আজ আপনাদের নিয়ে যাবো আরেক রাজবাড়ীতে তবে নমপেনের রাজ বাড়ীর মত এই অপরূপ বাগান ঘেরা রাজপ্রাসাদগুলোতে কিন্ত বর্তমান রাজা বসবাস করেন না । এটা হলো ব্যংকক থেকে ৮১ কিঃমিঃ দুরে একদা শ্যামদেশের রাজধানী অযোধ্যা নগরীতে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বীনি ছাও ফ্রায়া নদী। ছবির মত সবুজ সাজানো বাগানে অসাধারন সব সৌধ সমুহের শৈল্পিক উপস্থাপনায় আপনি বিস্মিত হবেন আর হয়তো মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাবে "বাহ কি সুন্দর"! স্থানীয় ভাষায় এর নাম ‘বাংপা ইন সামার প্যালেস’। আসুন ঘোরাঘুরি করার আগে এর সামান্য ইতিহাস জেনে নেই।
বাংপা ইন গ্রীষ্মাবাস
১৬৩২ খৃষ্টাব্দে থাইল্যান্ডের রাজা প্রাসাদ থং এই রাজকীয় গ্রীষ্মাবাসের গোড়াপত্তন করেন । কিন্ত তার কোন ব্যবহার না থাকায় উনিশ শতাব্দী পর্যন্ত সম্পুর্ন এলাকাটি ঢেকে যায় বিশাল মহীরুহ আর বুনো লতাগুল্মের ঠাস বুনুনিতে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে থাইল্যান্ডের সুদীর্ঘকাল ধরে রাজত্বকারী বিখ্যাত চক্রী বংশের রাজা মঙ্কুটের দৃষ্টিগোচরে আসলো সেই গ্রীষ্মাবাস। সাথে সাথে বন জঙ্গল পরিস্কার করে একটু একটু করে গড়ে তুলতে শুরু করেন তাকে নতুন রূপে।
থাই প্যাভিলিয়ান
রাজা মঙ্কুটের কথা কি আপনাদের কিছু জানা আছে ? কেউ কেউ হয়তো জানেন , আর তাদের জন্য রইলো একটি সুত্র দেখি বলতে পারেন কি না ?
আচ্ছা আমিই বলি। অনেক বছর আগে টিভিতে একটা সিরিজ হতো নাম এনা এন্ড দ্যা কিং। এই ছবির কিং ছিলেন থাইল্যন্ডের রাজা মংকুট। আর রাজা মংকুটের চরিত্রে রূপ দিয়েছিলেন হলিউডের এক অসাধারন শক্তিমান নায়ক নাম ইয়ুল ব্রাইনার। সুদর্শন এবং পুরুষোচিত এই নায়কের স্টাইল ছিল তাঁর মুন্ডিত মস্তক।
কিং এন্ড আই ছবিতে ইয়ুল ব্রাইনার ও ডেবোরাহ কার
ইয়ুল ব্রাইনার অভিনীত বেশিরভাগ ম্যুভিই হলিউড তথা বিশ্বের ব্লক বাস্টারের তালিকায় রয়েছে । এসব ছবির মাঝে “ দ্য কিং এন্ড আই” যার জন্য তিনি একাডেমী এওয়ার্ড পেয়েছিলেন । এ ছাড়া শুধু আমারই নয় সারা বিশ্বের অনেকেরই প্রিয় ম্যুভি হচ্ছে “দ্য ম্যাগ্নিফিসেন্ট সেভেন, লং ডুয়েল, তারাস বালবা, পোল্যন্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়া জাপোরাজেয় এক কসাক নেতা তারাস বালবার নাম ভুমিকায় আর টেন কমান্ডসমেন্টস ম্যুভিতে সেই মদমত্ত গর্বিত মিশরের ফেরাউন দ্বিতীয় র্যামেসিসের ভুমিকায় ইয়ুল ব্রাইনারের অভিনয় আজও মানুষের মনে দাগ কেটে আছে।
রাজা মংকুট ও তার স্ত্রী সন্তান সাথে ইংরাজী শিক্ষিকা আনা
থাক ইয়ুল ব্রাইনারের গল্প এবার আসা যাক আসল রাজা মংকুটের কথায়।থাইল্যন্ড যেখানে আজও সে দেশের অধিকাংশ মানুষ ইংরেজী বলতে/ বুঝতে অপারগ। সেখানে রাজা মংকুট আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ইংরেজী ভাষা শেখার ব্যপারে প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন। শুধু তিনি নিজেই নন, তিনি তার একাধিক স্ত্রী ও সন্তানদের ইংরাজী ভাষা শেখানোর জন্য আনা নামে এক বৃটিশ তরুনী শিক্ষিকাকে নিয়োগ করেন । সেই পরাক্রমশালী গোঁয়ার রাজা মঙ্কুট আর শিক্ষিকার মধ্যে বিভিন্ন মজার মজার ঘটনাই ছিল ম্যুভির উপজীব্য।
চাইনীজ প্রাসাদের প্রবেশ দুয়ার
মংকুটের রাজত্বের পর গ্রীষ্মাবাসের প্রাসাদগুলো চুড়ান্ত রূপ পেয়েছে ১৮৭২- ১৮৮৯ পর্যন্ত সময়কালে। বিশেষ করে তার ছেলে রাজা চুয়ালালংকর্ন ওরফে পঞ্চম রামার হাতে।প্রজাদের অত্যন্ত প্রিয় রাজা চুয়ালালংকর্ন এর প্রজ্ঞা আর দুরদর্শিতার জন্যই থাইল্যান্ড সে সময় উপনিবেশ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
বিভিন্ন দেশের নকশায় তৈরী প্রাসাদ
ইওরোপের রাজ বংশের মত তিনিও থাইল্যন্ডে প্রথমবারের মত উপাধীর সাথে সংখ্যাক্রম যোগ করেছিলেন। যেমন তিনি পঞ্চম রা্মা উপাধী ধারন করেন ।বর্তমান থাইল্যন্ডের রাজা ভুমিবলও নবম রামা উপাধীতে ভুষিত। বলা হয়ে থাকে চুলালংকর্নের রাজত্বকালের অনেক সিদ্ধান্তে তার কিশোর বেলার শিক্ষয়িত্রী আনার গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল থাইল্যান্ড থেকে দাস প্রথার উচ্ছেদ। শিক্ষাক্ষেত্রেও ঘটেছিল ব্যপক উন্নয়ন । তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ব্যংককের চুয়ালালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে এক গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছে।
প্রাসাদ প্রাঙ্গন
ভাষা ও সংস্কৃতে ভারতীয় প্রভাব একদা শ্যামদেশ তথা থাইল্যন্ডে প্রকট তা সেই রাম আর অযোধ্যা থেকেই বোঝা যায় কারন তাদের ভাষার অর্ধেকের ও বেশি এসেছে ভারতীয় আদি ভাষা সংস্কৃত ও পালি থেকে।
প্রাচীন কম্বোডিয়ার নির্মান রীতিতে তৈরী মন্দির
রাজা মংকুট ইওরোপের সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন যার প্রতিফলন দেখা যায় বাংপা ইনের বিভিন্ন প্রাসাদ, বাগান, পথ, সেতু তৈরীতে। বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মান করেছিলেন প্রাচ্য ছাড়াও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর বহুল ব্যবহার ।
ইউরোপিয় নকশায় তৈরী পথ
কিছু লিখতে গেলেই ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া যেন আমার স্বভাবে পরিনত হয়েছে । যাক যা বলছিলাম তা হলো এই গ্রীষ্মাবাসের একেকটি প্রাসাদ বা স্থাপনা নির্মানে রয়েছে ভিন্নতা যা পর্যটকদের কাছে বিস্ময়কর । প্রাসাদ ছাড়াও রাস্তা, বাগান, লেক, ভাস্কর্য্য এক এক দেশের ঐতিহ্যবাহী নকশায় তৈরী যার কোনটির সাথে কোনটির মিল নেই। সবুজ শ্যমলিমা ঘেরা অসাধারন দৃষ্টিনন্দন বাগান আর লেকের মাঝে মাঝে এই অপুর্ব প্রাসাদগুলো নির্মান ও নকাশার বৈচিত্রে সত্যি বিস্ময় সৃষ্টি করে ।
বাগান আর লেক
বর্তমান রাজা ভুমিবল এখানে বসবাস করেন নি কখনো । শুধু মাত্র কোন রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা বিদেশী মেহমানদের অভ্যর্থনা ও ভোজসভার জন্য তিনি এই প্রাসাদগুলো ব্যবহার করেছেন । দু একটা ভবন আর ঘর ছাড়া সবই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে , তাই এটা এখন পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য।
প্রাসাদগুলোর মাঝে এমন লেক সৃষ্টি করেছে দুরত্ব আর দৃষ্টিনন্দন সেতুতে রেখেছে বেধে
সেই স্বর্গ্যরাজ্যে আর অযোধ্যার আরো কিছু দর্শনীয় স্থান ভ্রমনে বের হোলাম আমরা দুজন। আমাদের গ্রুপে ছিল আট জন , চার জন চাইনীজ, একজন রুমানিয়ান ও এক জন ডাচ । অবশ্য এখানে আমার ২য়বার ভ্রমন । আসুন আমার চোখে আপনিও দেখুন থাইল্যন্ডের রাজাদের সেই বিখ্যাত গ্রীস্মবাস বাংপা ইন সামার প্যলেস ।
এখান থেকে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম ।
এই ব্যাটারীর গাড়ীগুলো ভাড়া নিতে পারেন এক ঘন্টা ৪০০ বাথ দিয়ে ।
একটিতে চারজন বসা যায় , আমরা দুজন আর ডাচ আর রুমানিয়ান মিলে একটা ভাড়া করলাম । আর সেই চাইনীজ পরিবার বাবা মা ছেলে বৌ মিলে আরেকটি ভাড়া নিল । তারপর শুরু হলো আমাদের যাত্রা সেই নন্দন কাননের পথে।
চারিদিকে এমন গাঢ় সবুজ চাদর বিছানো মাঠ
সবুজ ঘাসের বাগানে গাছ দিয়ে বানানো হাতির দল
প্রাসাদ প্রাঙ্গন
চীনা নকশার প্রাসাদ
প্রাসাদ এর সামনের আঙ্গিনায় চৈনিক নকশা
জাফরী কাটা বিভিন্ন নকশার ঝালর চীনা রীতির
চীনা প্রাসাদের প্রবেশ পথ
শাপলা গাছ চীনামাটির টবে
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রাসাদের আদলে তৈরী এই ভবন ।
এই বিশাল ভবনে বিদেশী রাজকীয় অতিথিদের সন্মানে রাজকীয় ভোজসভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়, এখানে প্রবেশ নিষেধ
এই প্যলেসের প্রবেশ পথে ফুলেল শুভেচ্ছা
পানিতে নামার জন্য বাধানো ঘাটের পাশ
গ্রেইকো রোমান স্টাইলে তৈরী প্রাসাদ
ইতালীয়ান নকশায় তৈরী একটি সেতু
ইতালীয়ান নকশায় তৈরী সেতু থেকে অদুরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা দৃশাবলী
পারস্য রীতিতে তৈরী একটি ছাউনি
গথিক দুর্গের নকশায় তৈরী
ডাচ নকশার বাতিঘর কিন্ত এটা ব্যবহার করা হতো এবং এখনো হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে
রানী সুনন্দা কুমারীরত্না ও তার শিশু কন্যা
রাজা চুয়ালালংকর্নের স্ত্রী উনিশ বছর বয়স্কা রানী সুনন্দা কুমারীরত্না ছোট শিশু কন্যাকে নিয়ে ছাও ফ্রায়া নদীপথে আযোধ্যার প্রাসাদে আসছিলেন । হঠাৎ খেলতে খেলতে শিশু কন্যাটি নদীতে পড়ে যায় । তাকে বাচানোর জন্য সাতার না জানা রানী সাথে সাথে নদীতে লাফিয়ে পড়েন । মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খাবি খেতে খেতে এক সময় তলিয়ে গেলেন রাজ কর্মচারীদের চোখের সামনে । কেউ তাকে বাচাতে এগিয়ে যায়নি । কারন সাধারনের রানীকে স্পর্শ করা নিষেধ । এ ঘটনায় রাজা অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন এবং তাদের স্মরনে এই সৃতিসৌধটি নির্মান করেন ,
রাজা চুয়ালালংকর্নের কিশোরী স্ত্রী সুনন্দা কুমারীরত্না ও কন্যার স্মরনে সৃতিসৌধ ।
অল্পবয়সী এক রাজপুত্রের মৃত্যুর স্মরণে নির্মিত সৌধ
রাজ প্রাসাদ পাহারা দেয়ার সময় শেষ এই সৈনিকদের । এখন নতুন সৈনিকদের পালা
আমাদের গাড়ীর নির্ধারিত সময় এক ঘন্টা পেরিয়ে ১০ মিনিট বেশী হয়ে গেল । গাইড জানালো এই অতিরিক্ত ১০ মিনিটের জন্য আমাদের ১০০ বাথ বেশি দিতে হবে তবে এই ১০০ বাথ বেশি দিলে আমরা আরো একঘন্টা ঘুরতে পারবো গাড়ীতে। আমাদের চালক হাসি খুশী রুমানিয়ান পর্যটক বল্লো "তাহলে চলো আমরা আরো ৫০ মিনিট ঘুরি" । ৫টি ভাষায় পারদর্শী সেই তরুন পর্যটক অন্যান্যদের সাথে হাসি তামাশা করে গাড়ী চালিয়ে ঠিক এক ঘন্টায় আমাদের নিয়ে আসলো নির্ধারিত জায়গায় ।
দ্য কিং এন্ড আই ম্যুভির ছবি দুটো নেট থেকে নেয়া। বাকি সব আমাদের ক্যামেরায় আমাদের তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ ভোর ৬:০৯