দেয়াল কথা বলে
১২ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন ইতিহাসের মধ্য যুগ অর্থাৎ যাকে বলে অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত ঠিক সে সময় দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায় অত্যন্ত উন্নত এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল । বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সেই সভ্যতার স্রষ্টা ছিল ক্যম্বোডিয়ার বিখ্যাত খেমার রাজবংশ । এদের মাঝে শৌর্য্যে বীর্য্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা সপ্তম জয়বর্মন। যিনি তাদের চিরশত্রু চামদের হাত থেকে খেমার সাম্রাজ্যকে চির মুক্ত করেছিলেন ।
রাজা ৭ম জয়বর্মনের অসাধারন কীর্তির একটি রাজকীয় উপাসনালয় বাফুন
এরপর তিনি তার পুরো রাজত্বকাল জুড়ে সৃষ্টি করে গেছেন একের পর এক অসাধারন সব দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের। সেই অনেকের মাঝে উল্লেখযোগ্য একটি হলো এলিফ্যন্ট টেরাস ও লেপার কিং টেরাস। রাজা সপ্তম জয়বর্মনের অসাধারন সৃষ্টি তার রাষ্ট্রীয় মঠ প্রাসাত বেয়ন বিশ্বের রহস্যাবৃত টেম্পলের অন্যতম এক উদাহরন ক্যম্বোডিয়ার "বেয়ন -- প্রাসাৎ বেয়ন" দেখে এগিয়ে গেলাম খেমার রাজাদের রাজাপ্রাসাদ দেখার জন্য। কিন্ত সেই প্রাসাদের বর্তমানে কোন চিনহটুকু ও নেই। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ঘেটে জানা যায় সেই প্রাসাদটি ছিল কাঠের তৈরী তাই কালের করাল গ্রাসে খুব সহজেই লুপ্ত হয়ে গেছে সেই রাজপ্রাসাদ । এর পাশেই আজও দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রীয় মঠ বাফুন ও রাজাদের একান্ত ব্যবহারের জন্য নির্মিত মহাজাগতিক উপাসনালয় খেমার ভাষায় যার নাম ফিমিনিকাস বা ভিমান আকাশ ।
প্রাচীন সেই খেমার রাজাদের একান্ত ব্যক্তিগত মহাজাগতিক উপাসনালয় ফিমিনিকাসের বর্তমান রূপ
যদিও দুটো মঠেরই বর্তমান ভগ্নদশা বিশেষ করে ফিমিনিকাসের। প্রত্নতাত্বিকরা আপ্রান চেষ্টা করছে তাদের পুর্ব রূপে ফিরিয়ে আনতে। তিন স্তর বিশিষ্ট রাজকীয় মন্দির বাফুন মঠ দেখে বেরিয়ে আসলাম। আর এর ঠিক সামনেই উত্তর দক্ষিনে প্রলম্বিত এলিফেন্ট টেরাস আর লেপার কিং টেরাস। ৩৫০ মিটার লম্বা এবং ৬ মিটার উচু সেই বিখ্যাত টেরাস দুটো মুলত দেয়াল বেষ্টিত রাজধানী এংকরথমের পুর্বদিকের দেয়ালের অংশ বিশেষ।
এলিফেন্ট টেরাসের কিছু অংশ
প্রত্নতাত্বিকদের আবিষ্কার থেকে জানা এক সময়ে এই টেরাসের উপরে ছিল একটি বিশাল লম্বা হল রুম, এখন যার ভিত্তি টুকুই অবশিষ্ট রয়েছে ।
এলিফেন্টে টেরাসের দেয়াল ভাস্কর্য্য
এসব ইতিহাস শুনছি আর চলেছি এলিফেন্ট টেরাসের শান বাঁধানো পথ ধরে । যদিও কালের ছোয়ায় কিছু কিছু জায়গায় ক্ষয়ে গেছে সেই পথ তারপর ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় রক্ষনাবেক্ষন চলছে ঠিকই । টেরাসের পাশের বিশাল মহীরুহর ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে চলেছি।
টেরাসের চওড়া পথ যা একদা হল ঘর ছিল । আর এই পথ ছিল সেই হল ঘরের ভিত্তি
পথের ডান দিকে খোলা মাঠ ছিল, রাস্তাটি বর্তমানে নির্মিত। অদুরে জঙ্গলের ফাকে ফাকে দেখা যাচ্ছে ভাঙ্গা দেউলের সারি ।
শুনলাম এখানে বসেই ৭ম জয়বর্মন উপভোগ করতেন বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠান, যেমনঃ যুদ্ধ জয়ী সৈন্যদের বিজয় মিছিল, তাদের কুচকাওয়াজ, শোভাযাত্রা এবং খেলাধুলা ইত্যাদি। এছাড়াও প্রজাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ও তাদের অভাব অভিযোগের কথাও শুনতেন এখানেই বসে।
এখানেই কোন খানে বসে রাজন্যবর্গ দেখতেন বিজয় শোভাযাত্রা
এলিফেন্ট টেরাসের দেয়ালের পুর্বদিক অর্থাৎ বাইরের দিকের কিছু অংশে রয়েছে বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের ভাস্কর্য্য। দু হাত উচু করে যেন তারা আগলে রেখেছে রাজা ৭ম জয়বর্মনের এক অবিস্মরনীয় সৃষ্টিকে।
কাছ থেকে নেয়া গরুড়ের ভাস্কর্য্য
সার বাঁধা গরুড় হাতে নিয়ে আছে দেয়ালের ভার
দেয়ালের গায়ে আরো রয়েছে সে সময়ের এক উল্লেখযোগ্য প্রানী হাতীর ভাস্কর্য্য। দেয়ালের গায়ে খোদাই করা সারি সারি হাতীর মুর্তি।
হাতীর শুড় দিয়ে তৈরী হয়েছে এলিফেন্ট টেরাসের নয়নাভিরাম সব স্তম্ভসমুহ। এই ভাস্কর্যটি আপনি এংকরথমের প্রধান দেয়ালেও দেখতে পাবেন ।
পদ্মের না ফোটা কলিতে শুড় ডুবিয়ে রাখা হাতী দিয়ে বানানো টেরাসের স্তম্ভ। কি নান্দনিক এক শিল্পিত ভাবনার বহিপ্রকাশ
আরেকটু কাছ থেকে দেখি সেই যুথবদ্ধ ঐরাবতদের
হাতীর শুড়ের স্তম্ভের মাঝের দেয়াল ভাস্কর্য্য।
হাতীর শুড়ের সেই মনোরম সেই ভাস্কর্য্যের মাঝ দিয়ে উঠে গেছে টেরাসে ওঠার পথ
দেয়ালের গায়ে হাতীর অসাধারন সব ভাস্কর্য্য
এংকরবাসীর জীবনে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো এই নাগ অর্থাৎ সাপ ।
এই নাগ রাজের ফনা পার হয়ে দু পা এগুলেই বায়ে নীচের দিকেই দেখতে পাবেন একটি মন্দিরে যাবার পথ । এই মন্দিরটি ফিমিনিকাস বা ভিমিনাকাস নামে পরিচিত । তিন স্তর বিশিষ্ট হিন্দু মন্দিরের অনুকরনে নির্মিত ছিল এই মহাজাগতিক উপাসনালয়। তিন তালার উপরে ছিল একটি টাওয়ার যা সোনায় মোড়া এবং তা ছিল রাজার জন্য সম্পুর্ন সংরক্ষিত। এমনকি সেখানে রানীরও প্রবেশাধিকার ছিল না। কথিত আছে যে এখানে প্রতি রাত্রির প্রথম প্রহরে রাজা আসতেন নারীরূপ ধারিনী নয় মাথাওয়ালা এক নাগের সাথে মিলিত হতে। এই নাগকে তারা তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিভূ বলে মনে করতো। বলা হয় যে যদি কোন দিন রাজা আসতে না পারে তবে তার মৃত্যু অনিবার্য্য । আর যদি সেই রমনী রূপি সাপ না আসে তবে সাম্রাজ্যের উপর ভয়াবহ বিপর্য্যয় নেমে আসবে।
সামনেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেপার কিং টেরাস
এলিফেন্ট টেরাস শেষে শুরু হলো লেপার কিং টেরাস যা লম্বায় ২৫ মিটার । এর প্রধান দেয়ালের বাইরের দিকে খোদাই করা রয়েছে সাত স্তরের সারি সারি ভাস্কর্য্য আর এগুলো যেন সাত স্তরের পবিত্র মেরু পর্বতেরই প্রতিনিধিত্ব করছে ।
সাত স্তরে ভাস্কর্য্য সাজানো লেপার কিং টেরাসের মুল দেয়াল
লেপার কিং টেরাসের উপরের চত্বরে হাটু ভাজ করে বসে থাকা মুর্তিটি মূলত হিন্দুদের মৃত্যু দেবতা যমের । কিন্ত কালের করাল গ্রাস আর শ্যওলার অবাধ বিচরনে মুর্তিটি বিবর্ন হয়ে পড়ে । এই কারনে অনেকে মুর্তিটিকে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত খেমার রাজা প্রথম যশোবর্মন বলে সন্দেহ করে থাকে ।
এই সেই মুর্তি কারো কারো মতে ইনি মৃত্যু দেবতা যম আর কারো বা মতে কুষ্ঠ রাজা ১ম যশোবর্মন
তবে যমরাজের এ মুর্তিটি হলো রেপ্লিকা, আসল মুর্তিটি যেটা নমপেনের যাদুঘরে সংরক্ষিত। আর তার নীচে “ধর্মরাজা” নাম খোদাই করা রয়েছে যে নামে ক্যম্বোডিয়াবাসীরা ১ম যশোবর্মনকেকে জেনে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এই পথে এলিফেন্ট টেরাস থেকে নেমে গেলাম যাবো লেপার কিং টেরাসে
কুষ্ঠ রাজার কথায় এখানে একটি বিষয় প্রাসংগিক বলে উল্লেখ করতে চাই। তা হলো সে সময় খেমার সাম্রাজ্যে প্রচুর কুষ্ঠ রোগী দেখা যেত। প্রজাহিতৈষী রাজা জয়বর্মন তার পুর্বপুরুষ ১ম যশোবর্মন ও জনগনের কথা চিন্তা করে এবং তাদের কল্যানে সারা এংকর রাজ্যে ১০২ টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন । এখানে রোগীরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা পেতো । আজও এংকরের হাসপাতালে তার নাম রয়ে গেছে । আর কান্তা ভোপা হলো প্রয়াত রাজা নরোদম সিহানুকের চারবছর বয়সী কন্যাসন্তান যে জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল । তার স্মরনে রাজা সপ্তাহে একদিন বাচ্চাদের ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন
রাজা ৭ম জয়বর্মনের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে সপ্তাহে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতে আগত শিশুদের নিয়ে মায়েরা
এই লেপার টেরাসের আকৃতি ইউ আকারের । যমের মুর্তি ও আকৃতির জন্য এই জায়গাটিকে খেমার রাজাদের পারলৌকিক কাজের ক্ষেত্র বলেও মনে করা হয়ে থাকে।
দুভাগে ভাগ করা দেয়ালটি উপর থেকে উকি দিয়ে দেখে নিলাম
টেরাসের উপর থেকে নেমে এ পথ ধরে ভেতরে প্রবেশ করলাম
এই টেরাসটি একটি সরু করিডোর দিয়ে ভেতর বাইর এমন দুটি দেয়ালে ভাগ করা । আর সেই করিডোরের ভেতরের দেয়ালের গায়ে রয়েছে অসাধারন সব দেয়াল ভাস্কর্য্য ।
সেই সরু করিডোরে কাঠের পাটাতন আর এক দিকের দেয়ালে রয়েছে ভাস্কর্য্য সারি
স্বর্গসভায় আসীন স্বর্গের দেবতা্কুল
দেয়াল খুড়ে সৃষ্টি ভাস্কর্য্যের সারি
দেয়াল কথা বলে যায়
দেয়ালিকা
স্বর্গের দেবদেবী
দেয়াল ভাস্কর্য্য
রাজা ৭ম জয়বর্মনের অসামান্য কীর্তি এই দেয়াল ভাস্কর্য্য যা প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটককে আজো টেনে আনে
বহু মাথা নিয়ে ফনা তোলা নাগ
এতে রয়েছে স্বর্গের দেব- দেবীদের বসে থাকা বিভিন্ন ভঙ্গীমার মুর্তি , একাধিক মাথা বিশিষ্ট সাপ , অস্ত্র সজ্জিত রক্ষীরদল , গরুড় আর স্বর্গের অপ্সরা ।
দেয়ালের নীচের সারিতে কারা ওরা ? অপ্সরী কিন্নরীর দল ?
সারি সারি মুর্তি সাথে আছে নাগ
এরা কি বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল ?
এখানেও কি স্বর্গের বাসিন্দারা ?
এ সব পৌরানিক কাহিনীর চরিত্র ছাড়াও সেই দেয়াল ভাস্কর্য্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রানীর প্রতিকৃতি। কারো কারো মতে সেখানে খেমার রাজাদের ভাস্কর্য্যও রয়েছে। ভেতরের এই দেয়ালটি ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে খুড়ে আবিস্কার করেন এক ফরাসী প্রত্নতত্ববিদ।
সামুদ্রিক প্রানীর ভাস্কর্য্য
মাহুত পিঠে নিয়ে জঙ্গলের পথে চলেছে হাতী
দেয়ালে গাঁথা কত অজানা কাহিনী
এই পথে বের হয়ে এলাম সেই দেয়াল ভাস্কর্য্য দেখে
সেই এলিফেন্ট টেরাস আর লেপার কিং টেরাসের দেয়ালে দেয়ালে খোদাই করা বিচিত্র সব ভাস্কর্যগুলো যেন শত শত বছরের পুরনো কাহিনী বিরামহীন ভাবে ফিস ফিস করে বলে চলেছে । আর আমাদের মত শত শত পর্যটক প্রতিদিন এসে মুগ্ধ নয়নে দেখছে আর কান পেতে শুনছে দেয়ালের কথা ।
সাতটি স্তর বিশিষ্ট লেপার কিং এর দেয়াল ভাস্কর্য্য
হাসপাতালের ছবিটি ছাড়া সব ছবি আমাদের ক্যমেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১১