তাজুল হক আর নূরুল হক এক পাড়ায় থাকতো। বয়সে নূরুল হক ওরফে নূর ভাই তাজুলের চেয়ে কয়েক বছরের বড়। বয়সের ঐটুকু পার্থক্য তখন কোন ব্যাপার ছিল না। ৫/৬ বছরের ব্যবধানের মধ্যে পাড়ার ছেলেপুলেরা একসাথেই ঘোরাফিরা করতো, খেলাধুলা করতো, পাখি ধরতো, লাট্টূ-ডাংগুলি খেলতো, আবার দুষ্টামিও করতো। এমনকি ঐ পার্থক্য সত্তেও তাদের সবার মাঝে তুই তুকারি সম্পর্কও ছিল। ওরা সবাই নিম্ন মধ্যবিত্ত/মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ছিল, তবে আর্থিক স্বচ্ছলতার দিক দিয়ে তাজুলদের অবস্থা অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশীই খারাপ ছিল। কম আয়, বেশী সন্তান এর কারণে তাজুলদের সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকতো, আর সে কারণে তাজুলের বাবা কম বয়সেই রক্তচাপ ও বিবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে খুবই খিটিমিটি মেজাজে থাকতেন। মেট্রিক (তখনো এসএসসি নামটার প্রচলন শুরু হয় নাই) পরীক্ষার আগে তাজুলের বাবা তাজুলকে ডেকে পরিস্কার জানিয়ে দিলেন, প্রথম বিভাগে পাশ করতে না পারলে তার আর কলেজে পড়া হবেনা, তাকে গ্রামে গিয়ে হাল চাষ করতে হবে।। পরীক্ষা দিয়ে তাজুল নিশ্চিত হয়েছিল যে সে প্রথম বিভাগ পাবেনা। তবে মনে মনে আশা ছিল, দ্বিতীয় বিভাগ নিশ্চয়ই পাবে। যেদিন পরীক্ষার ফল বের হলো, সেদিন থেকেই তাজুল বাসা থেকে পালিয়ে গেল, কারণ প্রথম বিভাগ তো দূরের কথা, সে দ্বিতীয় বিভাগও পায় নাই। তৃ্তীয় বিভাগের ফলাফল নিয়ে বাসায় ফিরলে কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, সেটা আঁচ করে সে আর দেরী করে নাই। রেল স্টেশনে গিয়ে সামনে যে ট্রেনটা পেল, সেটাতেই উঠে গেল; অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা। নূর ভাই তখন বিএ পাশ করে ঢাকায় এসে একটা চাকুরীতে ঢুকেছে, অফিস সহকারী পদে। তাজুলও তখন ঢাকায় কিছুদিন করে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাসায় এটা ওটা বলে থেকেছে এবং কয়েক বছর পার করেছে। কয়েকজন সহৃদয় আত্মীয়ের বদান্যতায় একটি টাইপিং ও শর্টহ্যান্ড কোর্সে ভর্তি হয়ে সাফল্যের সাথে কোর্স সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে কয়েকটা টিউশনি যোগাড় করে সামান্য কিছু আয় রোজগারও করতে শুরু করার পর সে মুগদাপাড়ার একটি মেসে এসে উঠেছে। হঠাৎ একদিন পাড়ার গলির মুখে নূর ভাই এর সাথে দেখা। দু’জনার অবস্থার পরিবর্তনের কারণে আগের সেই তুই তুকারি সম্বোধনটা কিছুতেই আর ওদের কারো মুখে এলনা। নূর ভাই তাকে সম্বোধন করে তুমি বলে, আর তাজুল তাকে আপনি বলে। তাজুল লক্ষ্য করলো, নূর ভাই এর পোশাক আগের চেয়ে বেশ পরিপাটি, নূর ভাইও লক্ষ্য করলো, তাজুলের শার্টের বগলের নীচে একটু ছেঁড়া, প্যান্টটাও রঙচটা। যাওয়া আসার সময় মাঝে মাঝেই ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়, তাজুল এড়িয়ে যেতে চাইলেও নূর ভাইই ক্ষণিক থেমে ওর ভাল মন্দের কথা জেনে নেয়। একদিন নূর ভাই ওকে সন্ধ্যায় ওনার মেসে আসতে বললেন। তাজুলের সাথে আলাপচারিতায় জানালেন যে তাদের অফিসে কয়েকজনকে টাইপিস্ট পদে চাকুরী দেয়া হবে। তিনি তাকে তার অফিসের ঠিকানা দিয়ে দু’দিন পরে দেখা করতে বললেন। ফিরে আসার সময় তিনি তাজুলের হাতে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের এখানে পানি থাকেনা, তাই কাপড় চোপড় ধুতে পারছিনা। এখানে আমার একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট আছে। তুমি এগুলো ধুয়ে, ইস্ত্রী করে আমার অফিসে আসার সময় নিয়ে আসবা। আর হ্যাঁ, তুমি নিজেও কিন্তু ইস্ত্রী করা শার্ট প্যান্ট পরে আসবা। তাজুল কথাটা শুনে হতবিহ্বল হলো, যারপরনাই লজ্জা পেল, কিন্তু না করতে পারলো না। অসহায়ের মত সে হাতটা বাড়িয়ে কাপড়ের ব্যাগটা নিল।
পরেরদিন তাজুল খুব যত্ন করে কাপড়গুলো ধুচ্ছিল। সাথে নিজেরও একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট যোগ করে নিল। তখন গুড়া পাউডারের প্রচলন ছিল না। সাবান মেখে কিছুক্ষণ কাপড়গুলোকে ভিজিয়ে রেখে তারপর ধুতে হতো। তাজুল কাপড়গুলো ধুচ্ছিলো আর তার চোখে একের পর এক স্বপ্নের দুয়ার খুলে যাচ্ছিল। সে সকাল বিকাল ধোয়া কাপড় পড়ে অফিসে যাবে আসবে, সপ্তাহে একদিন ছুটি পাবে, মাস শেষে বেতন পাবে। নানান কিছু ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে ভেজা কাপড়গুলোকে আরো কিছুটা ভিজিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তবু কেন জানি সে কিছুতেই নূর ভাইকে দোষারোপ করতে পারছিল না। সে বরং নূর ভাই এর প্রতি অতিশয় কৃতজ্ঞ বোধ করছিল, অনটনের জোয়াল টানা থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার তার এই সদিচ্ছার জন্য।
বিকেলে ধোয়া কাপড়গুলো নিয়ে তাজুল পাড়ার একটি লন্ড্রীতে নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ইস্ত্রী করে আনলো। অনেকদিন পর সে নিজের কাপড়ও ইস্ত্রী করালো। এতদিন ধরে সে ধোয়া কাপড় কয়েকদিন তোষকের নীচে রেখে ভাঁজ ফেলে পরে এসেছে। কাল সে ইস্ত্রী করা কাপড় পরে ইন্টারভিউ দিতে যাবে। ইন্টারভিউতে তার একটা টাইপিং টেস্ট নেয়া হয়েছিল। তাজুল পরে জেনেছিল সেটা ছিল নিমিত্ত মাত্র। আসলে সে নূর ভাই এর জোর সুপারিশেই চাকুরীটা পেয়েছিল।
আমার এ গল্পের নায়ক সেই তাজুল সাহেব সেই যে সেদিন চাকুরীতে ঢুকেছিলেন, সেখানেই একটানা চল্লিশ বছর নিষ্ঠার সাথে চাকুরী করে গেছেন। ইতোমধ্যে তিনি নৈশ কলেজে অধ্যয়ন করে আই এ এবং বিএ পাশ করেছিলেন। একনিষ্ঠ সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে তিনি চল্লিশ বছরের চাকুরী জীবনে বেশ কয়েকটি পদোন্নতি লাভ করে শেষ জীবনে ম্যানেজার পদে অবসর নিয়েছিলেন। দিনে চাকুরী করতেন, রাতে বাসায় ফিরে ছেলেদেরকে নিজে পড়াতেন। তার একমাত্র বিনোদন ছিল, ছেলেদের পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেট কমেন্টারী শোনা। বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই ক্রিকেট খেলা হোক না কেন, রেডিওতে প্রচারিত হলে সেটা তিনি শুনতেনই। তখন শুধু টেস্ট খেলাই হতো, একদিনের খেলার প্রচলন তখনো শুরু হয়নি।
নিতান্ত জৌলুষহীন একটা জীবন কাটিয়ে তাজুল সাহেব এখন ওপাড়ের ডাকের অপেক্ষায়। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে ছেলেদের পড়াশুনা তদারকি করতেন, ফলে তার ছেলেরা আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা উভয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত, উভয়ে সহযোগী অধ্যাপক। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অপরজন একটি সরকারী কলেজে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি প্রায়ই মাঝে মাঝে ফেলে আসা জীবনটার পানে পেছন ফিরে তাকান । জীবনের ভালমন্দ অনেক কিছুই তিনি ভুলে গেছেন, কিন্তু সেদিনের নূর ভাই এর দেয়া ব্যাগটির কথা তিনি আজও ভুলতে পারেন নাই। মনে মনে এটা ভেবে তিনি নূর ভাই এর প্রতি আজও কৃতজ্ঞ বোধ করেন এজন্য যে তাকে চাকুরী দেবার বিনিময়ে তিনি তার কাছ থেকে যে সার্ভিসটুকু নিয়েছিলেন, এর চেয়ে বেশী কিছু বা অন্য কিছু চাইলে তা দেয়ার সাধ্য তার ছিল না। ঘুষের প্রচলন তো তখনও ছিল। নূর ভাই তো তার কাছে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও কিছু টাকা কিংবা পণ্যসামগ্রী দাবী করতে পারতেন। পক্ককেশ, শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত ধর্মপ্রাণ তাজুল সাহেব জানেন, ঘুষ দেয়া নেয়া উভয়ই হারাম। তবু তিনি এটা ভেবে কিছটা স্বস্তিবোধ করেন যে রুটি রুজির জন্য যে ঘুষটুকু তিনি জীবনে দিয়েছেন, তা পরিশোধ করেছেন কায়িক পরিশ্রমে, কোন অর্থ বা পণ্যের বিনিময়ে নয়। এটাকেও হয়তো কেউ কেউ ঘুষ বলবে, তবে এটা ছিল একটা ব্যতিক্রমী ঘুষ। তিনি আশা করেন, পরম করুণাময় আল্লাহতা’লা এজন্য তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন।
ঢাকা
০১ ডিসেম্বর ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।