"আমার কথা -২৯" পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুনঃ আমার কথা -২৯
প্যারেন্টস’ ডে
সপ্তম থেকে নবম শ্রেণীতে পড়া পর্যন্ত প্যারেন্টস’ ডে গুলো আমার খুব ভালো লাগতো। প্রতি মাসের শেষ রবিবারে প্যারেন্টস’ ডে হতো। যে মাসে দু’সপ্তাহের কম কলেজে থাকতাম, সে মাসে হতো না। দিবসগুলোর দিকে মুখিয়ে থাকতাম। প্যারেন্টসদেরকে আমাদের হাউসে আসতে দেয়া হতোনা। কলেজ অডিটরিয়াম, ক্লাসরুম, করিডোর, গ্যালারী, কলেজ হাসপাতালের সামনের খোলা জায়গা, ইত্যাদি স্থানে প্যারেন্টসরা এবং ভাইবোনসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা ক্যাডেটদের সাথে নিভৃতে বসে কথাবার্তা বলতে পারতেন। তাদের জন্য নিয়ে আসা নানারকমের পছন্দের খাবার খাইয়ে দিতে পারতেন। সিরিয়াস মায়েরা অমনোযোগী পুত্রদের জন্য ঢাকার ভালো ভালো স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নোট সংগ্রহ করতেন এবং গোপনে সেগুলো পুত্রধনদের নিকট হস্তান্তর করতেন। অবশ্য এটার প্রচলন শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকে, যখন কলেজের আইন কানুন কিছুকালের জন্য একটু শ্লথ হয়ে গিয়েছিলো। সপ্তম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত যেসব কারণে প্যারেন্টস’ ডে’র দিকে মুখিয়ে থাকতাম, সেগুলো হলোঃ
১। মায়ের হাতের রান্না খাওয়া।
২। আদরের ভাইবোনদের দেখা পাওয়া।
৩। কিছু শুকনো খাবারের রিজার্ভ হাতে পাওয়া।
৪। ব্যক্তিগত কোন সমস্যা থেকে থাকলে তা প্যারেন্টসদেরকে সাক্ষাতে বলতে পারা।
৫। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হবে আঁচ করতে পারলে সে সম্পর্কে আগেভাগে কিছু অজুহাত বলে দেয়া।
৬। কেবলমাত্র ঐ দিনের জন্য কলেজ ড্রেসের বাইরে ইচ্ছেমত ব্যক্তিগত পোষাক পরিধান করতে পারা।
৭। যাদের প্যারেন্টসরা একটু বেশী খাবার দাবার আনতেন, পরে সবাই মিলে তাদের কাবার্ড্ আক্রমণ করে ভাগ বসানো, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
প্রথম প্যারেন্টস’ ডেতে আব্বা, আম্মা আর বড়বোন এসেছিলেন। তাদের, বিশেষ করে আপি’র যেমন খুব উচ্ছ্বাস ছিল আমার কলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখার, আমিও তেমন খুব আনন্দ পেতাম তাদেরকে কলেজের বিশেষ জায়গাগুলো দেখিয়ে, কলেজের নিয়ম কানুন সম্পর্কে, শিক্ষকদের সম্পর্কে, পোষাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে বলতে পেরে। তাদেরকে আমার প্রথম প্যারেড দেখাতে পেরে খুব গর্ব বোধ করেছিলাম। পরের দিকে প্যারেন্টস’ ডেতে আব্বাই বেশী আসতেন, একেকবার ভাইবোনদের একেকজনকে সাথে নিয়ে। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে প্যারেন্টস’ ডে গুলো আর তেমন ভাল লাগতোনা। তখন বরং চাইতাম কেউ না আসুক, যেন ঐ সময়টা আমি মনের সুখে খেলার মাঠে কাটাতে পারি। আর তখন একটা বড় বড় ভাব এসে গিয়েছিলো। মনে হতো, প্যারেন্টস’ ডে’র ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো ছিচকাঁদুনে পুচকে ছেলেপেলেদের জন্য।
ফুটবল মাঠে সাদা বকঃ
আমাদের কলেজে ফুটবল খেলার জন্য বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল। মাঠগুলো বেশ উঁচু ও প্রশস্ত ছিলো। সব মিলিয়ে একসাথে মোট ১২টি দল সেখানে খেলতে পারতো। যতই বৃষ্টি হোক, কখনো পানি জমতো না। কোন একবার শ্রাবণ মাসে একনাগাড়ে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিলো। আমি খুব সম্ভব তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। বর্ষাকে, রবীন্দ্র সঙ্গীতকে, বক, পাখি, প্রজাপতিকে ভালবাসতে শুরু করেছি। একদিন শ্রেণীকক্ষ থেকে হাউসে ফিরে আসার সময় গুনগুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছিলাম, মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে…। সে সময় এখনকার মত একাডেমিক ব্লক থেকে হাউস পর্যন্ত কাভার্ড ওয়াকওয়ে ছিলনা। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কিছুটা পথ দৌড়াতে হচ্ছিলো। হাউসের কাছাকাছি এসে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, আমাদের হাউসের (ফ হ) নিকটবর্তী ফুটবল মাঠের যে কোণাটা ছিল, সেখানে কয়েকটা সাদা বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, কেননা কলেজের গাছ গাছালিতে বহু আকৃতির আর বর্ণের পাখি দেখে থাকলেও কোনদিন কোন বক চোখে পড়েনি, কারণ একেবারে নিকটে কোন জলাশয় ছিলনা। আর অবাক হবার আরেকটা কারণ, আমার গাওয়া গানটার মধ্যেও দুটো চরণ ছিলোঃ আকাশে উড়িছে বক পাতি, বেদনা আমার তারই সাথী……। আকাশের বককে ফুটবল মাঠে দেখতে পেয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম। বকগুলো কিসের আশায় এসেছিলো জানিনা, কারণ, যদিও ফুটবল মাঠটাকে তখন একটা নদীর মত দেখাচ্ছিলো, তথাপি সেখানে তো কোন মাছ ছিলনা। হয়তো কেঁচো টেচো বা পোকা মাকড় ওগুলোকে আকর্ষণ করেছিলো। যাই করুক না কেন, দৃশ্যটি তখন আমার চোখে বড়ই নয়নাভিরাম মনে হয়েছিল।
ভূঁইফোঁড় ঘুগরি পোকার বিস্ময়কর আবির্ভাবঃ
তখন খুব সম্ভব ভাদ্র মাস। শুনেছি ভাদ্র মাসের গরমে তাল পাকে। কয়েকদিন ধরে অসহ্য গরম পড়েছিলো, সাথে অস্বাভাবিক আর্দ্রতা। গায়ে কোন কাপড় রাখাই দায়। তার উপর ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিপর্যয়, কারণ কয়েকদিন আগেই প্রচন্ড ঝড় বাদল বয়ে গেছে। মানুষের জীবন ধারণই খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছিলো, পশুপাখি আর পোকা মাকড়ের কথা তো বাদই দিলাম। হঠাৎ একদিন দেখি আমাদের ফুটবল মাঠটাতে কোথা থেকে যেন লক্ষ লক্ষ ‘ঘুগরি পোকা’ ভূঁই ফুঁড়ে বের হচ্ছে। ‘ঘুগরি পোকা’ আমাদের এলাকার আঞ্চলিক নাম। এর পোষাকি নাম সম্ভবত 'উচ্চিংড়ে', এটাও এক ধরণের ঝিঁঝি পোকা। ঝোপ ঝাড়ের কাছাকাছি বা মাটিতে বাস করে। তেমন আক্রমণাত্মক নয়, তবে শুনেছি ছাগলকে কামড়ালে বা হুল ফুটালে নাকি মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। সেই ‘ঘুগরি পোকা’র দল ক্রমে ক্রমে হাউসের সামনে পেছনের মাটি থেকেও উদগীরণ হতে থাকলো। জানালা দিয়ে উড়ে উড়ে রাতে পড়ার টেবিলেও আসতে শুরু করলো। সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরের দিন কাঠফাটা রোদ উঠলো এবং সারাদিন ধরে আগুনের তাপ ছড়িয়ে গেলো। বিকেলে ফুটবল মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি গোটা মাঠ জুড়ে মরা ঘুগরি পোকার স্তুপ জমে উঠেছে। সন্ধ্যার দিকে নাকে শুঁটকির মত গন্ধ লাগতে শুরু করলো। সারাদিন ধরে রোদের তাপে লক্ষ লক্ষ ঘুগরি পোকা ভাজা ভাজা হয়ে মরে পঁচে যেতে শুরু করেছিলো এবং শুঁটকির মত গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। তার পরের দিন মাঠ পরিচর্যাকারীদের (গ্রাউন্ডস মেন) বস্তাভরে সেগুলোকে অন্যত্র ফেলে আসতে হয়েছিলো। কলেজ জীবনের এই আজব ঘটনাকে স্মরণ করে আজও খুব বিস্মিত হই এবং এর কোন কারণ বা ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।
একাকীত্বঃ
যত বড় হতে থাকলাম, ততই বুঝতে পারছিলাম যে আমি সবার সাথে থাকার সময় কোলাহলের মাঝেও একাকী বোধ করতাম, আবার একাকী থাকার সময় কখনোই একাকীত্ব বোধ করতাম না। তখন আমার ভাবনারাই আমার ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে যেত। তখনই জীবনে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি। ইচ্ছেমত যে কোন কাউকে কল্পনা করে ভাবতাম, সে আমাকে ভালোবাসে। শুরু হতো তাকে নিয়ে এটা ওটা লেখা। হয়তো তা কবিতা হতো, হয়তো না। তবে লেখাগুলো কাউকে কখনো দেখাতে পারতাম না, কারো সাথে এসব শেয়ার করতে পারতাম না। এভাবেই আমার কৈশোরের অনেক কবিতার অপমৃত্যু হয়েছে। কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলাম, এ সবই অলীক কল্পনা। আমি যেমন ভালোবাসা চাই, আমাকে তেমনভাবে আসলে কেউ ভালোবাসে না। চিরকালের আশাবাদী এই আমির ভেতরে কেমন করে যেন একটা শূন্যতা, একটা হাহাকারের বীজ ধীরে ধীরে গোপনে রোপিত হচ্ছিল। একটা অচেনা অস্থিরতা আমাকে তাড়াতে শুরু করলো। আমি ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করলাম, আমি কেউ নই, আমি জীবন পথের এক অনাদৃত পথচারী। আই এ্যাম নোবডি।
ঢাকা
২২ ডিসেম্বর ২০১৫
ঘুগরি পোকা
ঝিঁ ঝিঁ পোকা
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২১ সকাল ৮:১৫