সামহোয়্যারইনব্লগ ওরফে 'সামু'র তথাকথিত 'স্বর্ণযুগ' এর সময় আমি এখানে ছিলাম না। এমনকি এর নামটিও জানতাম না। আমার এক ভাগ্নের মুখে প্রথম এর নাম শুনি। সে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল এখানে লিখতে। তারপর আরেকদিন কি যেন একটা বিষয় সার্চ করতে গেলে এর লিঙ্ক ভেসে উঠে। প্রথম দিনই 'আমি ময়ূরাক্ষী' নামের একজন ব্লগারের চমৎকার একটি পোস্ট পড়ে মুগ্ধ হই। তারপর আর দেরি না করে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলি এবং তিনদিনের মধ্যেই 'নিরাপদ' ছাড়পত্র পাই। সেটা আজ থেকে সাড়ে সাত বছর আগের কথা। তখন থেকেই এখানে লিখে চলেছি, মাঝে মাঝে কয়েকটা ছোট ছোট অপরিহার্য বিরতিসহ। প্রথম থেকেই এখানে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি। আমি ব্লগিং এর সময় লেখকের বয়স, লিঙ্গ, পেশা, এলাকা, রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্মবিশ্বাস কিংবা ধর্মহীনতা ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়ে তাকে বয়স নির্বিশেষে একজন সুহৃদ সহব্লগার হিসেবে গণ্য করে তার লেখা পড়ি ও মন্তব্য করি। যে পোস্টই পড়ি না কেন তা মনোযোগ সহকারে পড়ি এবং যথাসম্ভব প্রাসঙ্গিক ও বস্তুনিষ্ঠ মন্তব্য করতে চেষ্টা করি। সুযোগ পেলেই পোস্ট প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা মন্তব্যে উল্লেখ করি। প্রথম থেকেই তাই অনুজ অগ্রজ (হাতে গোণা কয়েকজন অগ্রজ হবে হয়তো বা) প্রায় সকলের উৎসাহ অনুপ্রেরণা লাভ করে এ ব্লগে আমার বিচরণ দুই একটা হেঁচকি ব্যতীত উপভোগ্যই ছিল, যা নিরন্তর আমাকে নিয়মিতভাবে এখানে লিখে যাবার উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছে। কিন্তু যতই দিন এগোচ্ছে, ততই একের পর এক নোংরা পরিস্থি্তির উদ্ভব হয়ে ব্লগের পরিবেশের ক্রমাবনতি ঘটাচ্ছে। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় ব্লগের পাঠক সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করে একটা পোস্ট দিলে তা দুইশত বার পঠিত হতে বেশ কয়েকদিন লেগে যায়, আগে যেটা অনায়াসেই চারশত বা ততোধিক সংখ্যায় পঠিত হতো দুই এক দিনেই। এ পরিসংখ্যানটা অবশ্য আমার মত সাধারণ ব্লগারের জন্য প্রযোজ্য, কিছু জনপ্রিয় ব্লগারের পোস্ট এর ব্যতিক্রম। তাদের পোস্ট এখনও অনায়াসে বহুল পঠিত হয়।
ব্লগে নিয়মিতভাবে লিখে যাবার কারণে আমি নিজেই বুঝতে পারি, আমার লেখায় আগের চেয়ে কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। তবে আমি লক্ষ্য করেছি যে নিয়মিতভাবে লিখে যাবার কারণে আমার চেয়েও দ্রুত এবং অধিকতর উন্নতি সাধিত হয়েছে আমার পরে যোগদান করা বেশ কয়েকজন ব্লগারের। তাদের মধ্যে দু'জনের নাম তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে। এদের একজন ওমেরা এবং অপরজন মিররডডল। প্রথম জন বেশ কিছুদিন ধরে বিনা ঘোষণায় ব্লগে অনুপস্থিত রয়েছেন, অপরজন এখনও সোৎসাহে লিখে চলেছেন। দু'জনই ভালো লিখেন, দু'জনেরই সেন্স অভ হিউমার চমৎকার। এত দেরিতে ব্লগে যোগদানের পরেও সেই সময়ের ব্লগকে আমি আমার বিবেচনায় অত্যন্ত প্রাণবন্ত পেয়েছি। তবে ব্লগে লিখতে পড়তে গিয়ে আমার স্বভাবজাত অনুসন্ধিৎসা বশতঃ আমাকে প্রায়শঃ পিছু হটতে হয়েছে। আর এ পিছু হটা মানে কিন্তু ব্লগ পরিত্যাগ নয়, ব্লগের একেবারে গোড়ায় গিয়ে দেখে আসা, তখন ব্লগটা কেমন ছিল। আমি তখনকার দিনের ব্লগিং দেখে বিস্মিত হয়েছি, চমৎকৃত হয়েছি। তখনও ঘন ঘন 'ক্যাচাল' হতো, তবে সারবত্তাসমৃদ্ধ লেখা থাকতো তার চেয়ে অনেক বেশি। ঝগড়াঝাটি হতো প্রচুর, কিন্তু মানবিক বিষয়াবলীতে সবাই একাট্টা হয়ে এগিয়ে আসতো। এখনও যে ভালো পোস্ট আসে না, তা নয়। তবে সংখ্যাটা অনেক কমে গেছে। এর কারণ, অনেক সুলেখক ব্লগ ছেড়ে চলে গেছেন, নতুনরা যারা আসছেন তারাও কিছুদিন চুপ করে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে নীরবে প্রস্থান করছেন। এ প্রস্থানের কারণ কী, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক পোস্ট ও পরামর্শও এসেছে, কিন্তু অবস্থার উন্নতির বদলে ক্রমাবনতি হয়েই চলেছে।
ব্লগের পাঠক ও লেখক সংখ্যা কমে যাবার কারণ হিসেবে মোটা দাগে যা উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে অন্যান্য সামাজিক মিডিয়ার তুলনায় এখানে রেস্পন্সের ধীর গতি, সেলফোনে মোবাইল ডাটার মাধ্যমে ব্লগে প্রবেশ করতে না পারা, একজন নবাগত ব্লগারের পোস্টের প্রথম পাতায় প্রবেশাধিকার পেতে অত্যধিক বিলম্ব, এক প্রকারের 'সিন্ডিকেট' গঠনের মাধ্যমে লেখকের পোস্টে বিরূপ ও অযৌক্তিক মন্তব্যের 'ফ্লাডিং' এবং অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় লেখক এবং মন্তব্যকারীদের উপর আক্রমণ, ইংরেজিতে যা 'বুলিইং' নামে খ্যাত। 'ফ্লাডিং' এখন অনেক কমে গেছে, তবে গুটিকয়েক প্রশ্রয়দাতার উৎসাহে 'বুলিইং' এখনও পুরোদমে চলছে। এ প্রক্রিয়ায় একজন ছদ্মনামী নিগ্রহকারী ক্রমাগতভাবে প্রায়শঃ দাপটপূর্ণ পদ্ধতিতে অন্যকে (লেখক/মন্তব্যকারী পাঠককে) নিরুৎসাহিত, নিগ্রহ এবং হেয় প্রতিপন্ন করে থাকেন। এর কারণে বেশ কয়েকজন ব্লগার চিরতরে এ ব্লগ ছেড়ে চলে গেছেন।
সমগ্র বিশ্বের উন্মুক্ত সাইবার স্পেসে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় করে তোলার অনন্য অবদানের জন্য 'সামহোয়্যারইনব্লগ' একদিন যথাযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হবে, এ আশা দুরাশা নয়। আমরাও সেদিন একজন ব্লগার হিসেবে এ গর্বের অংশীদার হবো। এ ব্লগ অনেক অন্তর্মুখী ব্যক্তির লেখালেখির জন্য একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, যারা অন্যত্র তাদের লেখা প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত। এখানে লেখালেখি করেই অনেক ব্লগার লেখকে পরিণত হয়েছেন বলে জানি। তাই এ ব্লগ যেন অন্যান্য ব্লগের মত হারিয়ে না যায়, সে লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেকের যথাসাধ্য অবদান রাখতে হবে। উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বাধাসমূহ নিরসনের ব্যাপারে ব্লগ কর্তৃপক্ষ অবহিত, সচেতন ও সক্রিয় রয়েছেন বলে আমরা প্রায়শঃ তাদের ঘোষণার মাধ্যমে জানতে পারি। তাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, সেটা তারা করুক। আমাদের পক্ষে যেটা করা সম্ভব, সেটা আমরা, ব্লগাররা করতে থাকি। একজন ব্লগারকে হতে হবে একাধারে একজন পাঠক, লেখক এবং পর্যবেক্ষক। এই তিনটি ভূমিকাতেই আমাদেরকে মূল্যবান অবদান রাখতে হবে। ভালো লেখক হয়তো অনেকেই হতে পারেন, কিন্তু একজন ভালো পাঠক ও পর্যবেক্ষক সবাই হতে পারেন না। পাঠাভ্যাস না থাকলে একজন ভালো পাঠক হওয়া যায় না। একটি ভালো লেখা ভালো পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে। অনেক নীরব পাঠককে আমি একজন ভালো পর্যবেক্ষক হতেও দেখেছি।
এবারে নবাগত ব্লগারদের উদ্দেশ্যে আমি কিছু আবেদন (পরামর্শ নয়) রাখছি। আমি লক্ষ্য করেছি, আপনাদের অনেকেই ব্লগে একটা লেখা পোস্ট করেই চলে যান অথবা নীরব পাঠকের ভূমিকায় থাকেন। সেটা করবেন না। একটা লেখা পোস্ট করলে অন্যের অন্ততঃ তিনটা পোস্ট পড়ুন। পোস্ট পড়ার পর, পোস্ট প্রসঙ্গে দু'চার লাইনের হলেও একটা মন্তব্য রাখুন। আপনার পোস্টে যারা মন্তব্য করেন, অবশ্যই তাদের অন্ততঃ একটা পোস্ট পড়ে আপনিও মন্তব্য রাখুন। যারা আপনার পোস্টে কোন মন্তব্য করেন নাই, তাদের মধ্য থেকেও দুই একজনের লেখা বেছে পড়ুন। কিছুদিন ব্লগে উপস্থিত থাকলেই বুঝতে পারবেন কাদের লেখা আপনার পড়তে ভালো লাগে। তাদেরকে একে একে আবিষ্কার করতে থাকুন। ইতিবাচক, কিন্তু নির্মোহ মন্তব্যের মাধ্যমে সহব্লগারদের সাথে পারস্পরিক সৌহার্দ্য গড়ে তুলুন। এগুলো করলে দেখবেন, প্রথম পাতায় প্রবেশাধিকার পেতে আপনাদের বেশি সময় লাগবে না। এখানে আমরা যারা ব্লগিং করি, সবাইকে পরিণত বয়স্ক ও মনস্ক বলে গণ্য করা হয়। এদেরকে ধর্ম জ্ঞান বা রাজনীতি জ্ঞান দানের প্রয়াস থেকে বিরত থাকুন। ধর্ম বা রাজনীতি সম্পর্কে আপনার নিজস্ব মতামত, জ্ঞান বা অবস্থান ব্যক্ত করতে পারেন, তবে তা যেন প্রচারধর্মী না হয়। প্রচারধর্মী কাজের জন্য অন্য অনেক ফোরাম রয়েছে, প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে তা করুন। যা কিছুই লিখবেন, আপনার মৌলিক চিন্তাভাবনা থেকে লিখবেন। অন্যের কথা থেকে লিখলে অবশ্যই তা উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে লিখবেন এবং মূল লেখকের নামোল্লেখ করবেন। অন্যের কোন লেখা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ায় কোন মহিমা নেই, চৌর্যবৃত্তির গ্লানি আছে। এই ব্লগে অনেক পড়াশুনা করা ঋদ্ধ পাঠক আছেন, যাদের সতর্ক চোখ ফাঁকি দিয়ে কোন কুম্ভীলকের পার পাওয়া দুষ্কর। বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্লগারের নিজস্ব সম্মান এবং সম্মানবোধ রয়েছে। আপনার লেখা পোস্ট কিংবা মন্তব্যের দ্বারা তার উপর যেন কখনো কোন আঘাত না আসে। ভাষা ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। তা যেন কখনোই রূঢ়, শিষ্টাচার বহির্ভূত কিংবা মানহানিকর না হয়। কোন পেশাকে হেয় করে লিখবেন না। মানুষ যে পেশার মাধ্যমে তার রুটি-রুজি আয় করেন, সে পেশাকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক কোন মন্তব্য সহ্য করতে পারে না। শুদ্ধ বানান ও সঠিক শব্দচয়নে লিখতে অভ্যস্ত হতে থাকুন। কেউ কোন ভুল ধরিয়ে দিলে তার উপর ক্ষেপে না গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে ভুল শুধরে নিন। শুরুতেই খুব বড় কিংবা খুব ছোট পোস্ট লিখবেন না। মোটামুটি ৮০০-১০০০ শব্দ সংখ্যার একটি পোস্ট ব্লগ পোস্ট হিসেবে উপযুক্ত এবং সর্বশ্রেণির পাঠকের নিকট সহজপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্লগ একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের উন্মুক্ত স্থান, তবে সে চর্চাটা হতে হবে অবশ্যই শালীনতা ও শিষ্টাচারের ঘেরাটোপের মধ্যে। অন্যথায়, এটা অচিরেই একটি দুর্গন্ধময় ভাগাড়ে পরিণত হবে। সেটা যেন না হয়, সেজন্য কর্তৃপক্ষের যেমন কড়া নজর এবং প্রয়োজনবোধে 'শাসন' রাখা উচিৎ, ব্লগারদেরও তেমনি আত্ম-নিষেধাজ্ঞাবোধ প্রয়োগ করে সংযমী হওয়া উচিৎ। সবাই জানে, কোন দুর্গন্ধময় স্থানে একমাত্র দুর্গন্ধ সন্ধানকারী ব্যতীত অন্য কেউ বেশিক্ষণ টিকতে পারে না।
(শেষের অনুচ্ছেদটি একজন ব্লগারের ব্লগপোস্টে গতকাল করা আমার নিজের মন্তব্য থেকে উদ্ধৃত)
ঢাকা
০৩ এপ্রিল ২০২৩
শব্দ সংখ্যাঃ ১২১৪