আমাদের বাসায় কোন পঞ্জিকা নেই, থাকলেও হয়তো বুঝতে পারতুম না এখন কোন ঋতু ? তবে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস তিতলীর বাবা মাকে ভালো করেই জানান দিচ্ছে যে এটা শীতকাল। বাতাস যেন হাড় মাংস ভেদ করে মজ্জায় গিয়ে আঘাত করছে। শীতল বাতাসের ঝাপটায় একে একে খসে পড়েছে চারিদিকের সব হালকা পলকা ধুসর পাতার বেড়াগুলো। আর তাতেই যেন বড্ড বে আব্রু হয়ে গেছে বাসাটি আমাদের। শীতের কামড়ে বৌ আর আমি গুটি শুটি মেরে বসে থাকি আমাদের ছোট্ট খুপড়ি ঘরটিতে । তারপরও দেখতে পাই পাশের উচু দালান বাড়ী থেকে গিন্নীবান্নি মহিলাটি উকিঝুকি মেরে আমাদের দেখতে চেষ্টা করছে। আগেও উকি দিতো কিন্ত এখন বেড়া না থাকায় তার যেন সুবিধাই হয়েছে। এমন দেখে বৌ আমার কখনো লজ্জা পায় কখনোবা রাগে ফেটে পরে।
বুঝিয়ে বলি "রাগিস কেনো তিতলীর মা ? মহিলাটি যতই খারাপ হোক তারপরও দেখ আমাদের জন্য তার কত মায়া। প্রতিদিন আমাদের সবার জন্য খাবার দিয়ে যাচ্ছে। অজানা অচেনা কারো জন্য এমনটা কজন করে বল'?
আমার কথা শুনে কিছুটা শান্ত হয় বৌ তারপর জানতে চায় কবে আবার দেয়াল হবে আমাদের ?
'হবে হবে এত অস্থির হোসনা , যখন হবে তখন দেখবি কি সুন্দরই না হবে। কারো সাধ্য থাকবে না আমাদের ঘর বাড়ি দেখার'।
বৌ এর মুখে হাসি ফুটে উঠে, হাল্কা করে ঠোট ছুইয়ে দেয় আমার পিঠে।
মহিলাটি প্রতিদিন জানালা দিয়ে আমাদের খাবার দিয়ে একটু আড়ালে চলে যায় । আমরা যে তাকে ভয় বা লজ্জা পাই সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো বা। সেখানে খাবার খেতে হাজির হই বাচ্চাকাচ্চাসহ আমরা গোটা তিন চার পরিবার, এই যেমন আমরা ছাড়াও টুনির বাবা মা, কুহু ও তার বাবা মা সব্বাই।
আমরা ঘর থেকেই নজর রাখি মহিলাটি কখন প্লেট হাতে জানালায় এসে দাঁড়ায়। সাধারনত সকালের দিকেই উনি আমাদের নাস্তা দিয়ে থাকেন, কখনো বা বিকেলেই রাতের খাবার। ওনার খাবারে কিন্ত একটু নতুনত্ব থাকেই এটা আমার গিন্নীও স্বীকার করে।
কিছুদিন পরে এক দুপুরে হাত পা মেলে রোদ পোহাচ্ছি, সে সময় তিতলীর মা ডেকে বল্লো,
"একটা জিনিস খেয়াল করেছো তিতলীর বাবা" ?
'কি খেয়াল করবো বল'?
"দালান বাড়ির গিন্নীটাকে আজ কদিন হলো দেখছি না,জানালাগুলো বন্ধ, বারান্দায়ও তো আসে না" ।
'আছে হয়তো ঘরেই, শীতের চোটে বের হচ্ছে না '।
"তাতে কি শীত বলে কাপড় চোপড় ধুয়ে মেলবে না ! রোঁদ পোহাবে না বারান্দায় ! এটা কি একটা কথা হলো তোমার। শোনো ঐ যে ওনার পাশের বাসায় যারা থাকে তারাতো রোজ এত এত কাপড় নেড়ে দিয়ে যায় দুটো বারান্দা জুড়ে, তাদের বুঝি শীত লাগে না ! " গিন্নী বলে ওঠে।
গিন্নীর কথায় মনে হলো সত্যি হয়তো উনি চলে গেছেন , সে বেশিটা সময় বাসায় থাকে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য। তাই হয়তো খেয়াল করেছে, কিন্ত আমার সময় কই! আমিতো দিনরাত পরিবারের খাবার যোগাতেই ব্যাস্ত থাকি। খাবার ছাড়াও বেশ অনেক মাস ধরে দেখতে দেখতে প্রতিবেশীনিটির জন্য মনের মাঝে বেশ একটা মায়া পরে গিয়েছিল , তিতলীর মার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে উঠলো আমার ও।
আজ টুনির বাবার সাথে ঘরের পাশেই বসে বসে গল্প করছি। সে নাকি কার কাছ থেকে শুনেছে এখন নাকি মাঘ মাস আর কদিন পরেই গরম শুরু হয়ে যাবে ।
"তিতলীর বাবা, তিতলীর বাবা কই তুমি" ?
গিন্নীর উত্তেজিত গলা শুনে চমকে উঠি, উত্তর দেই
'এই যে এইখানে বসে আছি, কি হয়েছে' ?
"আরে দেখো দেখো ঐ যে ঐ মহিলাটি জানালায় দাঁড়িয়ে আছে"।
এক নজর দেখেই গিন্নীর হাসি হাসি চেহারার দিকে তাকিয়ে বললাম '
কি এত খুশী যে ? কালই তো রাগ হয়ে বলবি কি বেহায়া মেয়েছেলে দেখেছো ! কেমন উকি দিয়ে আমাদের দেখছে'।
"তা ঠিক, কিন্ত যাই বলো তিতলীর বাবা মহিলাটির জন্য আমার সত্যি মন কেমন করছিল"।
বলেই ফুরুৎ করে উড়ে গেল টুনির মাকে খুশীর খবরটা দিতে ।
আমরা যখন শতবর্ষী গাছ কাটতে ব্যস্ত তখন আমার ঘরের পাশের এই বিশাল দেহী অশ্বথ গাছটি রয়েছে ডালপালা মেলে আর যাতে কিনা পাখির কুজনে মুখরিত থাকে সারাদিন । চিকন খালের দু পাশ বাধানোর পরও গাছটি যাতে কাটতে না হয় তার জন্য কয়েকবার এক্সপার্টদের আসতে দেখেছি ।
ছবি আমার মোবাইলে।