বাংলা নববর্ষ বরণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড়ো উৎসবে পরিণত হয়েছে। দিনদিন তার উজ্জ্বলতা বাড়ছে। বড়ো ব্যবসাদাররা এর পৃষ্ঠপোষকতাও শুরু করে দিয়েছে। বর্তমানে যে ধারায় বাংলা নববর্ষ পালিত হচ্ছে তার সূচনা খুব বেশী আগে হয়নি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি করছে। আর চারুকলার শোভাযাত্রাটি শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সাল থেকে। এই কয় বছরেই তা ফুলেফেঁপে এভাবে বেড়ে উঠেছে। এই উদযাপনের রীতিটি একেবারেই নাগরিক। পান্তা-ইলিশ খেয়ে একটা গ্রামীন ভাব আনার চেষ্টা ধাকলেও তার সাথে গ্রামের কোন সংযোগ নেই।
আমাদের শৈশবকালে ১৯৬৯/৭০ সালের দিকে দেখেছি গ্রামের দিকে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো আর হতো বৈশাখী মেলা। বাজারের দোকানগুলোতে হতো হালখাতা। বাবা চাচার হাত ধরে দোকানে যেতাম। প্রথমেই মিস্টিমুখ করানো হতো। বড়োরা পান মুখে দিয়ে কিছু টাকা দিতেন। সেই টাকা নতুন বাকীর খাতায় তুলে নতুন হিসাব নিকাশ শুরু হতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে হিন্দু পরিবারগুলোতে বিশেষ ধরণের খাবার তৈরী হতো। কোন কোন মুসলমান বাড়িতেও তার কিছু ছাপ দেখতাম। বিশেষ করে তিতা আইটেম থাকতো। গাছভরা ছোট ছোট আম থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তি পার না হলে আমরা সে পিচ্চি আম খাওয়া শুরু করতাম না।
মেলাগুলো বসতো মাঠের মাঝে কোন বড়ো গাছের নীচে। কোন কোনটা বাজারের অদূরে সে রকম কোন খোলা জায়গায়। বড়োদের হাত ধরে অনেক মেলায় গেছি। মূলত: ফসল আর ঘরে তৈরী নানা জিনিস মিলতো সেখানে। নানা ধরনের মিষ্টি. জিলাপী,বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি, খই ইত্যাদি পাওয়া যেতো। পাওয়া যেত অনেক রকমের খেলনা, বাঁশি,বেলুন, শাড়ী চুড়ি, লেইস ফিতা, আলতা সাবান ইত্যাদি। নানা রকমের খেলার আয়োজন হতো। ছিলো লোকগানের আয়োজন। দোলনা আর চরকী চড়ার প্রতি ছিলো অনেক আকর্ষণ। সবার সাথে ভাববিনিময়ের পাশাপাশি ব্যবসাবাণিজ্য ছিলো মূল লক্ষ্য। কিছুটা বদলে গেলেও নানা উপলক্ষে আয়োজিত গ্রামীণ মেলাগুলোর বেশীরভাগ এখনো চালু আছে। নানা উপলক্ষে তার আয়োজন চলে। কিছু কিছু মেলা এক/দুই সপ্তাহ ধরে চলে। জয়পুরহাট জেলার পুনট মেলা চলে একমাস, গোপীনাথপুরের মেলা চলে পনের দিন।
অবাক আঁধার !
বাংলা সনের ঠিকুজি খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এর নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের কোন হদিশ নেই। সেখানে রাজত্ব করছে অজানার এক অবাক আঁধার। মাত্র দুটি বইতে সন তারিখের বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে। একটি আল বিরুনীর ’’ভারততত্ত্ব”’ আর একটি আবুল ফজলের ’’আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’’। সেখানেও বাংলা সনের উল্লেখ নেই। আর সব ইতিহাস বইতে কোন ঘটনার সন তারিখ নিয়ে বহু বাকবিতণ্ডার দেখা পেলেও সনতারিখের কোন ইতিহাস নেই। সব ইতিহাস বইতে দেখি খ্রীস্টাব্দের রাজত্ব। যদিও এই খ্রীস্টাব্দ-প্রবন ইতিহাস চর্চা এমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যে, মানুষ যেন যুগযুগান্তকাল ধরে খ্রীস্টাব্দ ব্যবহার করে আসছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে বর্তমান খ্রীস্টিয় তথা গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার ১৫৮২ সালে চালু করেন ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী। কিন্তু সেটা সবাই তখনই মেনে নেয়নি। খোদ বৃটিশরাই এই ক্যালেণ্ডার গ্রহণ করতে প্রায় দু’শ বছর দেরী করেছে। বৃটিশ ভারতে ইংরেজরাই এর চর্চা করেছে সীমিত পরিসরে। বৃটিশ শাসনাধীন বাংলায় আইন করার সময়, বৃটেনে যোগাযোগের জন্য লেখালেখিতে বা অফিসে এই ক্যালেণ্ডার ব্যবহৃত হলেও খাজনা আদায় হয়েছে বাংলা সন ধরে। এখনো ভূমি সংক্রান্ত সকল কর আদায় বা একসনা সব বন্দোবস্ত বাংলা ক্যালেণ্ডার অনুসারেই হয়। অথচ বাংলা সনেরই শুরুর কাহিনীর কোন হদিশ নেই !
সন তারিখের খোঁজখবর
ক্যালেণ্ডার ব্যবহারের ইতিহাস ৬ হাজার বছরের। এই ক্যালেণ্ডার ব্যবহারের গৌরব প্রাচীন মিশরীয়দের। প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেণ্ডারটি ছিলো সৌর ক্যালেণ্ডার। প্রাচীন ব্যবিলনীয়, গ্রীক আর রোমান ক্যালেণ্ডারও ছিলো সৌর ক্যালেণ্ডার। কারণ এই চার সভ্যতাই ছিলো কৃষি নির্ভর তথা ঋতু নির্ভর। মিশরের কৃষি নির্ভর করতো নীল নদের বার্ষিক বন্যার ওপর। যা পুরোটাই ঋতু নির্ভর। মিশরীয় ক্যালেণ্ডারে ছিলো ১২ মাস। প্রতি মাসে ৩০ দিন। আরো ৫ দিন তারা ব্যয় করতো দেবতার জন্মবার্ষিকীর উৎসবে। সে ৫ দিন কোন মাসের সাথে যোগ করা হতো না। তবে বছরে মোট দিন দাঁড়াতো ৩৬৫। অধিবর্ষ সম্পর্কিত ৪ বৎসরান্তের কোন দিন যোগ করতো না তারা।
বেবিলনের ক্যালেণ্ডার ২৭০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে তৈরী অর্থাৎ ৪৭০০ বছরের পুরনো। তারা বছর গুনতো ৩৬০ দিনে। ১২টি চান্দ্র মাসের প্রতিটিতে ছিলো ৩০ দিন করে। ঋতুর সাথে ফারাক মেটাবার জন্য তারা প্রতি ৬ বছর পর পর একমাস বাড়িয়ে নিত (১৩ মাসে বছর)।
মায়া সভ্যতার চিহ্ন হিসাবে যে ক্যালেণ্ডার পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ৩ হাজার বছর। তারা ‘Venus year’ ব্যবহার করতো।
প্রতি মাসে ২০ দিন, ১৮ মাসে বছর। মোট ৩৬০ দিন। সাথে জুড়ে নিত আরো ৫ দিন। এই ৫টি দিনকে তারা অশুভ বলে গন্য করতো।
আমরা মূলত: ব্যবহার করছি খ্রীস্টিয়, হিজরী আর বাংলা ক্যালেণ্ডার। এবার তাই এ তিনটাতেই মনোনিবেশ করি।
রোমান থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার
রোমানরা প্রথম গ্রহণ করে গ্রীক ক্যালেণ্ডার। তখন বছর ছিলো ৩০৪ দিনের। ১০টি মাস। মার্চে বছর শুরু হয়ে ডিসেম্বরে শেষ। শীতের বাকী দিনগুলোতে তারা কোন কাজ করতো না বলে ক্যালেণ্ডারেও রাখতো না। এ সময়কে বলা হতো হাইবারনেশন। অনুমান করা হয় খ্রীস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে রোমের রাজা Numa Pompilus জানুয়ারী আর ফ্রেব্রুয়ারী মাস যুক্ত করে ১২ মাসে বছর গনণা শুরু করেন। শীতের সময়ের না গোনা দিনগুলো পড়ে এই দুই মাসের ভাগে। জুলিয়াস সিজার রোমের সম্রাট হবার আগে পর্যন্ত এ বিষয়টি সুশৃঙ্খল ছিলো না। ক্যালেণ্ডারের হিসাবের গোলমালের জন্য ঋতুচক্রের সাথে সঙ্গতি বিধানের জন্য সম্রাট জুলিয়াস সিজার ৪৬ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে এক রাজকীয় ডিক্রি বলে সে বছরকে ৪৪৫ দিনের বছর হিসাবে ঘোষণা করেন। সে সাথে বছরের দৈর্ঘ্য স্থির করেন ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা। প্রতি মাসে দিন হবে ৩০/৩১। বাড়তি ৬ ঘন্টার সমন্বয়ের জন্য প্রতি ৪ বছর পর পর ৩৬৬ দিনের লীপ ইয়ার চালু করেন। আগে বছর শুরু হতো সূর্যের মহাবিষুবে (vernal equinox ) প্রবেশের সময় অর্থাৎ মার্চে। তিনি তা রদ করে প্রতি বছর ১ জানুয়ারী বছর শুরুর আদেশ দেন। সে থেকে এ ক্যালেণ্ডার জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার হিসাবে পরিচিত হয়। এ সংস্কারের পরও সৌর বছরের চেয়ে সাড়ে ১১ মিনিট দীর্ঘ হয় জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের বছর। শত শত বছরের এই গরমিলের ফলে আবার ঋতুর সাথে ক্যালেণ্ডারের গরমিল হয়ে যায়।
এই গরমিল দূর করার জন্য পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার সংশোধনের উদ্যোগ নেন। সে সংস্কারের প্রধান দিক ছিলো ৩টি। প্রথমত: ২১ মাচ সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সাথে মিল রাখার জন্য ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১০দিন বাদ দেন। ফলে সে বছরের ক্যালেণ্ডারে বৃহস্পতিবার ৪ অক্টোবর আর শুক্রবারকে ১৫ অক্টোবর লেখা হয়। দ্বিতীয়ত: সৌর বছরের দৈর্ঘ্যের সাথে সঙ্গতি রাখার জন্য প্রতি ৪০০ বছরের মধ্যে ৩টি লীপ ইয়ার বাদ দেবার ব্যবস্থা করেন। ফলে শতাব্দী পূর্ণকারী বছর (যথা ১৫০০, ১৬০০ সাল) হলে যে সব বছর ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হবে না সেগুলো লীপ ইয়ার হবে না। ফলে ১৯০০ সাল লীপ ইয়ার ছিলো না ২০০০ সাল লীপ ইয়ার ছিলো। তৃতীয়ত: এই হিসাবে চান্দ্র তিথির সাথে কোন মিল না রাখায় চান্দ্র তিথি নির্ভর ধর্মীয় পর্ব যথা ইস্টার সানডে, গুড ফ্রাইডে ইত্যাদি যথাসময়ে না আসায় তার এক হিল্লে করার দরকার হয়। এ জন্য সৌর বছর আর চান্দ্র মাসের অনুপাতের মধ্যে সূক্ষ্ণ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ফলে নতুন নিয়মে ইস্টার সানডের তিথিটি ৫৭ লক্ষ বছরে একবার আবর্তিত হবে।
এ ক্যালেণ্ডারে দিনের শুরু হয় মধ্য রাতে অর্থাৎ রাত ১২টার পরের সেকেণ্ড থেকে।
এই ক্যালেণ্ডারে মাসের নাম গুলোর তাৎপর্য হলো- জানুয়ারী(৩১দিন)- (ল্যাটিন জানুয়ারীয়াস) দেবতা জানুসের নাম হতে এসেছে। ফেব্রুয়ারী(২৮/২৯)- (ল্যাটিন ফেব্রুয়ারীয়াস) পিউরিফিকেশন উৎসব ফেব্রুয়া হতে এসেছে। মার্চ (৩১দিন)-(ল্যাটিন মার্টিয়াস) দেবতা মার্সের নাম হতে এসেছে। এপ্রিল (৩০দিন)-(ল্যাটিন এপ্রিলিস) গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি মতান্তরে ল্যাটিন শব্দ aperire হতে এসেছে। মে (৩১দিন)-(ল্যাটিন মাইয়াস) দেবী মায়ার নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুন (৩০দিন)- (ল্যাটিন জুনিয়াস) দেবী জুনোর নাম হতে এসেছে বলে অনুমান করা হয়। জুলাই (৩১দিন)- (ল্যাটিন জুলিয়াস) সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নাম হতে এসেছে। আগস্ট (৩১দিন)-(ল্যাটিন অগাস্টাস) রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নাম হতে এসেছে। সেপ্টেম্বর (৩০ দিন)- (ল্যাটিন সেপ্টেম্বর)- সেপ্টেম অর্থাৎ সাত হতে এসেছে। এটা প্রাচীন রোমান ক্যালেণ্ডারের সপ্তম মাস ছিলো। অক্টোবর (৩১ দিন)- (ল্যাটিন অক্টোবর) অক্টো অর্থাৎ আট হতে এসেছে। এটা রোমান ক্যালেণ্ডারের অষ্টম মাস ছিলো। নভেম্বর (৩০দিন)-(ল্যাটিন নভেম্বর) নভেম অর্থাৎ নয় থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেণ্ডারের নবম মাস ছিলো। ডিসেম্বর(৩১দিন)-(ল্যাটিন ডিসেম্বর) ডিসেম অর্থাৎ দশ থেকে এসেছে। রোমান ক্যালেণ্ডারের দশম মাস ছিলো। সিজারের সংস্কারের ফলে শেষ চারটি মাসের নাম সংখ্যার বিচারে ভুল হিসাবে চালু আছে অর্থাৎ বছরের ৭,৮,৯,১০ নং মাসের বদলে এখন ৯,১০,১১ ও ১২ নং মাস হিসাবে আছে।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরীর এ সংস্কার ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা মেনে নিলেও প্রোটেস্টান্টসহ অন্য অনেকেই মেনে নিতে অনেক বিলম্ব করেছে। ১৫৮২ সালেই নতুন ক্যালেণ্ডার গ্রহণ করে ইতালী, পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড এবং পোল্যাণ্ড-এর ক্যাথলিক রাষ্ট্রসমূহ। ১৫৮৪ সালে গ্রহণ করে জার্মানী ও সুইজারল্যাণ্ড-এর ক্যাথলিক রাস্ট্রসমূহ। ১৫৮৭ সালে হাঙ্গেরী। ১৭০০ সালে জার্মানী, সুইজারল্যাণ্ড ও হল্যাণ্ডের প্রোটেস্টান্ট রাষ্ট্রসমূহ, ডেনমার্ক ও নরওয়ে তা গ্রহণ করে। ১৭৫২ সালে তা গ্রহণ করে বৃটেন (আমেরিকান কলোনীসহ), ১৮৭৩ সালে জাপান, ১৮৭৫ সালে মিশর, ১৯১৮ সালে রাশিয়া, ১৯২৪ সালে গ্রীস, ১৯২৬ সালে তুরস্ক ও ১৯৪৯ সালে চীন তা গ্রহণ করে। বৃটেন ও রাশিয়ায় এটা গ্রহণের সময় আবার অক্টোবর মাসে ১১ দিন বাদ দিতে হয়েছে জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সাথে তৈরী হওয়া ব্যবধান ঘুচানোর জন্য। সেটা নিয়ে ব্রটেনে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। রাশিয়ায় তাই অক্টোবর বিপ্লবের বার্ষিকী পালিত হয় নভেম্বরে।
বৃটিশ উত্তরাধিকার থেকেই আমরা ব্যবহার করছি গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার।
হিজরী সনের কথকতা
হযরত মুহম্মদ ( সা: ) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের (৬২২ খ্রীস্টাব্দে) স্মরণে প্রবর্তিত হয় হিজরী সন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ( রা: ) ৬৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দে এ ক্যালেণ্ডার চালু হয়। সূর্যাস্ত থেকে দিন গণনা শুরু করা হয়। ১২টি চান্দ্র মাস ( মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ,জিলহজ্জ্ব) নিয়ে গঠিত। অমাবশ্যা শেষে চন্দ্রোদয় থেকে আরেক অমাবশ্যা পর্যন্ত ২৯/৩০ দিনে হয় মাস। সাধারণত: একটি মাস ৩০ দিনে হলে পরের মাসটি ২৯ দিনে হবে, তার পরেরটি আবার ৩০, তার পরেরটি ২৯ এভাবে আবর্তিত হয়। হিজরী বছরে ৩৫৪ দিন। গড় চান্দ্রযুতিকাল ২৯.৫৩০৫৮৮১ দিন হিসাবে ১২ চন্দ্রযুতিতে হয় ৩৫৪.৩৬৭১ দিন। অর্থাৎ হিজরী বছর চান্দ্র বছর থেকে ০.৩৬৭১ দিন কম। এই ঘাটতি সমন্বয় করার জন্য ৩০ বছরের একটা পুনরাবৃত্তি চক্র স্থির করা হয়। ঐ ৩০ বছরে মোট ১১ বার পূর্বনির্ধারিত চান্দ্র বছরের শেষ মাস জিলহজ্জ্ব মাসে ১ দিন যোগ করে ২৯ দিনের স্থলে ৩০ দিন করা হতো। ৩০ বছরে ৩৫৪*৩০=১০৬২০ দিনের সাথে ১১ দিন যোগ করে ১০৬৩১দিন হিসাব করা হয়। এর ফলে গড় চন্দ্রযুতি বা চান্দ্র মাসের স্থায়িত্ব দাঁড়ায় ২৯.৬৩০৫৬৬ দিন। যা বর্তমান চান্দ্র মাস থেকে মাত্র ০.০০০০৩২ দিন কম। এ ৩০ বছরের চক্রে কোন ১১টি বছর অধিবর্ষ হবে তা নির্ধারণ করা হয় এভাবে- হিজরী সনটিকে ৩০ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল ২,৫,৭,১০,১৩,১৬,১৮,২১,২৪,২৬ বা ২৯ হলে বছরের শেষের মাসে অর্থাৎ জিলহজ্জ্ব মাসে ১দিন যুক্ত হবে।
এই হিজরী ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী মুসলমানদের যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হয় সারা পৃথিবীব্যাপী। এ ছাড়া মুসলিম শাসনামলে তাদের সকল রাজ্যে সরকারী কাজে হিজরী ব্যবহার করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলেও হিজরী ছিলো সরকারী ক্যালেণ্ডার। এখনো সৌদী আরবে তা সরকারী ক্যালেণ্ডার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও হিজরী ক্যালেণ্ডার অনুসরণ করে। এটা সেখানে এখনো সম্ভব কারণ তাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর নয়, বাণিজ্য নির্ভর।
বাংলা সনের কথা
বাংলা সনের প্রচলন নিয়ে সরাসরি কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান নেই। আমাদের ইতিহাসচর্চার ভিত্তি হচেছ রাজা বা রাজবংশের ঠিকুজি, আধিপত্যবাদী ধনিক শ্রেণীর জীবন ইতিহাস আর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার আর শিলালিপি পাঠ। আমাদের সনাতন ইতিহাস চর্চায় এদেশের মূল জনগোষ্ঠী তথা কৃষকের জীবনাচরণ সরাসরি উপেক্ষিত। এটাই বাংলা সনের কোন খোঁজ না থাকার কারণ। এই কৃষক জীবনের সাথেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা সনের প্রকৃত যোগাযোগ। তাই ভায়া পথে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাংলা সন প্রচলন নিয়ে ৪টি মত চালু আছে। সম্প্রতি জয়নুল আবেদীন খান ’’বঙ্গাব্দ’’ নামে একটি বইতে ৫ম মত প্রকাশ করেন।
সব চেয়ে প্রচলিত মতটি হলো মুঘল সম্রাট মহামতি আকবর এই সনের প্রবর্তন করেছেন। মূলত: অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে এম,এ, পাশ করা বিহারের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়ালই (১৮৮১-১৯৩৭) প্রথম নানা যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন আকবর এর প্রবর্তক। পরে বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ও ভারতের ক্যালেণ্ডার সংস্কার কমিটির প্রধান ড.মেঘনাদ সাহা, নোবেল পুরষ্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ড.অমর্ত্য কুমার সেন, প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতাভ ভট্টাচার্য (দ্য বেঙ্গলী এরা ইন দ্য ইন্সক্রিপশনস অফ লেটার মেডিয়েভাল বেঙ্গল, খণ্ড ১৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ভূতপূর্ব কারমাইকেল অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই মত সমর্থন করেন। তাঁদের যুক্তি হলো আকবর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন তখন ছিলো ৯৬৩ হিজরী। বর্তমান বাংলা সনের হিসাব অনুযায়ীও তখন ছিলো ৯৬৩ সাল। আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে আকবর নতুন সন ’’তারিখ-ই-ইলাহী’’ চালু করেন তাঁর সিংহাসন আরোহনের বছর তথা ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকারিতা দিয়ে। তখন ৯৬৩ হিজরী। এখন চলছে ২০১২ সাল। ড.মেঘনাদ সাহার অনুসরনে যদি হিসাব করি তাহলে দেখা যায় ৯৬৩+২০১২-১৫৫৬=১৪১৯। এ বছর বাংলা ১৪১৯ সাল শুরু হতে চলেছে। ড. সাহা লিখেছেন, হিজরী সন চালু করার একটা কারণ ছিলো ধর্মীয় উৎসব পালনের দিনক্ষণ বের করার জন্য সাধারণ মানুষকে যেন আলেমদের ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয়। এই ক্যালেণ্ডার সৌর বছরের যে কোন সময়ে শুরু হতে পারে। ফলে ঋতু নির্ভর সরকারী কার্যক্রমে এর প্রয়োগে অসুবিধা দেখা দেয়। ১০৭৯ খ্রীস্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দীন মালিক শাহ ইরানে সৌর ক্যালেণ্ডার চালু করেন। এর নাম জালালী ক্যালেণ্ডার বা মালিকী ক্যালেণ্ডার। আকবর সেটাই তারিখ-ই-ইলাহী নামে চালু করেন। ( বস্তুত পক্ষে জালালী ক্যালেণ্ডার নামে পরিচিত এই ইরানী সৌর ক্যালেণ্ডারটি সুলতানের অনুরোধে সংস্কার করেন সে কালের শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কবি ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি। হিসাবেরর গরমিলের জন্য নওরোজ বসন্তের সূচনায় আসছিল না বলেই এ সংস্কারের দরকার পড়ে। এ কাজটিই পোপ গ্রেগরী ওমরের ৫শ’ বছর পরে করে বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারটি চালু করেন)
আকবরের সভাপণ্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সংস্কার কাজটি করেন। হিজরী থেকে সন নিয়ে জালালী ক্যালেণ্ডারের গণনা পদ্ধতিকে মিলিয়ে দেন। মাসের নামগুলো ছিলো ফারসী। এর বিস্তারিত বিবরণ ও সম্রাটের ডিক্রির তথ্যাদি লিখা আছে আবুল ফজল আল্লামীর লেখা আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরীতে।
এখানে যে দুটি প্রশ্নের কোন তথ্যভিত্তিক জবাব নেই তা হলো তারিখ-ই-ইলাহী শুরু হয় সূর্যের মহাবিষুবে প্রবেশের সময় অর্থাৎ মার্চ মাসে আর বাংলা সন শুরু হয় এপ্রিলে এবং আকবরের ক্যালেণ্ডারের মাসের নাম ফারসি আর বাংলা সনের মাসের মাসের নাম কার্যত: বাংলায়। এ বিষয়ে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সম্ভাব্য কারণ হলো বাংলায় সৌর বঙ্গাব্দ প্রচলনের সময় ঐ অঞ্চলে সমধিক জনপ্রিয় অব্দ সৌর শকাব্দের উপস্থিতি। শকাব্দের আরম্ভ বৈশাখ মাসে। যে অভ্যাসের বশে সৌর এলাহী অব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগন পরিচিত মাসক্রম ব্যবহার করতেন সে অভ্যাসেরই পুনরাবুত্তি বঙ্গাব্দের মাসক্রমে দেখা যেতে পারে।
বঙ্গাব্দ প্রচলনের বিষয়ে আরেকটি প্রধান মত হলো গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্ক এর প্রচলন করেছেন। শ্রী সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় একটি বই লিখে এই মত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে ৫৯৪ খ্রীস্টাব্দের ১২ এপ্রিল বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়েছে এবং ঐ দিনই শশাঙ্ক গৌড় বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। ড.অতুল সূরসহ কেউ কেউ এ মত সমর্থন করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এই মতের সপক্ষে কিছু বলতে হলে প্রথমেই প্রমান করতে হবে শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রীস্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা তখন তিনি রাজত্ব করতেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন নিশ্চিত প্রমান নেই। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে শশাঙ্ক সপ্তম শতকের প্রথমভাগে রাজত্ব করতেন। তাছাড়া ৫৯৩-৯৪ সাল থেকে পরবর্তী এক হাজার বছরে এমন কোন নথিবদ্ধ তারিখ পাওয়া যায়নি যাকে নিশ্চিতভাবে বঙ্গাব্দের সাথে যুক্ত করা যায়। শশাঙ্কের রাজ্যের সবচেয়ে বিস্তৃত সীমানার মধ্যে পরবর্তী হাজার বছরে যে বিরাট সংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্ণ নেই। তবে,আমার মতে, সুনীল মুখোপাধ্যায় নিজেই নিজের বক্তব্যকে দুর্বল করেছেন এই বলে,''আপাতত প্রত্যক্ষ প্রমান না থাকলেও আনুষঙ্গিক প্রমানে প্রমাণিত যে শশাঙ্কের আমলেই বঙ্গাব্দের সূচনা।''
বঙ্কিমচন্দ্র যদিও ১৮৬৫ সালে (১২৭২ বাংলা সাল?) দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে বঙ্গাব্দের কথা উল্লেখ করেছেন তা ইতিহাসসিদ্ধ বাংলা সন না। বঙ্গাব্দ কিছুটা আধুনিককালের শব্দ। ( আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ দানিশাব্দা নামে ভিন্ন এক ক্যালেণ্ডারের বিষয় উল্লেখ করেন। তাতে ১২৪৮ বঙ্গাব্দা বলে বাংলা তারিখের উল্লেখ দেখা যায়।) এখনো গ্রাম বাংলায় লোকজন বলে বাংলা সন বা বাংলা সাল। সন আরবী আর সাল ফারসি শব্দ। ব্রতীন বাবুর মতে এটাও বাংলা সন চালুর সাথে কোন মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার প্রমান দেয়। ১২০৮ শকাব্দে নারদীয় পুরানের উত্তরভাগের এক পুঁথিতে বাংলা সনকে জ(য)বনে নৃপতে শকাব্দ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেও বাংলা সন চালুতে মুসলিম শাসকের যুক্ত থাকার অনুমান করা যায়।
পুঁথি গবেষক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের মতে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সন চালু করেছেন। বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তবে সুলতানী আমলের বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক সুখময় মুখোপাধ্যায় হোসেন শাহ কর্তৃক বাংলা সন চালুর কোন তথ্যপ্রমান পাননি। যতীন বাবুও তেমন কোন শক্ত তথ্যপ্রমান হাজির করেননি।
খ্যাত নামা প্রাচ্যবিদ সিলভাঁ লেভি ’লে নেপাল’ বইতে বলেছেন ৬০০ খ্রীস্টাব্দের কিছু আগে সংস্রন নামে এক তিব্বতী রাজা মধ্য ও পূর্বভারত জয় করেন। তিনিই তার নামের শেষের ’সন’ যুক্ত করে বাংলা সন চালু করেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতে এই সম্ভাবনা নেই। কারণ সংস্রন কর্তৃক বাংলা আক্রমনের কোন তথ্য বা কোন সন তারিখ চালু করার বিষয়েও কোন তথ্য প্রমান নেই।
জয়নুল আবেদীন খান ’’বঙ্গাব্দ’’ নামক বইতে বিক্রমপুরের রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক বঙ্গাব্দ চালু হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এর সমর্থনে যে সব যুক্তি প্রমান দাখিল করেছেন তা যথেষ্ট নয়। এর সমর্থনে কোন সরাসরি দলিলও তিনি হাজির করতে পারেননি। ৫টি কারণে তিনি আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন না। কারণগুলো,তাঁর মতে, ১.আকবরের রাজ্যের ১২টি প্রদেশের মধ্যে সুবে বাংলায় তিনি সন করেছেন, অন্য কোন প্রদেশে করেননি। তাই এ দাবী গ্রহণ যোগ্য নয়। ২. আকবরের সন চালুর সময় বারো ভূঁইয়ার কারণে বাংলা অশান্ত ছিলো। তাই সন চালু হতে পারে না। ৩. বাঙালীর জীবন জীবিকার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিলো না। আগ্রহ ছিলো খাজনার প্রতি। তাই বাংলা সন চালু করেছেন আকবর তা তিনি মনে করেন না। ৪. কোন মুসলমানের চালু করা সন হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে ( কারণ এতে ধর্মীয় আচারাদীর সংশ্লেষ আছে) তা মেনে নেবার কথা নয়। ৫. আকবরনামা বা আইন-ই-আকবরীতে বাংলা সনের উল্লেখ নেই তাই বাংলা সন আকবর চালু করেননি। এর পর তিনি বলেন, এ দেশেরই কোন প্রজাহিতৈষী ও কীর্তিলিপ্সু হিন্দু বা হিন্দু ভাবাপন্ন রাজা বা রাজপুরুষ একটি সমন্বয়বাদী সন হিসাবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেই রাজা হিসাবে তিনি বল্লাল সেনকে এর প্রবর্তক মনে করেন। কেন মনে করেন তার কোন সরাসরি কারণ তিনি দেখাতে পারেননি।
তাঁর মতের মধ্যেই স্ববিরোধিতা আছে। আকবর তার পুরো সাম্রাজ্যের জন্যই ক্যালেণ্ডার চালু করেছেন। আলাদা কোন প্রদেশের জন্য নয়। যারা এই সন চালুর বিষয়ে আকবরের কথা বলেন তারা সেই সনের ভিত্তিতে বাংলা সন চালুর কথা বলেছেন। পৃথক সন প্রবর্তনের কথা বলেননি। বারো ভূঁইয়ারা কিছু কিছু অঞ্চলে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখলেও প্রাদেশিক সরকার ছিলো আকবরের। বাঙালীর জীবিকার প্রতি আগ্রহ ছিলো না এ তথ্য তিনি কোথায় পেলেন ? রাজা টোডরমলের নেতৃত্বে ভূমি ও রাজস্ব সংস্কার আকবরের শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হয়ে আছে। তর্কের খাতিরে যদি তাঁর মতের সাথে একমত হয়ে বলি আকবরের আগ্রহ ছিলো খাজনায়, তাহলে সন চালুর দাবীই বরং জোরালো হয়। কারণ আকবর সন সংস্কার করেছিলেন খাজনা আদায়ের জন্যই। মুসলমানের চালু করা সন হিন্দুরা যদি না মানে ( তাঁর কথা অনুযায়ী) তাহলে হিন্দুর চালু করা সন মুসলমান মানবে কেন ? কারণ বাংলা সনের সাথে হিন্দুদের ধমীয় আচারদির মিল থাকলেও মুসলিমদের কোন ধর্মীয় আচারের সাথে বাংলা সনের সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনি যে সমন্বয়বাদিতার কথা বলছেন সে সমন্বয়ের চিহ্ণ কই ?
তিনি বৌদ্ধ ও মগদের সাথে সম্পর্ক দেখিয়ে বল্লাল সেনকে এর জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোন যৌক্তিক সমীকরণ টানার যে পদ্ধতি ঐতিহাসিকরা ব্যবহার করেন তা করেননি। কি কি প্রক্রিয়ায় কি কারণে বল্লাল সেন বাংলা সন চালু করেছেন তারও কোন বিবরণ দেননি। বরং সমাপনী বক্তব্যে নিজেই নিজের মতের বিরোধী(পরষ্পর বিরোধীও বটে) মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন,''বাংলা সনে চান্দ্র হিজরী সনের ইসলামী ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতীয় সৌর সনের বৈজ্ঞানিকতা যুক্ত হয়েছে। এই সনের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধের দিন ও মাসগুলো আছে। আছে বর্ষ শুরুর মাস হিসেবে ভগবান বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র বৈশাখ মাস।আছে সূর্য পূজার অনুষঙ্গ চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক উৎসব। আছে মগ রাজাদের নব বর্ষের খাতা উৎসব। আর আছে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মোহাম্মদের ( সা: ) মদীনা গমন, হিজরী সন ও মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের সিংহাসন আরোহন।'' এ বক্তব্য দিয়ে তিনি পুরো বিষয়টি কিন্তু আকবরের দিকেই নিয়ে গেলেন। কারণ আকবরের তারিখ-ই-ইলাহীর ভিত্তিই এইগুলো।
বাংলায় আমরা যে মাসগুলো ব্যবহার করি তা এসেছে মূলত: জ্যোতিষশ্রাস্ত্র ও শকাব্দ থেকে। এর প্রতিটি এসেছে নক্ষত্রের নাম থেকে। চাঁদ সূর্যকে বছরে ১২ বার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবারে গড়ে সময় লাগে ৩০ দিন। চাঁদের এই আবর্তন থেকেই মানুষ মাসের ধারণা গ্রহণ করেছে। এই ১২ বার প্রদেক্ষিণের পথে ২৭টি নক্ষত্রের সাথে চাঁদের মোলাকাত হয়। বাংলা মাসের ক্ষেত্রে মূলত: যে নক্ষত্র মণ্ডলে ঢোকার পর চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় সেই নক্ষত্রের নামেই ঐ মাসের নাম রাখা হয়েছে। সে হিসাবে বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনীকুমার থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা বা অগ্রহায়নী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মাঘী থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
বাংলা বছরের সূচনা নিয়েও আছে নানা মত। সিলেট থেকে সংগৃহীত পুঁথি ’আবিরার বার মাসী’ তে বলা হয়েছে পরথমে আগন মাস ঘরে ঘরে ধান/তুমি নি আইছরে বন্ধু এমন পাষাণ? কার্তিক মাসের দিনে বছরের শেষ/ না আইলা আবিরার সাধু ছাড়িয়া বৈদেশ। এ্ থেকে সেই কালে অগ্রহায়ণ মাসে বছর শুরুর প্রমান পাই। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যেও পাই ’’হায়নের অগ্র অগ্রহায়ণ জানিয়া/ শুভ দিনে পুণ্যাহ করিলা বিচারিয়া। এখানেও অগ্রহায়ণে বছর শুরুর প্রমান পাই। মূলত: মাসের নামের মানেও তাই। এ নত্রটির নাম মৃগশিরা। সে অনুযায়ী মাসের নাম ছিলো মার্গ শীর্ষ অর্থাৎ বছরের শুরু। এর বিকল্প নাম অগ্রহায়ণ। এর অর্থও বছরের শুরু। নবান্ন উৎসবেও সূচনার আভাস মিলে। কিন্তু কবে সেটা ছিলো কবে সেটা বদলালো তার কোন খোঁজ মিলছে না।
কোন কোন বইতে পাই চৈত্র মাসে বছরের শুরু। ১৮০৭ থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যে লিখিত চার্লস স্টুয়ার্ট রচিত ’’বাংলার ইতিহাস’’ বইতে বছরের প্রথম মাস হিসাবে চৈত্র মাসের কথা বলা আছে।
ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার বারমাসী এবং রংপুরের কবি রচিত কমলার বারমাসীতে বৈশাখে বছর শুরু চৈত্রে শেষ। শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাব্যে জুলেখার বারমাসী মাঘ মাসে শুরু পৌষে শেষ। দৌলত কাজীর সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী এবং আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে বারমাসী আষাঢ় মাসে শুরু হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসে শেষ হয়েছে।
ফলে কবে থেকে বাংলা সন বৈশাখে শুরু হলো তার প্রমান নেই। অর্থাৎ বাংলা সনের ইতিহাসের পুরো বিষয়টি এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়নি।
আমরা যে বাংলা সনটি ব্যবহার করি তা নানা সংস্কারের মাধ্যমে এখানে এসেছে। ১৯৫৭ সালে ড.মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে গঠিত ক্যালেণ্ডার সংস্কার কমিটির সুপারিশ ভারত সরকার গ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে ভাষাবিদ পণ্ডিত ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমী বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সে কমিটি ড. মেঘনাদ সাহার প্রতিবেদন সামনে রেখে কাজ করেছে। শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্টে লীপ ইয়ারসহ কিছু জটিলতা নিরসনের জন্য বাংলা একাডেমী ''বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি'' গঠন করে। কমিটি শহীদুল্লাহ কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কিছু সুপারিশ করে। পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২৬ জুলাই ১৯৯৫ তারিখে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালককে আহবায়ক করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্সের প্রধান সুপারিশগুলো ছিলো-
(ক) সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জীর বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস (৫ মাস) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র (৭ মাস) পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩০ দিন গণনা করা হবে। (এটি শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশের সাথে অভিন্ন);
(খ) গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষ রূপে গন্য করা হবে এবং অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে;
(গ) ১৪০২ সালের ১লা বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর হবে এবং তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী মধ্যরাত ১২.০০টায়।
এখন বাংলাদেশে এ ক্যালেণ্ডার চালু আছে। কিন্ত বাংলাদেশ ও ভারতে বিশেষত: পশ্চিম বঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনো আদি পঞ্জিকা অনুসারে আচারাদি পালন করেন। তাই দুটি ক্যালেণ্ডারে প্রায়ই গরমিল দেখা দেয়। ফলে চৈত্র সংক্রান্তি বা ১লা বৈশাখ ভিন্ন দিনে পালিত হয়।
সমাপনী
দীর্ঘ দিন থেকে বাংলা সন তারিখ নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত শামসুজ্জামান খান মুনসী সলিমুল্লাহর ’’তারিখ-ই-বাঙ্গালা’’ বইয়ের কিছু তথ্যের আলোকে অনুমান করেন কেন্দ্রীয়ভাবে আকবর প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহীকে ভিত্তি ধরে আঞ্চলিক ফসলী সন হিসাবে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। তাঁর মতে, মুর্শিদাবাদের নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে পূণ্যাহ প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা সন ও নববর্ষ পালনের সূচনা করেন। ব্যবসায়ীরা চালু করেন হাল খাতা। জনাব খানের এই মতটি বেশ যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। তবে এর সমর্থনে আরো তথ্যপ্রমান হাজির করার প্রয়োজন আছে।
যে দুটি ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থে সন আরিখের কথা বলা আছে সেখানে বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। ১০৩১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত আল বেরুনীর ’’ভারততত্ত্ব’’-এ শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দের উল্লেখ আছে। বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল আল্লামীর ’’আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরী’’ বইতে সে সময় সারা বিশ্বে প্রচলিত প্রায় সকল ক্যালেণ্ডারের উল্লেখ আছে কিন্তু বঙ্গাব্দের কথা নেই। আবুল ফজল যে বাংলা সম্পর্কে জানতেন তার প্রমান তার বইতে আছে। এ দু’টি আকরগ্রন্থে বঙ্গাব্দের উল্লেখ না থাকা প্রমান করে আল বেরুনীর বই লেখার সময় বা তার আগে (১০৩১ খ্রীস্টাব্দ) অথবা আকবরের রাজত্বের আগে বঙ্গাব্দের প্রচলন থাকার কোন দলিল নেই। এটা আকবর প্রবর্তিত বলে প্রমান না দিলেও তার আগে যে প্রবর্তিত হয়নি সেটার প্রমান দেয়।
আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আমাদের ঘরে ঘরে যে ক্যালেণ্ডার শোভা পায় তা গত ২৫/৩০ বছরের ঘটনা। তার আগে স্বচ্ছল ঘরে কিছু ক্যালেণ্ডার চোখে পড়তো। প্রকৃত পক্ষে সন তারিখ দরকার হতো ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে। তার মূল অবলম্বন ছিলো পঞ্জিকা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা লোকনাথ ডাইরেক্টরী বা গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত দেখতেন বা এখনো দেখেন। আর মুসলমানরা মোহাম্মদী পঞ্জিকা দেখেন। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান বা ইহুদী সবার ধর্মীয় অনুষ্ঠান চান্দ্র তিথি অনুসারে পালিত হয়।
আমার অনুমান আকবর প্রচলিত ফসলী সন আর বিদ্যমান পঞ্জিকাকে মিলিয়ে বাংলা সনের প্রচলন পঞ্জিকাকারগণও করে থাকতে পারেন। এই ভাবনা থেকে পঞ্জিকা নিয়ে তত্ত্বতালাশ শুরু করেছি। এখনো তেমন উৎসাহব্যঞ্জক কিছু পাইনি। যতো দিন এর কোন বিহিত না হচ্ছে ততোদিন সর্বাপেক্ষা যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাবটির পক্ষেই আমার অবস্থান। অধ্যাপক ব্রতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলি-
’’...আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে আকবরের রাজত্বের পূর্বে বাংলা সন বঙ্গাব্দ ব্যবহারের কোন নিশ্চিত প্রমান নেই।এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও আলোচিত তথ্যাদি আকবরের আমলে চান্দ্র হিজরী অব্দের সংস্কারের মধ্যেই বঙ্গাব্দের সূচনার ইঙ্গিত করে। এর বিপরীতে কোন ঘটনা নির্দেশক বিশ্বাসযোগ্য তথ্যসূত্র আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই মতই গ্রহণযোগ্য।’’
(কিছু আপডেট করা হলো। আরো আপডেট করা হবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ সকাল ৯:২৯