বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে মুস্তাফিজুর রহমান ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছেন। রূপকথার নায়কদেরও হারমানিয়ে তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। রূপকথার রাখাল রাজার মতো তিনি সুন্দরবনের (সাতক্ষীরা) কোল থেকে উঠে এসেছেন। পড়া বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য বাবার কাছে মার খেয়েছেন। বড়ো ভাই মোখলেসুর রহমানের পেছনে মোটরসাইকেলে চড়ে ৪০ কিলোমিটার দূরের জেলা শহর সাতক্ষীরায় গিয়ে অনুশীলনের গল্প এখন কিংবদন্তী। তাঁর বাণী "বোলিং নো প্রোবলেম, ব্যাটিং এন্ড স্পীকিং প্রোবলেম" এখন টক অব দা ক্রিকেট ওয়ার্লড।বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের জন্য মুস্তাফিজের উপহার সানরাইজার্স হায়দরাবাদের মেন্টর লক্ষ্ণণ, অধিনায়ক ওয়ার্নারের বাংলা শিক্ষণ। কারণ তাঁদের সাথে কথা বলার জন্য মুস্তাফিজ ইংরেজী শিখছেন না, বরং মুস্তাফিজের সাথে কথা বলার জন্য তাঁরা বাংলা শিখছেন।
মুস্তাফিজের উঠে আসার গল্প মাত্র বছর পাঁচেকের। জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে মাগুরার বিরুদ্ধে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। আগুন ঝরল তাঁর বলে। পেলেন দুই উইকেট। ভাইয়ের কাছে মুস্তাফিজের আবদার ছিল একজোড়া নতুন জুতার। মোখলেসুর কথা দিলেন, পরের ম্যাচে তিন উইকেট নিতে পারলে আবদার পূরণ করা হবে। মুস্তাফিজ কুষ্টিয়ার বিরুদ্ধে পরের ম্যাচেই নিলেন তিন উইকেট। মোখলেসুর পরদিন মুস্তাফিজকে কিনে দেন একজোড়া স্পাইক বুট। বড়েয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ। তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন স্থানীয় কোচ আলতাফ। আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ভেতরের ‘ধারটা’। হিরে চিনে নিয়ে ঘষামাজার কাজটি তিনি শুরু করে দেন। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তইলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাস্সিনুল ইসলাম। এলাকায় অবশ্য ‘তপু ভাই’ বলে পরিচিত তিনি। সকলের পরিশ্রমের প্রতিদান দিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ।
৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার মুস্তাফিজের জন্ম ১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। বাবা আবুল কাশেম গাজী আর মা মাহমুদা খাতুনের ৬ সন্তানের (৪ ছেলে ২ মেয়ে) মধ্যে মুস্তাফিজ কনিষ্ঠ।সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে মুস্তাফিজদের বাড়ি। এ বাঁহাতি মিডিয়াম পেসার শুরুতে কিন্তু ছিলেন ব্যাটসম্যান।
২০১২ সালে ঢাকা এসে বিসিবির ফাস্ট বোলিং ফাউণ্ডেশনে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে অনুর্ধ-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলেন আরব আমিরাতে। সে টুর্নামেন্টে পান ৮ উইকেট (দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। ২০১৪ সালেই খুলনা বিভাগের হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে এবং আবাহনী লিমিটেডের হয়ে লিস্ট-এ ক্রিকেটে অভিষেক হয় মুস্তাফিজের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খুলনার হয়ে মাত্র আট ম্যাচ খেলেই পেয়েছেন ২৩ উইকেট। গড় ১৮.৯১, ইকোনমি ২.৬৮। আর লিস্ট এ-তে আবাহনীর পক্ষে ৫ ম্যাচে উইকেট ১২টি। গড় মাত্র ১১.৭৫, ইকোনমি ৩.৪৫। বাংলাদেশ-এ দলের হয়ে খেলতে যান ওয়েস্ট ইণ্ডিজে। সেখানেও সবার নজর কাড়েন।
২এপ্রিল ২০১৫ তারিখে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারেই অধিনায়ক মাশরাফি বল তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আর প্রথম বলে ওয়াইড। কিন্তু তারপরেই তো হয়ে উঠলেন বিস্ময়! চার ওভারের স্পেলে ডট বলই ষোলটা। পাকিস্তানী অধিনায়ক আফ্রিদির দাবিমতো টি-টোয়েন্টি ‘স্পেশালিস্ট’ দলটির বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স তো বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না। সে ম্যাচে রীতিমতো কাঁপন ধরিয়ে দিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের। প্রথম ২ ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ৪ রান। পুরো স্পেল শেষে ২০ রান খরচ করে নিয়েছেন দুইটি উইকেট। সাজঘরে ফিরিয়েছেন শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের মতো দুই কিংবদন্তী ব্যাটসম্যানকে।
১৮ জুন ২০১৫ তারিখে ভারতীয় দলের বিপক্ষে অভিষেক হয় মুস্তাফিজের। ৯.২ ওভার বল করে ৫০ রানে নেন ৫ উইকেট। তিনি সেদিন সাজঘরে ফিরিয়েছেন রোহিত শর্মা, আজিঙ্কা রাহানে, সুরেশ রায়না, রবীন্দ্র জাদেজা আর অশ্বিনকে। যথারীতি তিনিই ম্যান অব দা ম্যাচ। দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে আবার ম্যান অব দা ম্যাচ। শেষ ম্যাচে ২ উইকেট নিয়ে ৩ ম্যাচ সিরিজে ১৩ উইকেট নিয়ে গড়েন বিশ্বরেকর্ড।
তাঁর টেস্ট অভিষেক হয় ২১ জুলাই ২০১৫ তারিখে দোর্দণ্ড প্রতাপ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। মুস্তাফিজ ১৭.৪ ওভারে ৩৭ রানে ৪ উইকেট নেন। এবার তাঁর শিকার গ্রেট হাশিম আমলা, জে পি ডুমিনি, কুইন্টন ডিকক আর বাবুমা। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচ ড্র। মুস্তাফিজ ম্যান অব দা ম্যাচ। আবার বিশ্ব রেকর্ড। অভিষেক টেস্ট আর অভিষেক ওডিআইতে ম্যান অব দা ম্যাচ হতে পেরেছেন শুধু মুস্তাফিজই।
২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে ইনজুরির জন্য প্রথমে খেলতে পারেননি। কিন্তু শেষ ৩ ম্যাচে নেন ৯ উইকেট। নিউ জিল্যাণ্ডের বিপক্ষে তাঁর ৫ উইকেট বিশ্বকাপের সেরা বোলিং।
আইসিসির ওডিআই বিশ্ব একাদশে ঠাঁই মেলে মুস্তাফিজের।
ইনজুরির জন্য পাকিস্তান সুপার লীগে খেলা হয়নি।
প্রথম বারের মতো খেলছেন আইপিএল-এ। ১২ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়েছেন। আইপিএল-এ তাঁর বোলিং জাদুতে মুগ্ধ ক্রিকেট বিশ্ব। ক্রিকেট গ্রেটদের প্রসংশায় ভাসছেন ফিজ। ধারাভাষ্যকারদের বিশেষণের ভাণ্ডারে পড়েছে টান। তাঁরা ফিজের কীর্তি বর্ণনার ভাষা হারিয়েছেন।
টি২০ উইকেটের হাফসেঞ্চুরী হয়ে গেছে ( আন্তর্জাতিক ১৩ ম্যাচে ২২ উইকেট, বিপিএল-এর ১০ ম্যাচে ১৪ আর আইপিএল-এর ১২ ম্যাচে ১৪ উইকেট)। এই রেকর্ডে তাঁর আগে আছেন শুধু শ্রীলঙ্কার অজন্তা মেণ্ডিস।
ক্রিকেট বিশ্বে চলছে মুস্তাফিজ বন্দনা। মহান সাকিব আল হাসানকেও কি এবার একটু ম্লান মনে হচ্ছে না ?
মুস্তাফিজের ক্রিকেটীয় তথ্যভাণ্ডার-
http://www.espncricinfo.com/bangladesh/content/player/330902.html
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:৪১