এংকরভাট ....ছবিটি.আকাশ থেকে নেয়া
বেশ কয়েক বছর আগের কথা কর্তা মশাই অফিসের কাজে দু’দুবার কম্বোডিয়া সফরে আসে। সেসময় সেখানে বহু শত বছর লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা পৃথিবী বিখ্যাত কিছু নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম দেখে গিয়েছিল । ফিরে এসে আমার কাছে নানা রকম বর্ননায় ও ছবি দেখিয়েও যখন তার সৌন্দর্য্য, তার মহিমা তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন সে আমাকে কোন একদিন সশরীরে সেখানে নিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল । সেই স্থাপনাটি ছিল কম্বোডিয়ার সিয়াম রেপের এংকরভাট। এরপর থেকেই মনের মাঝে এংকরভাট দেখার এক সুপ্ত স্বপ্ন লালন করতাম। সেটাই পুরন হলো ২০১৫ এর নভেম্বর ২০ তারিখ এ কম্বোডিয়ায় পা দিয়ে।
এংকরভাট এক নতুন বিস্ময়
মনে পড়লো আরও একজন এমনি করে আমার মতোই এংকরভাটকে দেখার জন্যে এসেছিলেন । তিনি হলেন আমেরিকার বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী যিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন তার কথা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে ? সেই কেনেডির অকাল বিধবা পত্নী জ্যকুলিন কেনেডি । ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকা বনাম ভিয়েতনাম সেই ভয়ংকর উত্তাল যুদ্ধের মাঝেও চুপি চুপি কম্বোডিয়া এসেছিলেন শুধুমাত্র নিজ চোখে তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন এংকরভাটকে এক নজর দেখার জন্য। এমনই অদম্য এই এংকরভাট এর আকর্ষন।
সেই এংকরভাট দেখার জন্যে ঢাকা থেকে উড়ে এসেছি আমিও ২০১৫ এর ২০শে নভেম্বর। ক্যম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে ৩২০ কিমি উত্তরে এক শহর নাম তার সিয়াম-রেপ। আর এই সিয়াম-রেপই তার বুকে ধারন করে আছে এংকরভাট সহ হাজারো মন্দির এবং বিভিন্ন স্থাপত্যের সব ধ্বংসাবশেষ
পথের পাশে প্রিয় তাল গাছের সারি আর এমন পিচ ঢালা মসৃন পথে সিয়াম রেপের উদ্দেশ্যে চলেছি ।
রাজধানী নমপেন থেকে সকাল আটটায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভ্যানে করে জাতীয় ৬ নম্বর সড়ক ধরে রওনা দিলাম সিয়াম রেপ এর উদ্দেশ্যে। ভাড়া মাথাপিছু আট ডলার । উল্লেখ্য এখানে স্থানীয় মুদ্রা রিল আর ডলার পাশাপাশি চলে ।বিষুবরেখার উপর কম্বোডিয়া দেশটিতে ঋতু বলতে দুটি গ্রীস্ম আর বর্ষা । এখন গ্রীস্মকাল ,বাইরে তীব্র গরম , বাতাসে আদ্রতার ছোয়া নেই । ৬ ঘন্টা লাগলো গন্তব্যে পৌছাতে অবশ্য এর মাঝে পেট্রোল নেয়া + চা বিরতি আর দুপুরে খাবার বিরতি ছিল ১৫ মিনিট ।
এমন টুক টুক নামক যানবাহনই বেছে নিলাম সিয়াম রেপ ঘোরার জন্য
আগে থেকে নির্ধারিত হোটেলে উঠে ট্রিপ এডভাইজারের পরামর্শ মত আমরাও টুক টুক ভাড়া করেই ঘুরবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম । প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনি এংকরভাট ও তার আশে পাশে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারবেন, ভাড়া ১৫ ডলার ।
প্রতিদিন রাতে বসে বিখ্যাত এই বাজার
হোটেলের পাশেই সিয়াম রেপের বিখ্যাত নৈশ বাজার । উন্মুক্ত ছাদের নীচে চলছে খাওয়া দাওয়া, তারই সাথে পাল্লা দিয়ে কোন কোন পানশালায় উচ্চস্বরে বেজে চলেছে ইংরাজী আর স্থানীয় ব্যান্ডের গান। বিশাল তবে অস্থায়ী এক ছাদের নীচে ছোট ছোট স্যুভেনীরের দোকান। তাতে স্থানীয় জিনিসপত্র সাজিয়ে বিকিকিনিতে ব্যস্ত মেয়েরা।
সেই নৈশ বাজারে এক ছবি বিক্রেতার সাজানো পসরা
প্রচুর পর্যটক বিশেষ করে ইউরোপীয়, চৈনিক, জাপানি ও কোরিয়ানরা সে বাজারে গিজ গিজ করছে । শুধু রাত্রির জন্য ঝাপি খুলে বসা এই জমজমাট মেলায় ভীড় করা হাজারো পর্যটকের মাঝে এই উপমহাদেশের মনে হয় আমরা দুজনাই ছিলাম।
সারাদিনের পথ চলায় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত আমরা এক ভারতীয় রেস্তোরায় মাসালা দোসা খেয়ে হোটেলে যখন ফিরে আসি তখন রাত প্রায় দশটা। রুমে ফিরে নমপেন এয়ারপোর্ট থেকে এংকরভাটের উপর কেনা দুটো বই নিয়ে বসলাম দুজন। কারন কাল যে যেতে হবে তার আগেই তার পরিচয়টা জেনে যাওয়া ভালো।
এংকরভাটের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দ্বিতীয় সুর্য্যবর্মন। তাঁর আগে খেমারদের আর কোন রাজার চিত্র নেই বলেই ধারনা করা হয়। এই পাথরের দেয়াল ক্ষুদে নির্মিত ভাস্কর্য্যটি দেখতে পাবেন এংকরভাট মন্দিরের দক্ষিন গ্যালারীতে
পড়তে গিয়ে দেখি ভীষন জটিল এই এংকরভাটের ইতিহাস । এই জটিলতার কারন হলো যথেষ্ট তথ্যের অভাবে । একটি ইতিহাস রচনায় যেসব উপাদানের দরকার তার খুব কমই পাওয়া গেছে এখানে। তারপর ঐতিহাসিকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় যতটুকু জানা গেছে এই বিস্ময় সম্পর্কে তা থেকে টুকরোটাকরা জোড়া দিয়ে দিয়ে একখানি সংক্ষিপ্ত লেখা লিখছি আপনাদের জন্যেই ......
শুধু বিশ্ব ঐতিহ্যই নয়, এংকরভাট এখন বিশ্বের বিস্ময়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত
বিশ্বের আশ্চর্য্যতম স্থাপনার তালিকায় থাকা এক উল্লেখযোগ্য নাম এংকরভাট। নামটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত হলেও আবার কারো কাছে হয়তো একেবারেই নতুন।
একদা হিন্দু মন্দির হিসেবে নির্মিত থেকে ধীরে ধীরে বৈদ্ধিক এক মন্দিরে রূপান্তরিত হয়ে যে প্রাচীন স্থাপনাটি একটি দেশের প্রতীক হয়ে ঠাই করে নিয়েছে তার পতাকায় তার নামই এংকরভাট।
ক্যম্বোডিয়ার পতাকার বুকে এংকরভাট ।
সংস্কৃত শব্দ “এংকর” অর্থ “নগর” আর স্থানীয় খেমার ভাষায় “ভাট “ শব্দের অর্থ “মন্দির ভুমি”। এই দুটো মিলিয়ে এংকরভাটের পুর্ন অর্থ হলো – মন্দিরের নগরী ইংরেজীতে যাকে বলে সিটি অব টেম্পলস। বারো’শ শতকের প্রথমদিক ক্যম্বোডিয়ার ইতিহাসের বিখ্যাত খেমার রাজা ছিলেন ২য় সুর্য্যবর্মন যিনি তার রেখে যাওয়া অমর কীর্তির জন্য উপাধি পেয়েছিলেন পরমবিষ্ণুলোকা । তিনি রাজধানী যশোধরা পুর বর্তমান যা সিয়েমরেপ নামে পরিচিত সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে অসাধারন এক নির্মানশৈলীতে ্তৈরী করেছিলেন এই অসাধারন স্থাপত্যকর্মটি। যা বর্তমান বিশ্বের এক অন্যতম বিস্ময়।
শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে এংকরের ছায়া
নবম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত মেকং নদীর তীরে বর্তমান ক্যম্বোডিয়া থাইল্যন্ড আর ভিয়েতনামের বিশাল এলাকা জুড়ে উন্মেষ এবং বিকশিত হয়েছিল এক অনন্য সভ্যতার নাম তার খেমার সভ্যতা ।এই সভ্যতারই একটি পরিপুর্ন রূপ হলো সিয়াম রেপের মন্দিরগুলো বিশেষ করে এংকরভাট
এংকরভাটে প্রবেশের প্রধান পথ যার দুপাশের রেলিং হলো হিন্দু পুরানের নাগ রাজ বাসুকী যার সাহায্যে দেবতা আর অসুর অমর হওয়ার জন্য সমুদ্র মন্থন করে অমৃতের ভান্ড তুলে এনেছিল ।
বহুদিন ধরে গাছ আর জঙ্গলে ঢাকা পরে থাকা এংকর ভাট মুলত ছিল পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয় যা দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে নির্মিত হয়েছিল।
দীর্ঘ পথের পাশে শুধু কালই নয় মানুষের আঘাতেও জীর্ন হয়ে পড়া রেলিং অর্থাৎ বাসুকীর গা ছুয়ে এগিয়ে চলেছি , যদিও তা ধরা ছিল নিষেধ ।
শত শত বছর ধরে পরিত্যক্ত এই প্রকান্ড সেই সাথে বিস্ময়কর নির্মান শৈলীতে তৈরী এংকরভাট মন্দিরটি প্রথম নজরে আসে এক চৈনিক পর্যটকের। যা তাকে প্রচন্ড বিস্মিত করেছিল। এই চৈনিক পর্যটক ছাড়াও অনেকের দৃঢ বিশ্বাস এই বিশাল দক্ষ যজ্ঞ কোন মানুষের সৃষ্টি হতে পারে না। এটা অবশ্যই ইশ্বরের তৈরী এবং সেই ঐশ্বরিক স্থপতি একদিনেই এই নগরীটি তৈরী করেছেন ।
এংকরভাট
আবার কারো মতে দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে তার পুত্র প্রেতা কেচ এর জন্য মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল । কোন কোন ইউরোপীয় পর্যটক ধরে নিয়েছিলেন এটা রোমানদের কীর্তি , আবার কারো মতে এর নির্মাতা মহামতি সম্রাট আলেকজান্ডার।
এখনো পথ ফুরোয় নি
কল্পনার ডানা যতই ঝাপটাক, ইতিহাস এংকরভাটকে নিয়ে কি বলে তাই শুনি– যথেষ্ট তথ্য সুত্র না থাকলেও যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে জানা যায় ১২ শ শতকের প্রথমার্ধে ঐ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন খেমার রাজা দ্বিতীয় সুর্যবর্মন যা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। তিনি তাঁর রাজত্বকালে রাজধানী, রাস্ট্রীয় মন্দির এমনকি কারো কারো মতে তাঁর সমাধি সৌধ হিসেবে এংকরভাটের প্রাথমিক নকশা ও নির্মান শুরু করেন ।
পথের বা দিকে এমন স্থাপনা , শুনেছি এ নাকি পাঠাগার
হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা শিব এর ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে রাজা ২য় সুর্যবর্মন এই মন্দির উৎসর্গ করেছিলেন দেবরাজ বিষ্ণুর নামে । কোন ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ বা নথিপত্রতে এর আসল নাম জানা না গেলেও সম্ভবত “বড় বিষ্ণু-লোক” নামেই একে ডাকা হতো ।তবে এংকর ভাট নামটি পশ্চিমাদের দেয়া বলে জানা যায়।
প্রচন্ড সেই খর তাপে সব কিছু পুড়ে যাচ্ছে তারপর ও কিছুটা এগিয়ে এসেছি মনে হচ্ছে ।
১৭ শতকে পাওয়া চৌদ্দটি শিলালিপি থেকে জানা যায় , খেমারদের পাশাপাশি জাপানী বৌদ্ধরাও এখানে বসতি গেড়েছিল ।সে সময় জাপানী পর্যটকরা ভাবতেন এটি বুদ্ধের বাগান “জেতাইয়ানা”। আসলে যেটা ছিল ভারতের মগধ রাজ্যে অবস্থিত । এই বৌদ্ধদের প্রভাবেই ১২ শ শতকের শেষ প্রান্তে হিন্দু উপাসনালয় থেকে এংকরভাট ধীরে ধীরে এক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পরিনত হয়।
বা দিকে গ্যালারীর কিছু অংশ
১১৪৫/৫০ সনের কোন এক সময় রাজা দ্বিতীয় সুর্যবর্মনের মৃত্যুর পর পরই এর নির্মান কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা বোঝা যায় দেয়ালের গায়ে খোদাই করা অসম্পুর্ন চিত্রকলা দেখে। এর ২৭ বছর পর খেমারদের চিরশত্রু বর্তমান ভিয়েতনামের “চাম” জাতির হাতে এই অসাধারন স্থাপত্যশৈলিতে নির্মিত এংকর ভাট নামের মন্দির নগরীটি তছনছ হয়ে যায়। পরবর্তী রাজা সপ্তম জয়বর্মন ১১৮১ সনে ক্ষমতায় এসে এর কিছুটা সংস্কার করলেও তাঁর রাজধানী ও প্রধান মন্দির গড়ে তোলেন এখান থেকে সামান্য দূরে ।
এরপর এক ধাপ ওঠা
এংকরভাটকে ঘিরে গড়ে ওঠা কম্বোডিয়ার উত্তর প্রদেশ সিয়ামরেপ এর পুরো এলাকাটি এখন দক্ষিন এশিয়ার এক প্রত্নতাত্বিক বিস্ময়। বিস্ময় এর নির্মান কৌশলেও । লক্ষ লক্ষ টন স্যান্ড স্টোনে তৈরী এই মন্দির নির্মানে কোন সিমেন্ট সুরকি ব্যবহৃত হয়নি , জোড়া লাগানোর কাজটি সম্পন্ন হয়েছে এক ধরনের গাছের মন্ড দিয়ে যা বাইরে থেকে আপনি বুঝতে পারবেন না। ভারতীয় স্থাপত্যকলা থেকে উদ্ভুত হলেও দিনে দিনে খেমার স্থাপত্য নিজস্ব একটি স্বকীয়তায় পৌছে গেছে । পৌছে গেছে এক উচ্চতায় যা আপনার দৃষ্টিতে এক অনন্য শিল্পের দিগন্ত খুলে দেবে ।
এগিয়ে চলা এংকরভাটের ভেতরের পানে
অনেকে মনে করেন এংকরভাটের যে ৫টি মুল স্তম্ভ রয়েছে তা নির্মান করা হয়েছিল হিন্দু পুরানের দেবতাদের আবাসস্থল ৫টি মেরু শৃঙ্গকে কল্পনা করে । মহাবিশ্বের ধারনার সাথে কল্পনা করে তৈরী এই মেরু পর্বত অর্থাৎ মুল পাঁচটি মন্দিরের চারিদিক ঘিরে থাকা ২.২ মাইল লম্বা দেয়ালগুলোকে কল্পনা করা হয়েছে পর্বতরাশির সাথে। আর দেয়ালের বাইরে চারিদিকে নীল জলরাশিতে পরিপুর্ন যে সুগভীর পরিখা তাকে কল্পনা করা হয়েছে বিশ্বের শেষ সীমানা সমুদ্র রূপে।
মুল উপাসনালয়ে প্রবেশ
সেই পাঁচটি সুউচ্চ মেরু স্তম্ভকে ঘিরে তিন তিনটি আয়তকার গ্যালারী গড়ে তোলা হয়েছে। যাতে রয়েছে ভারতীয় পৌরানিক গ্রন্থ মহাভারত, রামায়ন, গীতা ও বেদের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কাহিনী । এর মাঝে রাম রাবনের মাঝে যুদ্ধ । মহাভারতের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সাথে পান্ডব আর কৌরবদের যুদ্ধ । আর পৌরানিক কাহিনী সমুদ্র মন্থন নিয়ে সৃষ্ট ভাস্কর্য্য যা আপনি এংকরভাটের গ্যালারীর দেয়ালের বাস রিলিফেই শুধু নয়, মন্দিরের প্রবেশ দ্বার থেকে এংকর নগরীর সর্বত্র এমনকি ক্যম্বোডিয়ার পুরনো নতুন প্রায় স্থাপনাতেও লক্ষ্য করবেন ।
গ্যালারীর দেয়ালে সারি সারি আঁকা এমন চিত্রাবলী
আর রয়েছে এংকরভাটের দেয়ালে দেয়ালে স্বর্গের শ্রেষ্ঠ নর্তকী অপ্সরার দুই হাজারেরও বেশি ভাস্কর্য্য । সেই মোহনীয় হাসিতে শুধু তখনকার দেবতারাই মোহাবিষ্ট হন নি , এখনো যে কোন পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তুলতে সেই পাথরের নর্তকীর হাসি যথেষ্ট।
স্বর্গের বিখ্যাত নর্তকী অপ্সরার ভুবন ভোলানো হাসি
প্রায় ৫০০ একর অর্থাৎ ২০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে মন্দির ,বেসিন , জলাধা্র, নহর সহ যোগাযোগের পথ নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা । বহু শতাব্দী জুড়ে এটাই ছিল খেমার রাজত্বের প্রান কেন্দ্র । সম্ভ্রম জাগানীয়া স্মৃতিস্তম্ভ , অসংখ্য প্রাচীন শহুরে স্থাপনা আর বিশালাকৃতির জলাশয় নিয়ে পড়ে থাকা এই স্থানটি ব্যতিক্রমী এক সভ্যতার চিহ্ণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন ।
এমনই জলবেষ্টিত এংকরভাটের এই ছবিটি নেট থেকে নেয়া ।
উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক ফরাসী প্রকৃতিবিদ ও পর্যটক হেনরী মহুত তার লেখার মাধম্যে এই অনন্যসাধারন স্থাপত্যটি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। তার আগে যদিও অনেকের চোখে পড়েছিল কিন্ত প্রচার পায়নি। এরপর থেকে লাখো পর্যটকের পদশব্দে শত শত বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা এংকরভাট জেগে উঠে প্রতিদিন। এখান থেকে সুর্যোদয় আর সুর্যাস্ত দেখার জন্য মায়ানমারের বাগানের মতই সকাল সন্ধ্যা পর্যটকরা ভিড় করে আসে।
প্রবেশ পথ
পরদিন সকাল নটায় হোটেল থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত টুক টুক এসে হাজির । চালক মিঃ টোম আমাদের সাথী এবং গাইড হয়ে চললো শহরের প্রান কেন্দ্র থেকে ৬ কিমি উত্তরে সেই বিখ্যাত এংকরভাটের উদ্দেশ্যে । এংকর নগরীটিকে বর্তমানে ইনার সার্কেল আর আউটার সার্কেল দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে । এই ইনার সার্কেলেই রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম এই আশ্চর্য্য এংকরভাট মন্দির ।
এংকরের সবগুলো স্থাপত্যেই আপনি লক্ষ্য করবেন এমন নান্দনিক শৈলীতে নির্মিত পিলার
কিছু দুর যেতেই শহরের মাঝেই বিশাল আঙ্গিনা সহ টিকিট কাউন্টার, যেখানে সাতটি কাউন্টার থেকে অত্যন্ত সুশৃংখল এবং নিয়মানুযায়ী দু ধরনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে । এক থেকে ছয় নম্বর কাউন্টারে বিক্রী হচ্ছে তিনদিনের টিকিট যার দাম মাথাপিছু চল্লিশ ডলার। এই টিকিটে আপনি মোট তিনদিন এংকরভাট সহ এর আশে পাশে যতগুলো পর্যটন কেন্দ্র আছে সবখানে যেতে পারবেন। সাত নম্বর কাউন্টার থেকে সাতদিনের টিকিট ৮০ ডলার মনে হলো।
এখান থেকেই আপনাকে কেটে নিতে হবে এংকরের প্রবেশ পত্র
তবে ২০ /২৫ কিমি দূরে যেসব মন্দির বা স্থাপত্য রয়েছে তার জন্য সেখানে আলাদা টিকিট কাটতে হবে । ওহ আর মুহুর্তেই কাউন্টারের ক্যমেরায় তোলা ছবি টিকিটের মাঝেই ছাপা হয়ে যাবে। যেতে যেতে পথের মাঝেই গাড়ী থামিয়ে টিকিট চেক করে পাঞ্চ করে দিচ্ছে দিন তারিখ সহ । লিখে লিখে বিশাল এংকরভাটের এর বর্ননা দেয়া সত্যি অনেক কঠিন। তাই ছবিতে তাকে তুলে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস করছি ।
তিন দিনের জন্য নির্ধারিত টিকিট।
নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রনের সুবিধার জন্য এক সময়ের চারটি প্রবেশ দ্বারের তিনটিই এখন বন্ধ । সেই সকাল বেলাতেই সুর্য্যি মামা যেন চটে উঠেছে , চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার আগুনে নিশ্বাস। এরই মাঝে মাঝে হাজার হাজার পর্যটক ভর্তি বাস , আর টুকটুকে রাস্তা আর পার্কিং এলাকা সরগরম। আমরা গুটি গুটি পায়ে দুজন যাত্রা শুরু করলাম নব সংযোযিত এক বিস্ময় এংকরভাট এর মুল প্রবেশ পথের দিকে , মোহমুগ্ধ আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি আর চারিদিকে তাকিয়ে ভাবছি এত শত বছর আগেও মানুষ কেমন করে এমন নান্দনিক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল ! আর তা দেখতে আমার সাথে থাকুন...................
ভারতীয় কিলক নকশায় তৈরী খিলানাকৃতি দরজা দিয়ে অবশেষে ভেতরে
এমন গলি গলি পথের বাহু চারিদিক দিয়ে যেন মূল মন্দিরকে ঘিরে রেখেছে
পুরনো উচু উচু পাথরের সিড়ির উপর কাঠের সিড়ি বানিয়ে দেয়া হয়েছে দর্শকদের সুবিধার জন্য । আপনাকে কিছু দেখার জন্য এমন সিড়ি বেয়ে ওঠা নামা করতেই হবে ।
বেশ কিছু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই বিস্ময়ের দ্বীতিয় ধাপের প্রধান কেন্দ্রে আসলাম ।
নীচের স্তরে মন্দিরের ঠিক মাঝখানে ছোট একটি কৃত্রিম জলাশয়
এমন কারুকাজ করা একটি তোরণ পেরিয়ে ভেতরের প্রাঙ্গনে আসলাম
বাদিকে ছোট কারুকাজ করা ঘর রয়েছে ।
এরপর রয়েছে সেই কল্পনার মেরু পর্বত শৃংগ
অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে একদম উপরে উঠতে হবে, তার প্রস্ততি
মাটি থেকে ২১৩ ফুট এই সর্বোচ্চ মন্দিরের চুড়া
এমন খাড়া সিড়ি বেয়ে বেয়ে একসময় উঠতো পুজারী আর ভক্তরা
উপরে ওঠার জন্য অপেক্ষায় সারিবদ্ধ আমরা ।
নিরাপত্তার জন্য এখন কাঠ আর রেলিং দিয়ে বানানো সিড়ি
এখানে বোঝা যাচ্ছে না তবে সেই ছোট ছোট আর অনেক ধাপের খাড়া সিড়ি দেখে অনেক সাহসীরও মুখ শুকিয়ে এসেছিল , তার মাঝে আমি অন্যতম ।
সর্বোচ্চ চুড়ায় পাথরের অপ্সরা
উপরের আঙ্গিনার দৃশ্য
সর্বোচ্চ চুড়ার মুল মন্দিরের বুদ্ধের মুর্তি
সব থেকে উপরে দাঁড়িয়ে নীচে সবুজ বনানীর মাঝে প্রাচীন এংকরের ভগ্নাবশেষ
এটাও উপর থেকে তোলা
উপর থেকে নীচের আঙ্গিনা
উপরের প্রাঙ্গনে নীচের মতই ছোট্ট এক কৃত্রিম জলাশয় যা এখন পানিশুন্য
আস্তে আস্তে আবার নেমে আসা । বেশ ভয় লাগছিল ওঠার সময় । অনেকে কিছুটা উঠেই চিৎকার করে নেমে গিয়েছিল । তবে নামাটা আরো কঠিন । আমি ভয়ে পেছন ফিরে নেমে আসলাম সেই ২য় আঙ্গিনায়।
দ্বিতীয় ধাপে নেমে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস
দ্বিতীয় ধাপের উপর থেকে চারিদিক ঘেরা গ্যালারীর দৃশ্য ।
নীচ থেকে গ্যালারী
লম্বা সেই গ্যালারী আর তাতে রয়েছে খোদাই করা ভাস্কর্য্য
প্রতিটি গ্যালারীর পাথরের দেয়ালে খোদাই করা হিন্দু পৌরানিক সব উপাখ্যান
সাত মাথা ওয়ালা নাগ রাজ বাসুকী যেন হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালো শত শত বছরের পুরনো অসাধারন এক কীর্তি প্রত্যক্ষ করার পর
বৃহত্তম এই উপাসনালয়টি আবারো দৃষ্টিনন্দন করার জন্য ক্যম্বোডিয়া সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্বিক বিভাগ দিবারাত্র পরিশ্রম করে চলেছে । পলপটের সময় তৎকালীন সংস্কার কর্মীদের গুলি করে মেরেছিল খেমার রুজ বাহিনী, তবুও থেমে থাকেনি তাদের কাজ । তাইতো আজও মানুষ এংকরভাট দেখার জন্য ছুটে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে । যেমন আমরাও গিয়েছিলাম অনেক দিনের মন বাসনা পুরণের লক্ষ্যে ।
পরের গন্তব্যে সাথে থাকবেন সেই প্রত্যাশায় ।
১নং ছবি ও জলবেষ্টিত এংকরভাটের ছবিটি নেট থেকে নেয়া । বাকী সব আমাদের ক্যমেরায় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:৩৮