ইয়াই চাই মং খন মঠের প্রবেশ পথের পাশে বিশাল আকৃতির শায়িত বুদ্ধ
দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর অন্যতম থাইল্যন্ড এক সময় শ্যামদেশ নামেই সারা বিশ্বে পরিচিত ছিল , তার রাজধানী যে ব্যংকক এ তথ্য প্রায় সবারই জানা । কিন্ত আজ থেকে প্রায় ৪১৭ বছর আগে সেই দেশটির রাজধানী কোথায় ছিল? কি নাম তা বলতে গেলে অনেকেই হয়তো তৎক্ষনাৎ নেটে সার্চ দেবেন। আচ্ছা অত কষ্টের দরকার নেই আমি বলে দিচ্ছি।
রঙ্গীন ঝলমলে বাগান বিলাসের পাশ ঘেষে মুল মঠের দিকে এগিয়ে যাওয়া
থাইল্যন্ডের প্রাচীন রাজধানীটির নাম হলো আয়ুথিয়া বা সোজা বাংলায় যাকে বলে অযোধ্যা। ব্যাংকক থেকে ৭১ কিমি দূরে আয়ুথিয়া একটি প্রদেশ। সংস্কৃত আর পালি থেকেই থাই ভাষার উৎপত্তি , তাই এদেশে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । ভারতের অযোধ্যা থেকেই এই নামটি নেয়া হয়েছে , তবে স্থানীয় ভাষায় উচ্চারনে এটা আয়ুথিয়া নামেই পরিচিত । আমরাও থাইদের মত আয়ুথিয়াই বলি কেমন ?
ব্যংককের চারিদিক ঘেষে বয়ে চলা চির যৌবনা ছাও ফ্রায়া নদী । এই ছবিটি ১৮ তারিখ রাতে এশিয়াটিক ভিলেজে যাবার সময় তোলা ।
থাইল্যন্ডের বুকের উপর দিয়ে নিরন্তর বয়ে চলা স্নিগ্ধ সলিলা ছাও প্রায়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল আয়ুথিয়া । যা প্রায় চার দশক ধরে থাইল্যন্ডের রাজধানী হিসেবে তার গৌরব অক্ষুন্ন রেখেছিল। এই প্রাচীন রাজধানীর বিভিন্ন সৌধগুলির অনেকগুলোরই নির্মাতা ছিলেন রাজা উ-থং যার নির্মান সাল ছিল ১৩৫০ খৃঃ।
বুদ্ধের খন্ডিত মাথা যা মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল। এখন সে ডুমুর গাছের শিকড় জড়িয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে এক বিস্ময় নিয়ে । ওয়াট মহা থট বিহারের এক বিখ্যাত দ্রষ্টব্য ।
এখনো রাজতন্ত্রের দেশ থাইল্যন্ডের প্রাচীন রাজধানী আয়ুথিয়া থেকে প্রায় চার দশক ধরে একাধিক রাজবংশের মোট ৩৩ জন রাজা রাজত্ব করেছিলেন। বানিজ্য বান্ধব আয়ুথিয়ায় বানিজ্যের উদ্দেশ্যে সে সময় চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, ভারত, ইরান ছাড়াও সুদুর ইউরোপ থেকেও অনেক ব্যবসায়ীদের পদভারে মুখরিত ছিল এই নগরী। রাজধানী প্রাচীরের ঠিক বাইরে তাদের বসবাসের জন্য স্থায়ী বসতির ব্যবস্থাও করেছিল । এই ব্যবসায়ীদেরই লেখা বিভিন্ন কাগজ পত্র ও একাধিক শিলালিপি থেকে জানা যায় যে ১৭৬৭ সালের মহা বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত কি পরিমান শান শওকত আর জৌলুসে পরিপুর্নই না ছিল রাজধানী আয়ুথিয়া।
বুদ্ধদের পবিত্র মঠ চাই মংখন
১৭৬৭ সালে চির শত্রু বর্মী সৈন্যদের আক্রমনে প্রাচ্য অর্থাৎ দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার গর্ব এই সমৃদ্ধশালী নগরীটির পতন ঘটে । শুধু পতনেই ক্ষান্ত হয়নি বার্মিজ সৈন্যবাহিনী, সারা রাজধানী জুড়ে চালিয়েছিল তাদের তান্ডবলীলা। ছারখার হয়ে গিয়েছিল সেই সুবর্নভুমির সব সৌধসমুহ, রাজকীয় সব বৌদ্ধ বিহার, স্তুপা যাকে থাই ভাষায় বলা হয় ছেদী। আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো বর্মীরা শতকরা ৯০% বৌদ্ধের অনুসারী হওয়া সত্বেও রাজকীয় বৌদ্ধ বিহার ওয়াট মহাথটের প্রায় সব বুদ্ধ মুর্তির মাথা আর হাত কেটে ফেলেছিল ।
সিড়ি বেয়ে উঠে চলেছে পর্যটকদের সাথে সাথে দেশ বিদেশের তীর্থযাত্রীরাও । আমি গতবার উঠেছিলাম , এবার যাই নি
২,২৫৭ বর্গ কি:মি: জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন রাজধানী আয়ুথিয়া প্রদেশটি আয়তনের দিক দিয়ে অন্যান্য প্রদেশের সাথে তুলনা করলে বেশ ছোটই বলতে হবে। কিন্ত ছোট হলে কি হবে! সেই ছোট জায়গাই প্রচুর পর্যটকের পদভারে ভারী হয়ে উঠে নিত্যদিন ।
ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রাখার জন্য ১৯৯১ সালে ইউনেস্কো আয়ুথিয়াকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দেয়। এক সময়ের এই ডাকসাইটে রাজধানী আয়ুথিয়া ছিল আমাদের এবারের গন্তব্য । আমার অবশ্য এ নিয়ে দ্বিতীয়বার যাওয়া তবে সহ পর্যটকের জন্য প্রথম ।
ওয়াট ইয়াই চাই মং খন মঠ দেখার জন্য উষ্ণ আহবান
মাথা পিছু ১৫০০ বাথের প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে সারাদিনের এই ভ্রমনের কর্মসুচীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল গাড়ী ভাড়া, দুপুরের খাবার এবং প্রতিটি জায়গায় প্রবেশের টিকিট ফি এবং গাইড ফি। তবে হাতী চড়া, বাংপা ইনে ব্যটারির গাড়ী ভাড়া, চা কফি খাওয়া, আর গাছ কেনা এসব নিজেদের।
সকাল ৮.৩০টায় গাইড আমাদের তুলে নিল এম্বেসেডার হোটেলের লবি থেকে । আমাদের দুজনকে নিয়ে মোট আটজন পর্যটক যার মাঝে ছিল চীন থেকে আসা মা বাবা ছেলে আর বৌ , একজন ডাচ আরেক জন রুমানিয়ান। পীচ বাধানো খোলা রাস্তায় ভ্যানে করে ছুটে চললাম ৭১ কিমি দুরে সেই অযোধ্যা প্রদেশে আর এক লহমায় যেন হাজির হোলাম বাংপা ইন প্যালেস গেটে (এর আগের পোষ্ট)।
ঢুকতেই একটি ছোট্ট মঠ । তাতে ভক্তরা তাদের দেবতাকে খুশীমত দান করে গেছে। এতে কোমল পানীয় ছাড়া দুটো ডোরেমনও দেখা যাচ্ছে
মঠের পাশেই সুইট এই কুকুরটি দেয়াল বাইছে
এর পর আমাদের গন্তব্য হলো প্রাচীন রাজধানী আয়ুথিয়ার বিখ্যাত মঠ, স্তুপা ও রাজ বিহার । বৌদ্ধধর্মাবল্মবীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই সব মঠের এর কোন কোনটায় এখনো উপাসনা হয়। আমরা দেখলাম এবং গাইডও জানালো যে এখানে চীন জাপান সহ অনেক বুদ্ধধর্মাবল্মবী দেশের প্রচুর ভক্তরা শুধু এই তীর্থস্থান ভ্রমনের জন্যই এখানে এসে থাকে। ওয়াট ফহ প্রাঙ্গনে শায়িত থাকা বিশাল বুদ্ধের মুর্তির পাশ দিয়ে টিকেট ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ---
আসুন আমার চোখে দেখুন সেই প্রাচীন এক রাজধানী আয়ুথিয়া বা অযোধ্যাকে ।
ওয়াট ইয়াই চাই মংখন মঠ
মুল মঠের প্রার্থনা ঘরের দিকে সিড়ি বেয়ে চলেছে পর্যটক সাথে তীর্থযাত্রীরাও
কয়েক ধাপ সিড়ি বেয়ে উঠে দেখে নিলাম চারিদিক । সামনের চত্বর
নীচের মঠ যেখানে ভীড় করে আছে পূন্যার্থীরা , হিন্দু ধর্মের প্রভাবের কারনে সমুদ্র মন্থনের নাগের মুর্তিও বুদ্ধের সামনে উপস্থিত
মঠের চারিদিকে ঘোরানো সার বাধা কালো পাথরের বুদ্ধের মুর্তি
সব কিছু খুটিয়ে দেখার পর ওখান থেকে বের হয়ে আসলাম । প্রচন্ড তৃষ্ণা পাওয়ায় মিনারেল ওয়াটার না খেয়ে একটা ডাব খেলাম । সুর্য্য তখন মধ্য গগনে থাকলেও নভেম্বর মাস বলে থাইল্যন্ডের বিখ্যাত গা ঝলসানো গরমটা অনুভব করছি না । গাইড জানালো সিডিউল অনুযায়ী এবার আমাদের খাবার সময় । ছাও ফ্রায়া নদীর তীরের এক রেস্তোরা আগে থেকেই নির্ধারিত । নদীর দিক উন্মুক্ত সেই রেস্তোরার চারিদিকে সবুজ গাছ- ফুল আর ছাও ফ্রায়া থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাস যেন দেহ মন জুড়িয়ে দিল।
আমাদের রেস্তোরার খোলা ব্যলকনি থেকে ছাও ফ্রায়া নদী
নীল রঙের টেবল ক্লথে ঢাকা সার বাধা টেবিলের একটিতে আমরা বসলাম , গাইড আর ভ্যান চালক আরেক টেবিলে । মেনুও পুর্ব নির্ধারিত । একটু পরেই বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসলো পরিবেশিকারা তাদের মুখে আমন্ত্রনের এক মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে। গাইড আমাদের আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছে আমাদের পছন্দ/অপছন্দের তালিকা । সাদা ভাতের সাথে বিভিন্ন তরকারী এককথায় সত্যিকারের থাই কুজিন যাকে বলে । অত্যন্ত সুস্বাদু সেই খাবারের স্বাদ গ্রহন করতে করতে তাকিয়ে দেখছি ছোট ছোট টাগ বোট কি বিশাল বিশাল পন্য পরিবহন জাহাজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে । সাথে সাথে আমাদের মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গার কথা করুন চেহারাটি মনে ভেসে আসলো। হায়রে আমার নদী মাতৃক দেশ ।
।
সেই সুস্বাদু খাবারের কিছু অংশ
সকাল থেকে অনেকক্ষন হাটাহাটি আর নাস্তা খাবার সময় না মেলায় মেইন কোর্স সহ বিভিন্ন ফলের ডেজার্ট খেলাম আয়েশ করে। সবার সাথে বিশেষ করে সেই ডাচ আর রুমানিয়ান পর্যটকদের সাথে হাসি ঠাট্টা গল্পে কখন ১ ঘন্টা কেটে গেল টেরই পাই নি। চাইনীজরা ইংরাজীতে দক্ষতা না থাকায় আমাদের সাথে শুধু হাসি বিনিময় করছিল । একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ভ্যানে (বড় বড় হাইএস এর মাইক্রোবাসকে এরা ভ্যান বলে ) চড়ে রওনা হোলাম পরবর্তী ইভেন্ট হাতীর বিভিন্ন শো দেখার জন্য। সেখানে টাকার বিনিময়ে আপনি নিদির্ষ্ট সময় পর্যন্ত হাতীতে চড়তে পারেন । এখানে উল্লেখ্য যে আমার হাতী প্রেমিক স্বামী হাতীর ছবি তুলে আর ভুট্টা খাইয়েই ক্ষান্ত দিল, এই বয়সে হাতী চড়ে হাত পা ভাঙ্গার আর রিস্ক নিলনা ।
সাঁর বাধা হাতীর দল শুড় নামিয়ে আমাদের অভিবাদন জানালো ।
হাতীদের খাবার হিসেবে ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে । আপনিও কিনে খাওয়াতে পারবেন উপরে সাজিয়ে রাখা বেতের তৈরী এক ঝুড়ি ভুট্টা দানা ১৫ বাথে
এখানে কফি খেয়ে রাস্তার অন্য পাশের সার বাধা স্যুভেনীরের দোকানে ঢু মেরে আসলাম সবাই । এরপর আমাদের শেষ গন্তব্য হলো ওয়াট মহাথট । এখানেই রয়েছে বার্মিজ সৈন্যদের ধ্বংসলীলার সবচেয়ে বেশি স্বাক্ষর ।
ওয়াট ফ্র মহা থটে প্রবেশ পথ পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা
এখানে আপনার আচার আচরন কেমন হবে সে সম্পর্কে নির্দেশাবলীর ছবি দেয়া আছে । অর্থাৎ মুর্তির গায়ে হাত না দেয়া , কোন প্রাচীরে না বসা ইত্যাদি
আমার নিকের ফুল কাঞ্চন গাছের নীচে কাচের ভেতর রাখা আছে স্থানটির মানচিত্র ।
লাল ইটের তৈরী নকশা করা অষ্টভুজা তিনটি স্তুপা, স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ছেদী
প্রাচীন রাজধানী আয়ুথিয়ার ভেঙ্গে পড়া সব উপাসনালয়
বার্মিজ সৈন্যদের বর্বরতার সাক্ষী মাথা বিহীন বুদ্ধের মুর্তি
মুল রাজ বিহারের ধ্বংসস্তুপের দিকে এগিয়ে চলেছি
এবার আমার ক্যমেরার চোখে দেখুন সেই ওয়াট ফ্র মহা থট বা রাজ বিহার ।
একদা আয়ুথিয়ার গর্ব ওয়াট ফ্র মহা থট রাজবিহারের ধ্বংসাবশেষ
রাজ-বিহার ওয়াট ফ্র মহা থট
মস্তকহীন বুদ্ধের মুর্তি , একই ধর্মের অনুসারী হয়ে এই বর্বরতার কি কারন বুঝলাম না।
রাজ বিহার প্রাঙ্গনে
লাল ইটের নান্দনিক কারুকার্য্যময় এক অক্টাগোনাল স্তুপা
ছিন্ন মাথার বুদ্ধ তার জায়গায় অধিষ্ঠিত
রাজ বিহার প্রাঙ্গন
বিশাল এলাকা জুড়ে ওয়াট ফ্র মহা থট বিহার
লাল ইটের স্তুপা
অষ্টভুজা স্তুপা, থাই ভাষায় যাকে বলা হয় ছেদী
লাল পোড়ামাটির ইটের দেয়াল ঘেষে সারি সারি মুন্ডু বিহীন কালো পাথরের বুদ্ধ
চত্বরের শেষ মাথায় বুদ্ধের প্রতিকৃতি, পেছনে অষ্টভুজা ছেদী বা স্তুপা
এই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে আমিও বিদায় বেলায় একটা ছবি তুলে ফেললাম
গাইডের মাথা খারাপ করে পথের উলটো দিকে গাড়ী থামিয়ে কিনে নিলাম সেই রেস্তোরায় দেখা এয়ার প্ল্যান্ট যা কেনার চিন্তা আমার মাথা থেকে নামছিলোই না
বাতাস খেয়ে বেচে থাকা এয়ার প্ল্যন্ট, তবে দিনে একবার পানি দিতে হয় বৈকি
ছবি আমাদের ক্যমেরায়
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৮