"কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনায়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে"
১১১৪৪৩ জুন ২০২২
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে” .....
এ কবিতাটি ঠিক আষাঢ় মাসে লিখা না হলেও (রচনার তারিখ ও স্থানঃ ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭, শিলাইদহ) কবিগুরু এর নাম দিয়েছিলেন ‘আষাঢ়’, কারণ বাংলা পঞ্জিকার তৃতীয় এই মাসটিতে বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের মনের যে অবস্থা হয়, তারই একটা রেখাচিত্র তিনি এ কবিতাটিতে এঁকেছিলেন। আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখনও আষাঢ় মাস আসতে দিন দুই বাকি। গত কয়েকদিন ধরে মেলবোর্নের আকাশটা আমাকে বাংলার আষাঢ়ে আকাশটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময়েই এখানকার আকাশটা মুখ গোমরা করে থাকছে। সূর্য যে একেবারেই ওঠে না, তা নয়। দিনে কয়েকবার ওঠে, তখন ঘণ্টাখানেকের জন্য চারিদিক ঝলমলিয়ে ওঠে ঠিকই, আবার পরক্ষণেই যেন কোথা থেকে ধূসর কিংবা কালো মেঘের দল এসে আকাশটাকে ঢেকে দেয়, কনকনে বাতাস শুরু হয়, সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও। বাতাসের বেগ মাঝে মাঝে এত বেশি থাকে যে সে সময় ঘরের বাইরে থাকলে ছাতা সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
আবহাওয়ার এমন খেয়ালি আচরণে মনের মাঝেও এক বিষণ্ণ ভাবের সৃষ্টি হয়। বেশ কিছুদিন ধরে এমনই হচ্ছে। তাই গত পরশুদিন হঠাৎ করেই ঠিক করলাম, যত ঠাণ্ডাই পড়ুক, আমরা দু’জন ঘর থেকে বের হয়ে একটু দূরে কোথাও যাবো। ঠাণ্ডার বিরুদ্ধে যতটুকু প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, মোটামুটি সবই নিলাম। তবুও বুড়ো হাড্ডি বলে কথা। কনকনে বাতাসের সাথে সাথে হাড়গুলোও নড়ে চড়ে ওঠে। গতবারে যখন এসেছিলাম, তখন কিছুদিন পর পরই আমরা সাগর সৈকতে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতাম। তখন বাসার কাছাকাছি কয়েকটা বীচ ছিল। তার উপর গ্রীষ্মকাল ছিল বলে খুব কম প্রস্তুতিতেই ঘর থেকে বের হওয়া যেত এবং বীচের ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর কাঁপতো না, বলা যায় জুড়িয়ে যেত। এবারে এখনো কোন বীচে যাওয়া হয় নাই। সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে একের পর এক আসতে থাকা সরব জলরাশির নীরব ভাষা শোনা হয় নাই। এখন যেখানে থাকি, সেখানে খুব কাছে ধারে কোন বীচ নেই। তাই কোন বীচে যাবো, সেকথা ভাবছিলাম। তখন মনে পড়ে গেল, গতবার একদিন আমরা দু’জন ট্রেনে করে Frankston Station গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাসে করে Mornington Beach এ গিয়ে আমরা সেই এলাকাটির অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। Frankston যাবার পথে ট্রেনের কামরা থেকে Carrum স্টেশনটির ওপাশে একটি বিস্তীর্ণ তটরেখা দেখে আমি তখনই মনস্থ করেছিলাম, ফেরার পথে Carrum স্টেশনে নেমে কিছুটা ক্ষণ সেখানে কাটিয়ে পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর সেখানে নামা হয়নি, কিন্তু ট্রেন থেকে দেখা বীচের ছবিটা মনে গেঁথে ছিল। কয়েকদিন পরে আবার আসবো বলে তখন ভেবেছিলাম। কিন্তু এর কয়েকদিন পর থেকেই আস্ট্রেলিয়ায় করোনার আনাগোনার কথা শোনা যেতে থাকে। তারপর কোথাও যাওয়ার কথা ভাবা তো দূরের কথা, সুস্থ দেহে দেশে ফিরতে পারবো কিনা, সে ভাবনায় পেয়ে বসে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই; এরপর আর আমাদের বাসা থেকে বের হওয়া হয় নাই, কোথাও যাওয়া হয় নাই। অত্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে আমাদের যেদিন দেশে ফেরার টিকেট কাটা ছিল, তার পরের দিন থেকেই অস্ট্রেলিয়া পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য তাদের সীমান্ত এবং সকল বন্দর বন্ধ করে দেয় এবং টানা প্রায় দু’বছর বন্ধ রেখেছিল। সেবারে দু’দিন চীনের গুয়াংযু বিমানবন্দরে অন্তরীণ থেকে মধ্যরাতে দেশে ফিরে শুনি, পরদিন সকাল থেকেই (২৬ মার্চ ২০২০) বাংলাদেশেও “লকডাউন” শুরু হবার কথা ঘোষিত হয়েছে।
যাহোক, মনে গেঁথে থাকা Carrum স্টেশনের সেই দৃশ্যটির কথা ভেবে আমি মনে মনে সাব্যস্ত করেছিলাম যে আজ (অর্থাৎ গত ১১ তারিখে) সেখানেই যাবো। গিন্নীকে কথাটা খুলে বলাতে সে জিজ্ঞেস করলো, একা একা সেখানে যেতে পারবো কিনা। আমি বললাম, পারবো। এর আগে কয়েকবার ভুলো মনের কারণে ট্রেন যাতায়াতে কিছুটা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলাম, সে কারণে সে ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না। আমিও একটু হেঁয়ালি করেই বলেছিলাম, ‘চলো রওনা দেই। বীচ খুঁজে পেলে যাবো, না পেলে ফিরে আসবো’। সে জিজ্ঞেস করলো, গুগল ম্যাপ স্টাডি করেছি কিনা। আমি বললাম, না। আসলেই করি নাই, ভেবেছিলাম কোন বিপদে পড়লে গুগল ম্যাপ খুলে দেখবো, তার আগ পর্যন্ত কমন সেন্স আর পূর্বের স্মৃতিই যথেষ্ট বলে মনে হলো। Carrum স্টেশনের ঠিক আগের স্টেশনটির নাম Bonbeach স্টেশন। ট্রেনটা যখন Bonbeach স্টেশনে ঢুকছে, গিন্নীকে বললাম, “এর পরের স্টেশনটাই Carrum স্টেশন, সেখানে আমাদের নামতে হবে। সেখানে যে বীচ আছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, কিন্তু এখন যে স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকছে (Bonbeach), তার নামের সাথে যেহেতু বীচ আছে, আমার মনে হয় এখানেও বীচ থাকবে। নামবা? বীচ না থাকলে আমরা হয় হেঁটে নয়তো পরের ট্রেনে উঠেও পরের স্টেশনে যেতে পারবো। একটা স্টেশনের দূরত্বও খুব বেশি হবে না, আবার ২০ মিনিটের মধ্যে পরের ট্রেনটিও ধরা যাবে”। মনস্থির করতে করতে ট্রেনটা থেমে আবার চলা শুরু করলো, আমরাও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পরের স্টেশনে নামার জন্য তৈরী হতে থাকলাম। অনেক সময় সিদ্ধান্তহীনতাও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে সাহায্য করে।
Carrum স্টেশনটি উঁচু পিলারের উপর অবস্থিত। ট্রেন থেকে নেমে দেখি, উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকেই ক্যারম উপসাগরের বিস্তীর্ণ তটরেখা দেখা যাচ্ছে। প্রায় জনমানবশূন্য। আকাশটা তখনও মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি তখনও শুরু না হলেও, বাতাস অনেক আর্দ্র ছিল। দু’টি ছাতা যদিও সঙ্গে ছিল, তবুও বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই “Way Out” দিকচিহ্ন খোঁজা শুরু করলাম। সৌভাগ্যক্রমে লিফটের সামনে পৌঁছার আগেই এক যুবকের দেখা পেলাম। তাকে Carrum beach সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে এমন সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিল যে এর পর আমার মনে আর কোনই সন্দেহ রইলো না। ৪/৫ মিনিটের মধ্যেই বীচে পৌঁছে গেলাম। তখন খুবই হাল্কা ধরনের একটি ঝিরঝিরে বৃষ্টির ধারা বইছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কাছাকাছি কোন জনমানুষ দেখতে পেলাম না, তবে দূরে অপরদিক থেকে এক দম্পতি তাদের বাঁধন ছেড়ে দেওয়া কুকুর জোড়া সাথে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। কুকুর দুটো নিজেদের মধ্যে খেলছিল, আর মানুষদুটো একান্ত সান্নিধ্যে গল্প করতে করতে এগোচ্ছিল। নিকটে এসে যখন ওরা আমাদেরকে অতিক্রম করছিল, লোকটা একগাল হেসে ‘হাই’ বলে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার প্রশংসা করলো। একটু পরে দু’জন চীনা বংশোদ্ভূত লোক আমাদেরকে অতিক্রম করলো। তাদের দু’জনের সাথেও দুটো কুকুর ছিল। আমরা যে পথে বীচে নেমেছিলাম, কিছুক্ষণ পর সে পথে এক বুড়ো ভদ্রলোক তার দুই নাতি নাতনি নিয়ে নেমে আসলেন। তাদের সাথে তিনি খেলাধুলা করছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন এবং তাদের লাফালাফির ছবি তুলছিলেন। এবারে অপরদিক থেকেও কয়েক দম্পতি আমাদের অতিক্রম করলো। অতিক্রম করার সময় “হ্যালো হাই” বলতে বলতে কেউ থেমে দু’দণ্ড আলাপও করে নিল। তাদের একজন বললো, এ বীচটি দীর্ঘ হাঁটার জন্য খুব উপযুক্ত। এখানে সাধারণতঃ সাঁতারুদের ভিড় থাকে না, হাঁটুনিওয়ালাদের ভিড়ই বেশি থাকে। কিছুদের এগোলে একটা পয়েন্ট পাওয়া যাবে, যেখানে মাঝে মাঝে ছোট খাটো সার্ফারদের দলও এসে থাকে। দাঁত বাঁধানো এক হাস্যোজ্জ্বল বুড়ি তার নাতনিকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি খুবই অমায়িক, নিজ থেকেই আমাদের কয়েকটা ফটো তুলে দেবেন কিনা তা জিজ্ঞেস করলেন। আমরা সানন্দে রাজী হ’লাম। ফটো তোলার সময় আমি আমার হাতের গ্লাভস খুলে নিকটস্থ একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। ফটো তুলে বিদায় নেয়ার সময় তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, গ্লাভস পরে নিতে যেন ভুলে না যাই। বয়স্করা বয়স্কদের স্বভাব খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং আমি দেখেছি, এ ব্যাপারে এরা সবাই খুব আন্তরিক।
বীচে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আমরা প্রায় জনশুন্য সাগরতীরের নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করলাম। সেখানে থাকতে থাকতেই হাঁটারত জনৈক ব্যক্তিকে Bonbeach সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি সামনে অঙুলিনির্দেশ করে বললেন, “সোজা হাঁটতে থাকুন, বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন”। যাহোক, আকাশটা পুনরায় আঁধার করে আসায়, আগামীতে আবার কোন একদিন Bonbeach এ আসবো বলে মনস্থির করে আমরা স্টেশনে ফিরলাম। চার মিনিটের মাথায় ট্রেন চলে এলো, আমরা সেটাতে উঠে পড়লাম। আমরা গতবারে যে জায়গাটায় ছিলাম, ফিরে আসার পথে সে স্টেশনটা পড়ে। আগেই আময়া উভয়ে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম, আমাদের সেই পুরনো জায়গাটায় আরেকবার যাবো। স্টেশনটিতে ট্রেন থামলে আমরা নেমে স্টেশনের নিকটস্থ আমাদের প্রাক্তন বাসার পুরনো স্মৃতিগুলোকে কিছুক্ষণ হাতডে ফিরলাম। আরেকটু দূরেই তুর্কী কেবাবের একটা ছোট্ট দোকান ছিল, যেখানে আমরা প্রায়ই যেতাম। ইচ্ছে হয়েছিল, একটু অগ্রসর হয়ে আমাদের প্রিয় সেই তুর্কী কেবাবের দোকানে গিয়ে কিছু খেয়ে আসবো। কিন্তু ততক্ষণে হাল্কা বৃষ্টি পুনরায় শুরু হওয়াতে আমরা তড়িঘড়ি করে স্টেশনে ফিরে এসে পরের ট্রেন ধরলাম। পথিমধ্যে Springvale স্টেশনে নেমে ‘Bangladeshi Cuisine’ নামক রেস্তোরাঁয় (অধুনা এ রেস্তোরাঁটি বাংলাদেশি ভোজন রসিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে) সান্ধ্যভোজ শেষে একটি মেঘাচ্ছন্ন দিনের কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১৩ জুন ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ১২০০
"পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ....."
১১১৪৪৩ জুন ২০২২
জলের বুকে মেঘ ও সূর্য.....
১১ জুন ২০২২
অনেক জোয়ার ভাটার সাক্ষী....
১১১৪২৯ জুন ২০২২
দর্শনার্থীদের উপকূলোবর্তী বালিয়াড়িতে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্কবাণী.....
১১১৪৫৪ জুন ২০২২
Carrum স্টেশনের উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে zoom করে দেখা সাগর সৈকত।
১১১৪১৯ জুন ২০২২
"আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে" .....
১১১৪৫৭ জুন ২০২২
"মেঘ থমথম করে" .....
১১ জুন ২০২২