আজ (২৮ এপ্রিল ২০১৬) সন্ধ্যে সোয়া ছয়টায় আমরা সবাই বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হ'লাম। উদ্দেশ্য, বিদেশগামী বড়ছেলে, বৌমা আর নাতনিকে বিদায় জানানো। আমার ইচ্ছে ছিল মাগরিবের নামাজ বাসায় পড়ে নিয়েই রওনা হবার। কিন্তু ছেলে জানালো, না, তাহলে বেশী দেরী হয়ে যাবে, কারণ সাড়ে ছ'টা থেকেই চেক ইন শুরু হবার কথা। অগত্যা আযানের পনের মিনিট আগেই রওনা হ'লাম এবং পথে গাড়ীতে বসেই নামাজ পড়ে নিলাম।
গাড়ীতে বসে আনায়া তার প্রিয় পুতুলটার খোঁজ করছিলো আর 'বেবী নাই, বেবী নাই' বলে মন খারাপ করছিলো। কোনরকমে এটা সেটা বলে তাকে সামাল দিলাম। বিমান বন্দরে পোঁছে ওর বাবা লাগেজ নিয়ে চেক ইন করতে গেল আর ও সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ালো। অবশেষে যখন ডাক পড়লো ইমিগ্রেশনের দিকে যাবার, আমরা সবাই দর্শনার্থীদের জন্য শেষ সীমারেখায় পৌঁছে ওকে আদর দিতে থাকলাম। ও তখন ছিলো ওর দীদার কোলে। অন্যান্য সময় মাকে পেলে ওর আর কাঊকে না হলেও চলে। কিন্তু কি আশ্চর্য, শেষ সীমায় পৌঁছানোর পর ওকে কিছুতেই ওর দীদার কোল থেকে নামানো যাচ্ছিল না। এমনকি ওর বাবা মা এর শত প্রলোভন সত্তেও না। শেষ পর্যন্ত ওর কান্নাকে উপেক্ষা করে খানিকটা জোর করেই ওর মায়ের কোলে দেয়া হলো। আমরা কাঁচের এপার থেকে বাই বাই দিতে থাকলাম এবং যতক্ষণ দেখা যায়, তাকিয়ে থাকলাম। ছেলে আমাদেরকে বললো, এখানে থেকে তোমাদের আর কোন লাভ নেই, আর দেখতে পাবেনা, তাই তাড়াতাড়ি বরং বাড়ী ফিরে যাও। আমরা তাই করলাম।
বাসার দরজা খুলেই ওর ছড়ানো ছিটানো খেলনাগুলো দেখে মনটা ভারী হয়ে এলো। আজ দুপুরে ও ওর দাদু আর দীদার মাঝখানে শুয়ে একটানা দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘন্টা ঘুম দিয়েছিলো। এতটা লম্বা ঘুম ও কখনো দেয় না। ও ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই ওর দীদা ওর মাথায় একটা ঝুঁটি বেধে দিয়েছিলো। ও ঘুমের ঘোরে কিছুটা টের পেয়ে বললো, "দীদা, মাথায় মশা কাম্মায়"।
যাবার সময় হয়ে এলে ওর দীদা ওকে ঘুম থেকে তুলে নুডলস খাইয়ে দিলো। তারপর সাজিয়ে দিলো। বাসায় ফিরে এসে দেখি ওর পরনের জামাকাপড়গুলো তখনো বিছানার উপরেই পড়ে আছে, কারণ যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োর কারণে সেগুলো গুছিয়ে রাখা হয়নি। ওগুলো থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। খুব খারাপ লাগছিলো। কিছুক্ষণ ওর হলুদ রঙের জামাটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। এশার নামাজ পড়ার জন্য অযু করতে যাবো, এমন সময় ছেলে ফোন করে জানালো ওরা প্লেনে বসেছে। আনায়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। ও বললো, প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত সারাটা লাউঞ্জে সে ছুটাছুটি করে বেড়িয়েছে। শুনে খুব খুশী হ'লাম। কিন্তু পরক্ষণেই ফোনে ওর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ছেলে বললো, প্লেনে ওঠার পর থেকেই সে বেশ অস্বস্তি প্রকাশ করছে। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। ছেলে কথা সংক্ষিপ্ত করে আমাকে আর ওর মাকে আল্লাহ হাফেজ জানালো।
বিমান বন্দরে যেসব প্লেন ওঠা নামা করে, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই আমার বাসার উপর দিয়ে যায়। আমার একটা অন্যতম কাজই ছিল আনায়াকে প্রতিদিন আকাশের প্লেন আর গাছ গাছালির পাখি দেখানো। আমি জানি, ওদের প্লেনটাও আমার বাসার উপর দিয়েই যাবে। তৈরী হলাম আনায়ার প্লেন দেখার জন্য। একটু পরেই শব্দ করে একটা প্লেন উড়ে গেল। ওর দীদা কখনো এসব দেখে না। আজ সে নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি ওকে বললাম, এটাই আনায়ার প্লেন। আমি শব্দ করে বললাম, বাই বাই আনায়া! ও শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকলো, যতক্ষণ দেখা যায়। তার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। এরপর আমি এশার নামায পড়ে হাল্কা ডিনার সেড়ে নিলাম। তারপর গুগল সার্চ দিয়ে আজকের ফ্লাইট নং ইকে ৫৮৫ এর হিস্ট্রী পড়ে নিলাম। দেখলাম, সেটার একচুয়াল টাইম অব ডিপারচার ছিল রাত ১০ঃ২১। নিশ্চিত হ'লাম, আমাদের টাটা দেয়া প্লেনটাতেই আনায়া ছিলো। ও যেভাবে রোজ আমার কোলে চড়ে প্লেনগুলোকে টাটা দিত, আমিও আজ ওর মত করেই ওর প্লেনকে টাটা দিলাম।
ছেলেকে বারবার করে বলেছি, দুবাই পৌঁছেই ও যেন ভাইবার এর ফ্যামিলি গ্রুপে মেসেজ দেয়। সেখানে ওদের নয় ঘন্টার ট্রানজিট, তাই এয়ারলাইনস থেকে হোটেল পাবে। এরপর শুরু হবে ওদের সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে ১৭/১৮ ঘন্টার লম্বা একটানা ফ্লাইট। তারপরে ইন শা আল্লাহ ওরা পৌঁছে যাবে কাঙ্খিত গন্তব্য টরন্টোতে। এতটা দীর্ঘ আকাশ পথে আনায়ার কিছুটা অস্বস্তি হবে, তা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। তাই দোয়া করতে লাগলাম, আল্লাহ ওদেরকে সহি সালামতে গন্তব্যে পৌঁছে দিন! পথের ক্লান্তি মোচন করে দিন। পুরো পথ ও সফরটাকে সবার জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় করে দিন! বাচ্চাটাকে আর তার মা বাবাকে সুস্থ রাখুন। আমীন!
ঢাকা
২৮ এপ্রিল ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
যে এসব জামা কাপড় একটু আগেও পড়ে ছি্লো আর এসব পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করছিলো, সে আজ কয়েক সপ্তাহের ট্যুরে বেড়াতে গেলো তার বাবা মায়ের সাথে। আমি তাকে সারাক্ষণই মিস করে চলেছি....