আজ আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় আসার দুই মাস পূর্ণ হলো। এখানে দিনরাত্রির দৈর্ঘের তারতম্য আমাদের দেশের ঠিক উল্টো পন্থায় ঘটে থাকে। অর্থাৎ ২২শে ডিসেম্বর এখানে দীর্ঘতম দিন, হ্রস্বতম রাত। আবার ২২শে জুন এখানে দীর্ঘতম রাত, হ্রস্বতম দিন। আড়াই বছর আগে সেবার ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম ঢাকার হ্রস্বতম দিনটির দিনান্তে, অর্থাৎ এখানকার সেই দীর্ঘতম দিনটিতেই। তখন এখানে ছিল রোদ ঝলমলে গ্রীষ্ম। প্রায় সাড়ে চৌদ্দ ঘণ্টা দিন, সাড়ে নয় ঘণ্টা রাত। লাঞ্চের পর দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েও বিকেল পাওয়া যেত না। আবার এশা এবং ফজরের নামাজের ব্যবধান খুবই কম ছিল। মনে আছে, প্রথম দিনের মাগরিব নামাযের সময় হয়েছিল রাত (আসলে সন্ধ্যা) পৌণে নয়টায়। এখানে যেহেতু নামাযের আযান শোনা যায় না, সেহেতু গুগল তথ্যই সহায় ও সম্বল।
আজ পহেলা জুন থেকে এখানে অফিসিয়ালি শীতকাল শুরু হলো। ঢাকায় যেমন গ্রীষ্মের চেয়ে শীতকালটা অনেক আরামদায়ক ছিল, এখানে তেমনটি নয়। এখানে গ্রীষ্মকালটাই আরামদায়ক ও স্বস্তিকর (অন্ততঃ আমার কাছে)। ‘অস্বস্তিকর গরম’ বলতে যা বোঝায়, তেমন দিন গতবারে পুরো গ্রীষ্মকালে ৪/৫ দিনের বেশি পাইনি। আর তা ছাড়া এখানে গরমে গা ঘামে না, সেটাও একটা স্বস্তির বিষয়। গ্রীষ্মের বাকিটা সময়ে সকালে কিছুটা গরম থাকলেও, বিকেলের দিকে ‘ফিলিপস বে’ থেকে হিমেল হাওয়া এসে গা জুড়িয়ে দিত, তখন গলায় একটা মাফলার না জড়ালে এবং গায়ে একটা হাল্কা জ্যাকেট না চড়ালে আমার ঠান্ডা লেগে যেত। আবার কোন কোন দিন আবহাওয়া সকালেই হয়তো একটু হিমেল থাকতো, বিকেল থেকে সন্ধ্যায় এবং রাতের কিছুটা সময়েও কিছুটা গরম পড়তো। তবে কদাচিৎ এসি ছাড়তে হতো। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগতো দিনের বেলায় আলো ঝলমল রোদে মেলবোর্নের নীল-সাদা আকাশ দেখতে। আমি যে টেবিলে বসে লিখতাম, লেখা বন্ধ করে সামনে চোখ মেলে দিলেই দেখতে পারতাম নীলাকাশে সুন্দর সুন্দর তুলোর পেঁজার মত সাদা মেঘের ভেলা। সামনে কোন বহুতল ভবন ছিল না বলে ঘরের টেবিলে বসেই বিশাল আকাশ দেখা যেত। ইতোমধ্যে আমার ছেলেরা দক্ষিণ-পূর্ব সাবার্বে তাদের নিজস্ব বাসা ক্রয় করেছে। এ জায়গাটা আগেরটার চেয়ে অনেক খোলামেলা হলেও, আমি যে কক্ষটিতে বসে লিখি, সেখান থেকে আকাশ দেখা যায় না, তবে দু’জনে পাশাপাশি বসে ল্যাপটপে কাজ করার মত চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে।
এখন এখানে রাত প্রায় দশটা বাজে। সারাদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি থাকাতে তাপমাপক যন্ত্র মাত্র ১০ ডিগ্রী দেখালেও, আমার খুব শীত লাগছে। “ফীলস লাইক” তাপমাত্রা হয়তো হবে ৫/৬ ডিগ্রীর মত। আমি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ তথা লালমনিরহাট জেলার লোক। ১০ ডিগ্রী তাপমাত্রা সেখানেও কোন কোন দিন পেতাম, কিন্তু এত কিছু গায়ে জড়ানোর পরেও, এত শীত অনুভূত হতো না (আসলে এখন যেগুলো আমি পরে আছি, এতগুলো গরম কাপড় কখনোই সেখানে পরতে হতো না)। গত এপ্রিল মাস জুড়ে রোযা ছিল। তখন দিনের দৈর্ঘ্য সোয়া দশ ঘণ্টার মত ছিল। হ্রস্বতম দিন, অর্থাৎ ২২ শে জুনে এ দৈর্ঘ্য নেমে আসবে সাড়ে নয় ঘণ্টায়। আজ দিনের দৈর্ঘ্য ছিল নয় ঘণ্টা বিয়াল্লিশ মিনিটের মত। অর্থাৎ হ্রস্বতম দিনটিতে দিনের দৈর্ঘ্য আজকের চেয়ে আরও বার মিনিট কমে যাবে। সারা দিনমান মেঘলা আকাশের এত ছোট দিন আমার ভালো লাগে না। আজ শীত আর বৃষ্টির ভয়ে হাঁটতেও বের হই নি। তবে এত ছোট দিনের (আর দীর্ঘ রাতের) একটা সুবিধে হলো, যতই ঘুমাই না কেন, ফজরের নামায ক্বাযা হয় না। যেমন আজ সূর্যোদয়ের সময় ছিল সাতটা পঁচিশ। এটা আগামী দিনগুলোতে সাতটা ছত্রিশ মিনিট পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হবে।
আজ সারাদিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য সূর্যের মুখ দেখা গিয়েছিল, দুপুর একটা থেকে চারটে পর্যন্ত। ঘণ্টাখানেক সেই সময়টাতে সদ্যজাত (৩৮ দিন) নাতনিকে নিয়ে পশ্চিম জানালা দিয়ে আসা রোদে বসে ছিলাম। সেও মনে হলো আরামদায়ক উষ্ণতায় ও স্বস্তিতে অনেকক্ষণ ঘুমালো। সকালে মেঘলা আকাশ আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে দুপুরে খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছিল। শীতের দুপুরে গরম খিচুড়ি চরম উপাদেয় ছিল। বাসায় সুন্দর ঘ্রাণের লেবুগাছ আছে। সেই লেবু আর এখানকার ‘বাংলা মার্কেট’ থেকে কেনা আচারের কারণে আজ দুপুরে রসনায় ও তৃপ্তিতে আহারের পরিমাণ স্বাভাবিক সীমারেখা অতিক্রম করেছিল।
বৃষ্টির কারণে বোধহয়, আজ গাছে কোন পাখি দেখিনি। আকাশেও না। আকাশের বিষণ্ণতা মনেও এসে ভিড়েছিল। তাই অনেকদিন পর আজ পুরনো দিনের কিছু প্রিয় বাংলা, ইংরেজী এবং হিন্দী গান শুনলাম। মনটা ভালো হয়ে গেল। রাতে শুয়ে দখিনের জানালা দিয়ে কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ঝাপ্টা দেখবো, বৃষ্টি না হলে মেঘলা আকাশটাকেই দেখবো আর বাতাস উঠলে গাছের ডালপালার আন্দোলিত হওয়া দেখতে দেখতে আমরা ঘুমিয়ে যাবো। সুদীর্ঘ রাত, তাই আবার জাগলে আবার দেখবো, আবার ঘুমাবো।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
০১ জুন ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৬৪৫
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২৩ রাত ১:৩৪