একদিন সন্ধ্যায় আমাদের লাইন করিয়ে জানালো যে আগামীকাল সকাল ৯টায় সবাই যার যার পুটুলী নিয়ে এখানে দাড়াবে।পরদিন আমরা নটায় লাইনে দাড়ালাম তার খানিক পরেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কিছু সদস্য ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে গেল আগরতলা এয়ারপোর্টে।বেশ অনেক্ষন অপেক্ষার পর এক বিশাল মালবাহী প্লেন খুব সম্ভবত c130 ল্যান্ড করলো।মালপত্র নামিয়ে আমাদের এক তৃতীয়াংশ ছেলেকে নিয়ে প্লেন চলে গেল । আমরা পরে রইলাম, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
আবার বিএস এফ ক্যাম্পে ফিরে আসলাম। পরে জানতে পেরেছি এভাবেই পর্যায় ক্রমে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হবে। দ্বিতীয়দিন ও বাদ পরলাম। বাকী এবার চলে গেল, আমি একা হয়ে পড়লাম। অবশ্য এর মাঝে আমার কয়েকজনের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছিল।তার মধ্যে বর্তমানে জনকন্ঠের চেয়ারম্যান মাসুদ, মাসুদের চাচাতো ভাই জিল্লু পুরনো ঢাকার দুজনঃ আসলাম, রশিদ সহ আরো অনেকে যাদের নাম আমার এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না।
এক সপ্তাহ অপেক্ষার পর আমাদের পালা আসলো।এবার আমরা সবাই প্লেনে জায়গা পেলাম। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্লেন ভ্রমন বলবোনা বলা যায় প্লেনে চড়া। কার্গো প্লেন সুতরাং আসনের বালাই নেই। মাটিতে বসে মালপত্র বাঁধার দড়ি দিয়ে নিজেদের বেধে নিলাম। ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুজন পাইলট দু ঘন্টা ফ্লাই করার পর কলকাতা থেকে পঞ্চাশ/ষাট কিঃমিঃ দূরে ব্যারাকপুর এয়ার বেসে অবতরণ করলো।প্লেন থেকে নেমে আমরা সবাই দুজন ভারতীয় সৈন্যের সাথে ট্রাকে করে রওনা দিলাম।
ঘন্টা তিনেক চলার পর আমাদের যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা ছিল ফ্রগম্যান ক্যাম্প।সেই ক্যাম্পে তখন অনেক বাংলাদেশী ভাইরা ট্রেনিং নিচ্ছিল।তারা আমাদের দেখে দৌড়ে আসলো স্বাগত জানাতে। কিছুক্ষন পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা এসে জানালো আমরা ভুল জায়গায় এসেছি।
সেদিনের সেই ভুল জায়গাটি ছিল বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিখ্যাত সেই আম্রকানন ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন যেখানে ডুবেছিল বাংলার স্বাধীনতা। এই আম্রকাননের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিষাক্ত সাপে পরিপুর্ন প্রচন্ড খরস্রোতা ভাগিরথী নদ। সেই ভয়ংকর নদীতেই আমাদের বাংলাদেশি ফ্রগম্যানদের প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে।পরবর্তীতে এই সব অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ফ্রগম্যানরাই নারায়নগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তানি সামরিক জাহাজ মাইন দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
সেখান থেকে আবার যাত্রা হলো শুরু ।সারাদিন না খাওয়া ক্ষুধার্ত আমরা দেশ স্বাধীনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে চলেছিতো চলেছিই, সে যেন বিরামহীন এক যাত্রা।
শেষপর্যন্ত সন্ধ্যা নাগাদ এসে পৌছালাম আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে।যায়গাটির নাম ‘চাকুলিয়া’ বিহার। আগে থেকেই যারা এখানে অবস্থান করছিল আমাদের দেখে তারা ছুটে আসলো, তাদের মধ্যে আমার বন্ধু বাকীও ছিল। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো বন্ধুকে পেয়ে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো।
সেদিন থেকে আমরা পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে পরলাম। রাতে খাবার পর ফল ইন করানো হলো, গননা করা হলো, নাম ধাম পরিচয় জেনে পরের দিনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। তারপর আগে থেকে নির্ধারিত তাবুতে শুয়ে গভীর ঘুম।
আগের দিনের নির্দেশমত সুর্য্য ওঠার আগেই উঠে হাতমুখ ধুয়ে ছুটলাম লাইনে।সেখানে ভারতীয় প্রশিক্ষক ছোটখাটো এক বক্তৃতা দেয়ার পর শুরু হলো প্রশিক্ষন অর্থাৎ নানারকম শারিরীক কসরৎ।ঘন্টা দুয়েক এক্সারসাইজ চলার পর এক মগ চা আর পুরি সহযোগে শুরু হলো ২০ মিনিট এর চা পানের বিরতি।
চা পানের বিরতির পর আবার এক্সারসাইজ শুরু হলো চললো প্রায় তিন ঘন্টা।এরপর স্নান, মধ্যানহ ভোজ এবং বিশ্রামের জন্য তিন ঘন্টা বিরতি দেয়া হয়েছিল।এরপর আবার ফল ইন, তবে এবার আর কসরৎ নয়, শুরু হলো অস্ত্র পরিচিতি। প্রথম দিন সে সময়ের বিখ্যাত থ্রি নট থ্রি বন্দুক দিয়ে শুরু হলো পরিচিতি পর্ব। মান্ধাতা আমলের সেই অস্ত্র, ওজন সাড়ে ৯ কেজি। সেটাকে ম্যানেজ করা আমার মতন হ্যাংলা পাতলা এক ১৮ বছরের ছেলের জন্য ভীষন কষ্টসাধ্য ছিল।
যাই হোক দুজন প্রশিক্ষক আমাদের হাতেকলমে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেরা করে দেখালো সেই অস্ত্রের ব্যাবহার।কি ভাবে কি করতে হয়? কি ভাবে বিভিন্ন অংশ খুলে খুলে পরিস্কার করতে হয় ইত্যাদি। এরপর আমাদের দিয়েও করালো।তবে কোন গুলি ব্যাবহার করা হয়নি।
অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে সেই প্রশিক্ষক দুজন সারাটি ক্ষন আমাদের মতন নবীন শিক্ষানবীশদের সেই অস্ত্র সম্পর্কে বুঝাতে লাগলো।
এরপর রাতের খাবার এর জন্য আবার লাইনে দাড়াতে হলো। সন্ধ্যা হতেই সব কাজ শেষ করে জায়গাটি একটু ঘুরে ফিরে দেখা শুরু করলাম। আগেই বলেছি বিহার জেলায় অবস্থিত এই চাকুলিয়া ছিল একটি এয়ার বেস যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী বিমান বাহিনীর হাতে সম্পুর্ন বিদ্ধস্ত হয়ে যায়।সেই থেকে সেটা পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পরেছিল যার ফলে পরিনত হয়েছিল বিভিন্ন বিষাক্ত সাপের বাসস্থানে।
আমাদের আগে যারা এসেছিল তাদের দিয়ে সেস্থানের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করানো হয়েছিল। যেমনঃ পনের বিশটা তাবু খাটানো, তাবুর চারিদিকে ড্রেনের মত ট্রেঞ্চ খোড়া হয়েছে যেন সাপ না আস্তে পারে।ঔষধ ছিটানো হয়েছিল তাদের দিয়ে। এভাবেই তাদের দিয়ে পুরো এলাকাটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল।ফলে এসব কাজ আর আমাদের করতে হয়নি।
প্রথম প্রথম যা ভেবেছিলাম তা নয়, দিনে দিনে শক্ত ট্রেনিং শুরু হতে লাগলো, এর মাঝে কমান্ডো ট্রেনিং ও কিছুটা শেখালো।এমনি ভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ ট্রেনিং করার পর শুরু হলো real arms training। যার মধ্যে ছিল থ্রি নট থ্রি, এসএম সি, এস এল আর, এল এমজি,হাত গ্রেনেড, এন্টি পার্সোনাল মাইন, এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন, এক্সপ্লোসিভ এন্ড ডিটোনেটার+ম্যাচিং ওয়্যার ফিক্সিং । এসব গুলোর উপর অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু শেখানো যায় তার সব কিছুই আমাদের শিখিয়েছিল।এর সাথে প্রতিদিন আমাদের দুপুরের পর প্রত্যেকটা অস্ত্র পার্ট বাই পার্ট কি ভাবে খুলতে হয় লাগাতে হয় এবং সাথে সাথে পরিস্কার করতে হয় সেটারও বিশেষ প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছিল।
এরপর শুরু হলো অস্ত্র চালনা শিক্ষা।প্রথমে অস্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো এরপর শুরু হলো গোলাবারুদের সাথে পরিচয় , অস্ত্রের ব্যবহার পদ্ধতি, অস্ত্র পরিস্কার করার কৌশল, বলাবাহুল্য এটা একজন যোদ্ধার জন্য অতীব গুরুত্বপুর্ন। সবশেষে আসলো গুলি ভরে কি ভাবে গুলি ছুড়তে হয় তার প্রশিক্ষন? ডেটোনেটর লাগিয়ে কিভাবে হ্যান্ড গ্রেনেড ধরতে হয় ? কি ভাবে পিন খুলতে হয় ? তখন হাতটা কেমনভাবে ভাজ করে ছুঁড়ে মারতে হয় এসব কিছু।
বিস্ফোরকের বেলায়ও একই ব্যবস্থা। একবারে কি পরিমান বিস্ফোরক নিতে হবে? কি ভাবে সেটাকে আকৃতি দিতে হবে ?কি ভাবে ডেটোনেটার ইনজেক্ট করতে হবে এবং তারপর ফায়ার ক্লিক করতে হবে। এর উপর চললো প্রায় তিনদিন লাগাতার প্রশিক্ষন।শেষ পর্যায়ে এসে প্রত্যেককে বিকেলেও ক্লাস করতে হয়েছে। এভাবে প্রায় সাত সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রমের পর আমাদের প্রশিক্ষন পর্ব০ শেষ হলো।
ছবি: অন্তর্জাল
চলবে...
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেক্টর ২ রনাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারী এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বহস্তে লেখা দিনলিপি।৩য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৮