ফিরে যখন প্রথম আলোতে আসেন তখন তাকে অভিনন্দিত করেন। সজল খালেদ ও ইনাম আল হক মেনে নেওয়ার পর বেশ কয়জন মুসা উঠে নাই এ মর্মে ব্লগ ও ফেসবুকে তড়পানো শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আসেন হিমু, কাজী মামুন এমন অনেকে।
মুসা এলেন ১ জুন। ২ জুন সংবাদ সম্মেলন করলেন। সেই সম্মেলনে শতাধিক ছবিও দেখালেন, শেরপাদের কথা শোনালেন তাদের মুখ থেকে, সনদ দেখালেন। অনেকের তীর্যক প্রশ্নের উত্তরও দিলেন। উল্লেখ্য মুসা যেদিন নেপালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, সেই ৮ এপ্রিল সকালে নর্থ আলপাইন ক্লাবে (গ্রিন রোড, ঢাকা) সংবাদ সম্মেলন করেন। কিন্তু সেই সম্মেলনের কথা হিমুরা মানতেই চাইলেন না। হিমুরা কোনো কিছুই শুনতে চান নাই। আর সচলায়তন (নাকি অচলায়তন) তা প্রকাশ করেই গেছে। মুসার সপক্ষে যারা ব্লগ লিখেছেন তাদের যুক্তিও তারা মানতে চান নাই। সচলায়তনের একজন মডারেটর হওয়ায় হিমু তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই নেভারেস্ট সিরিজ চালিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন আনিসুল হকের কি যোগ্যতা আছে নর্থ আলপাইন ক্লাবের সভাপতি হওয়ার? একজন তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে হিমুর কোন অধিকার আছে পর্বতারোহণ নিয়ে যুক্তি তর্কের উপস্থাপন করার?
শুধু মুসা নয় আনিসুল হক, প্রথম আলো, রবি, সিমু অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে নেভারেস্ট সিরিজ ও এর মন্তব্যসমূহে। একটা কথা বলি, সচলায়তন একবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে। তখন সচলায়তনের পক্ষে যে ব্যক্তি প্রথম উপ সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, সেই ব্যক্তিকেও আক্রমণ করা হয়েছে সচলায়তনে।
আমার একটা পর্যবেক্ষণ চর্চিত সুশীল ভাষায় যারা কথা বলে তাদের মনটা সুশীল নয়। অশুদ্ধ মন মানসিকতা তাদের। হিমুর ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ খাটে। সব কিছু দেখেও সে ছিল এক চোখা। কিছুই সে বিশ্বাস করে না। হিমু যে সাক্ষাকারগুলো নিয়েছে, তাতে ভাবটা এমন যে সে নিতান্তই কৌতুহলী হয়ে পর্বতারোহণ সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্ত প্রশ্নের মারপ্যাচে সে জানাতে চায় মুসার এভারেস্ট বিজয় সত্য নয়। কেন রে বাবা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই হতো যে মুসা উঠেছে কিনা তা বলেন।
আমরা যারা সাধারণ ব্লগ পাঠক বা ব্লগার আমরা গুগলে সার্চ দিয়ে যে ছবিগুলো পেয়েছি তা মুসার ছবির সঙ্গে মিলে যায়। এমন কিছু ছবি দিয়ে একটা পোষ্ট এই সামহোয়্যারে আমি নিজেই দিয়েছিলাম, কিন্তু তা নিমিষেই রিমুভ করা হয়েছিল। যা ছিল অপ্রত্যাশিত। তারপরও বলছি সামহোয়্যারের ভূমিকা মুসার এভারেস্ট জয়ের ইস্যুতে ইতিবাচক আজ পর্যন্ত।
সব মিলিয়ে হিমুর এই নেভারেস্ট বাংলা ব্লগের একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারণ তাদের এই সন্দেহ আর কু যুক্তি মাটির পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করে নি। বাংলাদেশের কোথাও কোনো প্রশ্ন উঠে নি মুসার এভারেস্ট জয় নিয়ে। সেই হিমু এখন ব্যাকফুটে। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো ব্লগে আজাইরা তর্কই শুধু করা হয়। হিমু দেখুন আপনি প্রবাসী হয়ে বাংলা ব্লগের কি ক্ষতিটাই না করেছেন।
নেপথ্য কারণ
হিমুদের এই তৎপরতার পেছনের নিছক তথাকথিত অনুসন্ধান নেই। এত আছে বাণিজ্য ধান্ধা। মুসা এভারেস্টে ওঠার পর এবং বিএমটিসির এম এ মুহিতের ব্যর্থতার পর মুসার গ্রহণযোগ্যতা আকাশচুম্বি। বিএমটিসি ও আরও কয়েকজন বার বার বলেছিলেন মুসা এভারেস্টে উঠতে পারবেন না। কিন্তু আজ মুসাই পেরেছে। তাই বিএমটিসি পৃষ্ঠপোষকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। পর্বতারোহন কার্যক্রম পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর। তাই যেহেতু অন্য ক্লাবটির ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে গেছে মুসার এভারেস্ট বিজয়ের পর তাই মুসার বিজয়ে কালিমা লেপন করে যদি নিজেদের পক্ষে কিছু জোগাড় করা যায় সেই চেষ্টা এখানে দেখা যায়। তাই হয়তো হিমু গং এত সিরিয়াস। কিন্ত সত্য কখনো চাপা থাকবে না। তাই হিমু আজ আত্মসমর্পিত। যদিও তার কুতর্ক থেমে নেই।
এই চার মাসে মুসা যে ধৈর্যশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা দেখার মতো। তিনি খুব সহজে বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (২০০৯-এ সংশোধিত)-এর ৫৭ ধারায় মামলা করতে পারতেন বা এখনও পারেন। ৫৭ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপ-ধারায় আছে 'কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিস্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষূন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরণের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।'
৫৭ (২) ধারায় আছে 'কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।'
সব কথার শেষ কথা হলো হিমু নেভারেস্টে নিজের নীচতা দেখিয়েছেন, বাংলা ব্লগের ক্ষতি করেছেন। এই ধরনের অপকর্ম যাতে ভবিষ্যতে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় তার জন্য ব্লগারদের প্রতি অনুরোধ রইল।
আর এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীমের প্রতি লাল সালাম....