আজ থেকে একশত বছর আগে ১৯১৪ সালে প্রথমবারের মত প্রকাশিত হওয়া নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’ সম্পর্কে ধারনা করা হয় যে, বাংলা ভাষায় লিখিত উপন্যাস সমূহের মধ্যে এটিই সর্বাধিক পঠিত। শতবর্ষে পদার্পণ করার পরও পাঠক সমাজ আনোয়ারা পড়ছে কেবল এ তথ্য থেকেই বোঝা যায় উপন্যাস হিসেবে এর সার্থকতা। আনোয়ারার শতবর্ষে পদার্পণ করা নিয়ে আমাদের দেশের কোন সাহিত্য পত্রিকায় কোন আলোচনা ছাপা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই, ছাপা হয়ে থাকলে তাদেরকে অভিনন্দন।
প্রকাশের শত বছর পর যখন এর মূল্যায়ন করতে বসেছি তখন স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে সময়ের সাথে সাথে উপন্যাসের আঙ্গিক ও গঠন কৌশলের পরিবর্তন এবং পাঠক সমাজের মানসিক বিবর্তনের কথা। এ উপন্যাসের ভুমিকা লেখা মমতাজ উদ্দিন আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, বর্তমান কালের পাঠকদের মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এখনকার উপন্যাস মানে আর শুধু কাহিনির বয়ান নয় বরং মনের বিকাশ। মুল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিকতা, অর্থনীতি, রাজনীতি বর্তমান কালের উপন্যাসের শরীরের স্তরে স্তরে প্রবাহমান। এখনকার উপন্যাস মানে যেই সমাজ নিয়ে উপন্যাসটি লিখিত সেই সমাজের সংস্কৃতি, সামাজিক মুল্যবোধ, ধর্ম, রাজনীতি এবং অর্থ ব্যবস্থার গলিঘুপচির স্বরূপ উন্মোচন তথা সেই সমাজের অসঙ্গতি সমুহের উপর নির্মম কুঠারাঘাত। শত বছর আগে লিখিত আনোয়ারাও ঠিক তেমনি সে সময়কার সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারনা দেয়।
নজিবর রহমানের আনোয়ারা পাঠের অভিজ্ঞতা ঠিক যেন দিবস রজনী অপেক্ষার পর প্রেমিকার প্রথম চুম্বনের মত ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তীব্র আনন্দদায়ী। আনোয়ারা দীর্ঘ কোন উপন্যাস নয়, তারাশঙ্করের হাঁসুলীবাকের উপকথার মত অগনিত চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেও সমগ্র উপন্যাসটির ব্যাপ্তি ৭৫ পৃষ্ঠার অধিক নয়। চরিত্রের সংখ্যা অধিক হলেও মূল চরিত্র আনোয়ারা এবং নুরল এসলামের চরিত্রের ব্যাপ্তি উপন্যাসের সীমা ছাড়িয়ে পাঠক হৃদয়ে আঘাত করতে সক্ষম। অন্যান্য চরিত্রের আবির্ভাব ক্ষণস্থায়ী হলেও সমগ্র উপন্যাসটিতে প্রভাব নিতান্ত কম নয়। মাত্র একটি দৃশ্যে উপস্থিত চতুর ফরমানের প্রভাব সমস্ত উপন্যাসটিকে আচ্ছন্ন করে রাখে শেষ লাইন পর্যন্ত।
উপন্যাসের শুরুতেই আমাদের পরিচয় হয় বাল্যকালেই মাকে হারানো নুরল এসলাম ও আনোয়ারার সাথে। নজিবর রহমান তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে এমন দুজন নরনারীকে বেছে নিয়েছেন যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই একশ বছর পরেও বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে পরম কাংখিত বলে মনে করা হয়।
উপন্যাসের শুরুতে লেখকের আবেগ নিয়ন্ত্রনে কিছুটা জড়তা লক্ষ্য করা গেলেও ঘটনার প্রবাহমানতার সাথে সাথে এসেছে সাবলীলতা এবং নাটকীয়তা।
মাতৃহারা আনোয়ারা স্বভাবে চরিত্রে শ্রেষ্ঠা হলেও বিমাতার চক্ষুশূলে পরিনত হয়। নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী ভেবে এতকাল গড়া তার অহংকারের সৌধ ঐটুকুন এক মেয়ের কাছে বিলীন হয়ে যেতে দেখার হতাশা থেকে উদ্ভুত ক্রোধ গোলাপজানকে আনোয়ারার প্রতি হিংস্র করে তোলে। বিমাতা গোলাপজানের চরিত্রে অনুপ্রানিত হয়েই হয়তো বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেলে চলা সিরিয়ালগুলোর নির্মাতারা শাশুড়ি চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন।
আনোয়ারার পিতা খোরশেদ ভুঁইয়াও যেমন ব্যক্তিত্বহীন, অর্থলিপ্সু তেমনি মেরুদন্ডহীন। জামাতাকে হত্যা করে তার অর্থ হস্তগত করার জন্য স্ত্রী প্ররোচিত করলে তিনি যখন এটা যে অন্যায় সেকথা মনে করিয়ে দেন ঠিক তার পর মুহূর্তেই দেখা যায় স্ত্রীর ধমকে কাবু হয়ে সেই অন্যায় কাজ করতেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। শেষ অবধি দুজনে মিলে অর্থের লোভে হত্যা করেন নিজেদেরই প্রাণাধিক পুত্রকে।
নুরল এসলামকে দেখা যায় সৎ মায়ের শত অন্যায় অত্যাচারেও তার প্রতি নিজের দায়িত্ববোধের কথা ভুলে না যেতে। এমনকি চাকুরীস্থলে যে রতিশবাবু এবং দাগু বিশ্বাস তাকে এতবড় বিপদে ফেলল তাদেরকে পর্যন্ত অকারন সন্দেহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মহত্বের পরিচয় দিতে। দুই সখী আনোয়ারা এবং হামিদার স্বামী নুরল এসলাম এবং আমজাদ হোসেনের পরিছয় পর্বটিও নাটকীয়তায় ভরপুর। ট্রেনে কাকতালীয়ভাবে একই চেহারার দুজন দুজনকে আবিষ্কার এবং বিপদের মুখে একজনের ভার অন্যজনের নেয়ার মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্বের সূচনা তা পূর্ণতা পায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অন্যজন জেলে জাওয়ার পর তাকে ছাড়ানোর মধ্য দিয়ে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আনোয়ারা যেন স্বভাবশসুশীলা, স্বামী অন্তপ্রান বাঙ্গালী নারীর এক আদর্শ উদাহরন। যার ভুবন মোহিনী রূপে মুগ্ধ হয়ে স্বভাবতই মুখরা বাঙলার নারী সমাজকেও দেখা যায় স্বভাব বিরুদ্ধ প্রশংসায় মেতে উঠতে। পিতার আদর ও দাদির আনুকুল্য তাকে বিমাতার অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট না হলেও সৎ মায়ের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে হবার চক্রান্ত থেকে সে যাত্রা তাকে রক্ষা করে নুরল এসলাম। কিন্তু নুরল এসলামের সাথে বিয়ের পর সেখানেও জোটে সৎ শাশুড়ির অত্যাচার। শাশুড়ির সমস্ত অন্যায় স্বামীগৃহে কলহ না বাধানোর অভিপ্রায়ে চুপচাপ সহ্য করা, স্বামী অসুস্থ হলে রাত জেগে তার সেবা করা, এমনকি সরল বিশ্বাসে স্বামীর রোগমুক্তির জন্য নিজের প্রান উৎসর্গ করতে চাওয়া সব কিছুতেই যেন এক সতী সাধ্বী সরলা বাঙ্গালী নারীর জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। শেষ পর্যন্ত তহবিল তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত স্বামীকেও বাঁচালেন নিজের অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মাধ্যমে।
সমস্ত উপন্যাসটি জুড়ে ন্যায় এবং অন্যায়ের মধ্যে বিরোধে নীতি নৈতিকতার জয়জয়কার ঘোষিত হয়েছে।
আজকের সমাজ বাস্তবতায় নৈতিকতা এবং মুল্যবোধ যখন সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যখন ঘোরতর সন্দেহের জালে নিমজ্জিত তখন পাঠক সমাজকে আমন্ত্রন নজিবর রহমানের আনোয়ারা পাঠের মাধ্যমে আনোয়ারা এবং তার স্বামীর মধ্যকার সম্পর্কের স্বরূপটি উন্মোচন করতে।