করচ বনের সারি
ব্লগে আসার পর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের উপর প্রাঞ্জল বর্ননা এবং ছবি সহ অনেকের লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। টাঙ্গুয়ার সেই অপরূপ রূপ দেখার জন্য বার বার প্রলুদ্ধ হয়েছি। কিন্ত পানি ভীতি থাকায় সাহস করতে পারি নি। এবার সুনামগঞ্জ যাবার সময় সেই বিশাল সাগর টাঙ্গুয়া শীতে কি রূপ ধরে তা জানার জন্য বিভিন্ন জনের কাছে তথ্য জানতে চাই। তাদের সাহস আর অনুপ্রেরণায় এবার সত্যি আমার অনেকদিনের স্বপ্ন সত্যি হলো।
বিশ্ম্ভরপুর উপজেলার এক জলাভুমিতে ভোরে ফুটে থাকা শাপলা
আমাদের দেশের উত্তর পুর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর আর ধর্মপাশা উপজেলায় ২৪০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত সাগর সদৃশ্য মিঠা পানির জলাশয় টাঙ্গুয়ার হাওড় জীব বৈচিত্রের এক অনন্য উদাহরণ।যেই সাগর কিনা শীতকালে ৫০/৬০টি আলাদা আলাদা বা সংযুক্ত বিলে পরিনত হয়।
পাইটাল নদী
অন্য হাওড়গুলো শীত মৌসুমে শুকিয়ে আসলেও টাঙ্গুয়ার হাওড়ের কিনারা জেগে ওঠা বিল আর কান্দাগুলো সবসময় থাকে পানিতে ভরপুর । তার কারণ হলো আমাদের দেশের কয়েকটি বিখ্যাত নদী যেমনঃ সুন্দরী সোমেশ্বরী, মোহনীয় সুরমা, পাহাড় থেকে পাথর নিয়ে নেমে আসা যাদুর নদী যাদুকাটা, কংশ, পাটলাই এই হাওড়ের সাথে সংযুক্ত।
হাওড়ের পথে
এছাড়া সীমান্তের অপর পাড়েই রয়েছে মেঘালয়ে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের শহর চেরাপুঞ্জী। সুতরাং পাহাড়ের রাজ্য মেঘের আলয়ের ঝর্নাগুলো বিশেষ করে বর্ষাকালে এসে আমাদের হাওড়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ছে তাদের বিপুল জলরাশি নিয়ে। আর এই জলরাশিই প্লাবিত করে সাগরে পরিনত টাঙ্গুয়ার হাওরকে ।
নিথর পানিতে করচের ছায়া
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অনন্য উদাহরন এই টাঙ্গুয়ার হাওড় দেশীয় মাছের অন্যতম প্রধান আধার ও প্রজনন ক্ষেত্র এবং দেশীয় পাখী ছাড়াও ৬০/৭০ প্রজাতির লক্ষাধিক পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম। দীর্ঘদিন হাওরের মিষ্টি পানিতে ডুবে থাকতে পারে এমন কিছু বিরল প্রজাতির গাছ, জলজ বন এবং নানান উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত এই হাওড় জীব বৈচিত্রের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে পার হয়ে যাচ্ছে গরুটি।
প্রধানত এই তিনটি বৈশিষ্টের কারনে ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওড় আন্তর্জাতিকভাবে ২য় রামসার এলাকার মর্যাদা লাভ করে।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ে মোট ২১৯ প্রজাতীর পাখি দেখা যায়। এর মাঝে দেশি প্রজাতি ১২১ এবং পরিযায়ী ৯৮টি।
মোট স্তন্যপায়ী প্রানী রয়েছে ১৯টি, বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রানী মেছো বিড়াল। সরীসৃপ ২৯টি এবং উভচর প্রানী ১১টি প্রজাতির।
মাছের প্রজাতি ১৪১ টি। এর মাঝে বিলুপ্ত শ্রেনীর মাছ হলোঃ চিতল, মহাশোল, বাঘাআইড় রিঠা সহ আরো কিছু। বিপন্ন মাছের তালিকায় রয়েছে পাঙ্গাস, পাবদা,শরপুটি,কালবাউশ, মেনি প্রভৃতি।
জলজ,নিমজ্জিত,বন ইত্যাদি সব মিলিয়ে উদ্ভিদের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২০০টি।
অনেক জায়গায় দেখা যায় পানির নীচের এই গাছের সমাহার
এই হাওড়ের চার পাশে বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র এবং সংস্কৃতির প্রায় ৫৬হাজার মানুষ বসবাস করে।
২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার টাঙ্গুয়ার হাওড় লিজ দেয়ার প্রথা বাতিল করে। এছাড়াও সাময়িকভাবে বন্ধ করেছে বড় বড় মাছ ধরা। তবে গরীব জেলেরা যেন দুমুঠো খেতে পারে তার জন্য বিলের কিনারে চাঁই, ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ রেখেছে।
করচের ঘন বন
টাঙ্গুয়ার হাওড় সম্পর্কে অভিজ্ঞ একজন জানালো শীতকালই নাকি হাওড় ভ্রমনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।জীব বৈচিত্রের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওড়ের যে বিশ্বখ্যাতি তা সম্পুর্ন পরিস্ফুটিত হয়ে শীতের সময়ই। যেমন বিভিন্ন প্রজাতির দেশী আর পরিযায়ী পাখি সহ প্রচুর দেশী মাছ এবং নানারকম উদ্ভিদের দেখা মেলে সেই শীতের সময়েই। তার সেই কথা শুনে সাহসী আমি এই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রওনা হোলাম হাওড়ের পথে।
হাওড়ে ঢোকার আগেই বিশাল বিলবোর্ড । এই সংস্থাটি হাওড়ের জীব বৈচিত্র রক্ষার উপর কাজ করছে
সে সময় 'ছয় কুড়ি বিল আর তের কুড়ি কান্দা' নিয়ে সৃষ্ট টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ভেসে ওঠা বিলের সবুজ কিনারায় সারা বর্ষায় বুক পানিতে ডুবে থাকা হিজল, করচ গাছের পুরোপুরি জেগে উঠা সারি এক মোহনীয় সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করে, সবুজ ঝোপালো পাতা আর ডালের ফাঁকে কিঁচির মিঁচির করে থেকে থেকে ডেকে উঠছে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখি। জলের উপর পাঁক দিয়ে যাচ্ছে গাংচিল।
গাছের আগায় পানকৌড়ির ঝাক
বিলের কান্দাগুলো তখন ঢেকে যায় নলখাগড়া,শতমূলী, চাইল্লাঘাস বনতুলশী, গুলী,আর বইল্যলার ছোট ছোট উদ্ভিদে। সেই সাথে বিলগুলো পরিনত হয় দেশীয় আর পরিযায়ী পাখীর অবাধ বিচরণ ভুমিতে। অক্টোবর থেকেই শুরু হয় পরিযায়ী পাখীদের আনাগোনা।মাইলের পর মাইল জায়গা জুড়ে এসব পাখীদের ভেসে বেড়াতে দেখেছি আমরা।
চুপি চুপি কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্ত ঠিকই টের পেয়ে গেল দুষ্ট পাখীর দল আর সাথে সাথেই ফুরুৎ
তবে যারা সেই বিশাল সাগর সদৃশ্য টাঙ্গুয়ার হাওড় আর তার মাঝে ভেসে থাকা দ্বীপগুলোর বসত ভিটায় আছড়ে পড়া প্রচন্ড ঢেউ এর রাশি, জল ভরা মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ বা ঝুম বৃষ্টি, পানির উপর কোনরকমে মাথা জাগিয়ে রাখা হিজল করচের বন দেখতে ইচ্ছুক তাদেরকে বর্ষায় যাবার জন্যই অনুরোধ করবো।
আহা সেই হিজল আর করচের বন সেখানে নিত্য হোক আমার আগমন
৭ ই ডিসেম্বর ২০১৪ আমরা দুজন টোনাটুনী শীত এর সকাল সাতটায় রেষ্ট হাউজ থেকে রওনা হোলাম সুরমা নদীর তীরে বৈঠাখালি ঘাটের উদ্দ্যেশে। নদীর অপর পার থেকে উপজেলা তাহিরপুর এর সোলেমান নগর পর্যন্ত সি এন জিতে যেতে হবে । এরপর ট্রলার। নদীর অপর পারে যেতে ফেরীর জন্য অপেক্ষা করছি দেখলাম এক দেশীয় নৌকার ফেরী এগিয়ে আসছে আর তাতে এক সিএন জি। এপারে এসে আমাদের দেখেই একজন জানালো সেই আমাদের নির্ধারিত সি এন জি ড্রাইভার। আমরা যেন দুই মিনিট অপেক্ষা করি সে গ্যাস নিয়ে এক্ষুনি আসবে।
আমাদের সিএন জি আসছে এপার থেকে গ্যাস নিতে
ঐদিকে ট্রলার আলা ফোনে তাড়া দিচ্ছে আমরা যেন তাড়াতাড়ি যাই। পানি গরম হয়ে উঠলে পাখি সব চলে যাবে জঙ্গলে।সত্যি ঠিক ২ মিনিটের মধ্যেই সে আসলো। ঐ পারে উঠতে গিয়ে সি এনজি কাত হয়ে পানিতে পরার উপক্রম। ড্রাইভার আমাকে এর আগে বার বার তার গাড়িতে উঠে বসে থাকার জন্য অনুরোধ করছিল। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন যে তার কথা শুনিনি।
নদীতে পতন্মোমুখো আমাদের বাহন
তেমন কোন গরম কাপড় না নেয়ায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলা সেই খোলা সি এন জিতে জমে যাবার উপক্রম। এভাবে ১৭ কিমি দুরত্বের বিশ্ম্ভরপুর উপজেলা পার হয়ে আসলাম সুনামগঞ্জ থেকে মোট চল্লিশ কিমি দুরত্বের তাহিরপুর উপজেলার এক গ্রাম সোলেমানপুরে। পৌছাতে আমাদের প্রায় দেড় ঘন্টার মত সময় লাগলো।কিছু জায়গা ছাড়া রাস্তা মোটামুটি ভালোই ছিল।
আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকা
আগে থেকে ঠিক করে রাখা ইঞ্জিন আলা নৌকা মাঝিটি যাকে বার বার ট্রলার বলে উল্লেখ করছিল তাতে গিয়ে বসলাম। তার আগে অবশ্য পাশেই বাঁধা শিক্ষাতরীতে উঠে শিক্ষিকা আর ছাত্র ছাত্রীদের সাথে কিছু আলাপ হলো।
আস্তে আস্তে শুরু হলো আমার অনেক দিনের স্বপ্ন টাঙ্গুয়ার হাওড় ভ্রমন। হাওরের জনগন নিয়ে কাজ করা স্থানীয় এক অভিজ্ঞ ব্যাক্তি ফোনে আমাকে বার বার বলছিল 'ভয় পাবেন না ভাবী, পানি একদম স্থির, শান্ত, সরের মত'।
সেই শান্ত নিথর পানিতে বহু দূর থেকে দেখছি পাখিদের ওড়াউড়ি ।
ছবির মত সব দৃশ্য দুদিকে রেখে পাইটাল নদী দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি ১১ কিমি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ৭ কিমি টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে। নদীর দুপাশে জেগে উঠা পাড়গুলো তখন বিস্তীর্ন সবুজ চারণ ভুমিতে পরিণত হয়েছে।সারা বর্ষা শুকনো খড় এর উপর থাকা অনেক গরু, মহিষ, আর ছাগলের পাল মাঠে মাঠে এখন কচি সবুজ ঘাস খেতে ব্যাস্ত। এখানকার অবস্থাপন্ন বাসিন্দাদের অনেকেই গরু ছাগল পেলে থাকে এবং এটা তাদের বিশাল এক আয়ের উৎস।
দ্বীপবাসীদের গরু চরাচ্ছিল কিছু কিছু কিশোর রাখাল বালক
নদীর ডান তীরে চেয়ে দেখি দ্বীপএর মাঝে যে ছোট ছোট বাড়ীগুলো তার ভিটাগুলো অনেক উঁচু করে তৈরী।অনেকেই ঢেউএর সেই প্রবল আঘাত ঠেকাতে পাথর দিয়ে বাধিয়ে রেখেছে তাদের বসত ভিটে। সেখানে অনেক গাছের সাথে কিছু হিজল করচ ও রয়েছে। নিঃসংগ এক পানকৌড়ি নদীতে গাঁথা বাশের আগায় বসে আছে চুপচাপ। সকাল দশটা বাজে, আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন লাগছিল। মাঝি আশ্বাস দিল এটা মেঘ নয় কুয়াশা। মনটা শান্ত হয়ে আসলো।
নিঃসংগ পানকৌড়ি
একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি নদী পথে তাতেই মুগ্ধ আমি।শীতের শান্ত স্রোতস্বীনির দু পাশে সার বেধে জন্মানো অদ্ভুত সুন্দর সেই করচ আর হিজল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। তাদের সেই ছায়াছন্ন পায়ের কাছে সবুজ কার্পেটের মত বেছানো ঘন নল খাগড়ার ঝোপ। আর তার মাঝে ছোট ছোট বনগোলাপ ফুটে আছে কি যে সেই সৌন্দর্য্য তা ভাষায় বর্ননা করার মত নয়।
হাওড় থেকে শহর অভিমুখী এক ট্রলার
মনে হচ্ছিল এখানেই নেমে অনুভব করি, ছুঁয়ে দেখি সেই সৌন্দর্য্যকে।মাঝি আমার অবস্থা দেখে জানালো সামনে আরো অনেক সুন্দর জায়গা আছে। কি জায়গা? মাঝি জানালো গোলাবাড়ী ক্যাম্প।কি আছে সেখানে? পুলিশ না আনসারদের ক্যাম্প কি জানি মাঝি বল্লো। আমি সেই সব দেখতে মোটেও আগ্রহী নই। আমার তৃষ্ণার্ত চোখ চারিদিকের সেই অসীম সৌন্দর্য্য অবলোকন করে চলেছে।
গোলাবাড়ী গ্রাম
নৌকায় ওঠার প্রায় দু ঘন্টা পর ডানদিকে দ্বীপের মতন এক ভুখন্ড দেখা গেল। মাঝি জানালো এর নামই গোলাবাড়ি। অবশ্য তার আগে আরেকটি দ্বীপসদৃশ্য গ্রাম চোখে পড়েছিল নাম স্যালাইন তাহিরপুর। সেই গোলাবাড়ী দ্বীপের একদিকে কিছু মহিলা কালো কালো মাটি দিয়ে কি যেন করতে ব্যস্ত ।আর পাশেই নদীতে কিছু লোক লগিতে নৌকা বেধে পানিতে ডুব দিয়ে দিয়ে বালতি করে সেই কালোমাটি তুলে নৌকায় ভরছে। জানলাম এগুলো দিয়ে জ্বালানী তৈরী করে।
কালো মাটি তুলছে ডুব দিয়ে দিয়ে
মাঝি জানালো আমরা যদি একদিন থাকি তাহলে ৪০ বছরের পুরনো হিজল বনের গ্রাম রংচিতে ঘুরে আসতে পারবো। এর চেয়ে পুরনো হিজলের বন এদেশে আর নেই বলে জানলাম। আর সেই বনে নাকি আছে অনেক জাতের দেশীয় পাখি আর কি জানি এক ফুল আর তা নাকি অপুর্ব দেখতে।কিন্ত আমরাতো এসেছি একদিনের জন্য।
গোলাবাড়ি -বাঘমারা ট্রেইলের একাংশ
তবে গোলাবাড়ি - বাঘমারা ট্রেইলেও রয়েছে ঘন সবুজ করচের বন। আমরা সেখানে না থেমেই এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ঢোকার মুখেই পড়লো বিখ্যাত রৌয়ার বিল। প্রচুর রুই মাছ পাওয়ায় যায় বলেই তার এই নামকরণ।
রৌয়ার বিল এর দুই পাহারাদার
মাঝি লগি চুবিয়ে দেখালো এখানে পানির গভীরতা। মনে হলো ১০/১২ ফুটের মত হবে। তবে বর্ষায় অথৈ সাগরে পরিনত হয় এই রৌয়ার বিল সহ পুরো হাওড়।এই বিলকে মাছের অভয়ারন্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। কিন্ত দুঃখের বিষয় এখানেই আমরা চোরা মাছ শিকারীদের কারেন্ট জালে আটকানো প্রচুর মাছ দেখতে পেলাম। তার মধ্যে অনেকগুলোই ছিল মৃত।
মৃত গাছের ডালে বসা পানকৌড়ি । রৌয়ার বিল
পানিতে গেথে রাখা কিছু মরা গাছের ডালে বসে থাকা পানকৌড়ি দেখতে আর ছবি তুলতে আমরা যখন ব্যাস্ত, মাঝি আস্তে করে বল্লো, 'স্যার দেখেন মাছ'। কই মাছ? কোথায়'? বল্লো ঐ যে পানিতে জালের মাঝে। আমরা তখন খানিকটা এগিয়ে গেছি। নৌকা ঘুরালো মাঝি। দেখলাম সেই মরা ডালগুলোর একটার সাথে আরেকটা বাঁধা প্রচুর কারেন্ট জাল, আর তাতে আটকে আছে অনেক জীবিত, আধমরা আর বেশ কিছু মৃত মাছ।
জাল থেকে ছুটতে না পেরে মরে ভেসে আছে এক আইঢ় মাছ
তারপর আমার স্বামীর নির্দেশে মাঝি অনেকগুলো জাল ছিরে গাছের মাথায় গোল করে রেখে দিল।কিন্ত জালের পরিমান এত ছিল যা নষ্ট করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। প্রায় আধাঘন্টার মত ঘুরে বেড়ালাম সেখানে। সেই বিলে অনেক জাতের পাখি ছিল এর মাঝে ছোট ও বড় পানকৌড়ি, গাংচিল, লাল মাথা ভুঁতি হাঁস, মরচে রঙ ভুতিহাস ছাড়াও অনেক নাম না জানা পাখি।
নদীর পারে সাদা বক আর গাংচীল
সেখান থেকে আমরা এগিয়ে চললাম হাওড়ের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন এলাকা চটাইন্নার খালের দিকে। অপুর্ব সেই খাল শুধু কল্পনাই করা যায়। স্বচ্ছ আরশীর মত পানির নীচে নজরে পড়বে হাইড্রিলা, খাসোরধাম, ঝাউধাম, পানিকলা ছাড়াও আরো কয়েক প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। চটাইন্নার বিল ছাড়াও শীতে হাওড়ের অনেক জায়গায়ই হাইড্রিলা নজরে পড়বে। শালিকের চ্যাপ্টা পাতার নীচ থেকে লাফিয়ে উঠে পাতার উপর বসে পড়লো এক ছোট্ট সবুজ ব্যাং।
কালেম পাখির বাসভুমি চটাইন্নার খালে প্রবেশ
সেই সরু খালের দু পাশে ঘন বিশাল সেই নলখাগড়ার বন কিযে তার সৌন্দর্য্য তা ভাষায় বর্ননাতীত। সেই মানুষ সমান উঁচু নলখাগড়ার বনে বাসা বেধেছে অদ্ভুত সুন্দর এক পাখি নাম তার কালেম।পাখি আর জলজ উদ্ভিদের এক অপরূপ মিলন মেলা বসেছে যেন সেখানে। খাল দিয়ে ধীরে ধীরে এগুতেই মাঝি আস্তে করে জানালো সেই নীল রঙ্গা কালেম পাখি বসে আছে ঝোপের পাশে।ক্যামেরা তাক করতেই উড়ে গেল সাথে আরো তিন চারজন সঙ্গী নিয়ে।
উড়ে যাওয়া কালেমের ঝাঁক
এছাড়াও সেখানে দেখা মিল্লো জলমুরগি, বক, বিভিন্ন জাতের ফুটকি পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখির। প্রায় ১২টা বাজে, সেই নিস্তব্ধ নিরিবিলি শুনসান খালের মাঝে নৌকা থামিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে আনা খাবার মাঝির সাথে ভাগ করে খাচ্ছি আর অপরূপ সেই সৌন্দর্য্য প্রান ভরে উপভোগ করছি। পানিতে পা চুবিয়ে দেখছি পাশের ঝোপেই কালেম সহ বিভিন্ন পাখির আনাগোনা। আমরা তিনজনই চুপ করে আছি। মনে হচ্ছিল সেখানে কোন কথা নয়, কথা বলার স্থান নয় এটা। শব্দ না করে পানির নীচে থাকা গাছের ছবি তুলছি একের পর এক।
বেশ কিছুক্ষন পর আমরা চটাইন্না খাল পার হয়ে এগিয়ে গেলাম চটাইন্না বিলের দিকে। এখানেও কালেম, টিটি আর দলপিপির সাথে দেখা হলো।পানকৌড়ি ছিল সব খানেই আর কানি বক। পানি কম থাকায় বিলের নীচের সেই জলজ গাছ ও তাতে ফুটে থাকা সেই দৃষ্টি নন্দন ফুল্ কি যে তার সৌন্দর্য্য তা না দেখলে বোঝানো যাবে না।
বিশাল সেই বিলের মাঝে আমরা
প্রায় ৪০ মিনিট সেই বিল ঘুরে এগিয়ে গেলাম রুপাভূই বিলে।মাঝি জানালো এই বিলের মাটি নাকি রপোর মত রঙ আর তার জন্যই এই নাম। মাঝিভাই এই হাওড় সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ মনে হলো। কিন্ত প্রশাসনের লোকেরাই কিভাবে মাছ ও অন্যান্য সম্পদ চুরি করে তার বর্ননা দিল।আমার স্বামীর পেশা জেনে এই ব্যাপারে কিছু করার জন্য তার করুন মিনতি আর অনুরোধ আমাকে বিস্মিত করে তুললো।তার মত একজন শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের এই বিল রক্ষার জন্য আকুলতা দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসলো আমাদের।
মাঝি ভাই মহা আক্রোশে ছিড়ে গুটিয়ে তুলছে সেই চুরি করে পাতা কারেন্ট জাল
রুপাভূই বিলটিকেও মাছের অভয়াশ্রম বলে ঘোষনা করা হয়েছে বলে জানলাম।বিলের মাঝখানে বাঁশ গেঁথে ঘেরাও করা আছে । পানি থেকে হাতখানেক ভেসে ওঠা বাঁশের মাথায় বিশেষ করে দু জাতের পাখি বসে আছে। এরা ছিল পানকৌড়ি আর তাদের জাতিরই গ্রেট ব্ল্যাক করমোরান্ট। গ্রোগ্রাসে মাছ খাবার জন্য বাংলায় যার খ্যাতি মহা পেটুক নামে।
আমাদের সাড়া পেয়ে উড়ে গেল ব্ল্যাক করমোরেন্ট বা মহা পেটুক পাখি
চলতে চলতে রুপাভূই ছাড়িয়ে লেচুয়ামারা বিলে কখন প্রবেশ করেছি বলতে পারবো না। এই বিলটি বেশ গভীর থাকায় জলজ উদ্ভিদগুলো আর দেখা গেল না তবে কিনারে পানি কম থাকায় সেখানে প্রচুর হাঁস জাতীয় পরিযায়ী পাখি দেখা গেল। ততক্ষনে আমাদের ক্যামেরার চার্জ শেষ।আমরা সেল ফোন দিয়ে ছবি তুলছি। কিন্ত অতদুর থেকে সেই লক্ষ পাখীর উড়ে যাওয়া আবার পানিতে বসার সেই অপরূপ দৃশ্য তোলার ক্ষমতা মোবাইলের ছিল না। তাদের পাখার সেই রুপোলী ঝিলিক দেখে মনে হচ্ছিল যেন শত শত আয়নার রিফ্লেকশন।
গাছে বসে থাকা পাখির দল
এই লেচুয়ামারা বিলটি হাওরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা। এর পশ্চিমপাশে হাতিরগাঁতা কান্দা, উত্তরে কয়েক কিমি দুরেই মেঘালয়ের পাহাড়।অসংখ্য পরিযায়ী পাখির সেই মিলনমেলায় কেমন করে এখানে একটি ঘন্টা সময় কেটে গেল বুঝতেই পারিনি দুজন। লেচুয়ামারা বিল ঘুরে হাতিরগাঁতা কান্দায় আসলাম।
গোলাবাড়ি- বাঘমারা ট্রেইল শুরু হলো কিছুক্ষনের পথ চলা তাই এখানেই নৌকা থেকে নেমে পরলাম।
সেখান থেকে গোলাবাড়ী বাগমারা ট্রেইল। এখানে আমরা নৌকা থেকে নেমে হিজল আর করচের বনের মাঝ দিয়ে গোলাবাড়ির দিকে চলে যাওয়া অসাধারন এক মাটির পথ ধরে হাটতে শুরু করলাম।
গোলাবাড়ি বাঘমারা ট্রেইলে এক প্রকৃতি প্রেমিক
প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য যেন নিজ হাতে তৈরী সেই পথ।মনে হচ্ছিল সেই গানটির কথা এই পথ যদি না শেষ হয়.....।। দু পাশে তার করচ গাছের ঘন বন, তাতে দু একটা হিজল ও দাঁড়িয়ে আছে। পথের পাশে জংলি স্ট্রবেরী আর গোলাপের ঝাড় আর তাদের সেই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্য যা আপনার চোখে পড়ার জন্য স্থির অপেক্ষায়।
গভীর নীল রঙ্গা প্রাকৃতিক এক লেক
তারই এক পাশে গভীর নীল রঙ্গা প্রাকৃতিক এক লেক তার সকল রূপের ডালি মেলে বসে আছে।
পথের পাশের উচু গাছে শত শত পাখির আবাস আর ঝোপে ঝাড়ে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদে পাখির ঝাক।মাঝি বলে দিয়েছে এক ঘন্টার মাঝে নৌকায় উঠতে, না হলে তাহিরপুর অর্থাৎ সুনামগঞ্জ পৌছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছিল সেই করচের ছায়ায় বসে থাকি আর চেয়ে দেখি উত্তুরে টিটি আর কাস্তে চরার রূপ ।
একাকি করচ
সেই স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে আসলাম সময়ের হিসাব করে। তিনটা বাজে প্রায়। সেই একই পথে ফিরতে হবে, পথে পড়লো যাবার সময় চোখে দেখা ছোট তাহিরপুর কি জানি কি কারনে তার নাম স্যালাইন তাহিরপুর। হাওড়ের মাঝে দ্বীপ সদৃশ্য এক গ্রাম। সেখানে নতুন টিনের তৈরী এক ক্ষুদে চায়ের দোকানে চা খাবার জন্য নৌকা থামালো। তবে নেশাটা ছিল আমারই বেশি। আমি নৌকায় বসে রইলাম।মাঝিকে নিয়ে আমার স্বামী নামলো। মাঝি লিকার চা আনলো আমার জন্য। গ্রামের বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ সেখানে বসা।
ছোট তাহিরপুর বা স্যালাইন তাহিরপুরে চা পানের জন্য থামা
আমার স্বামী তার দীর্ঘদিনের স্বভাব অনুযায়ী সেখানে একটা আলোচনা শুরু করে দিল। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল চোরা মাছ শিকারী, কারেন্ট জালের অপব্যাবহার এবং তাতে প্রচুর মাছ মরে পঁচে আটকে থেকে প্রানীজ সম্পদ তথা জীব বৈচিত্রের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করা।
তার ১০ মিনিটের বক্তব্যে সেই স্থানীয় বাসিন্দারা এতই আভিভুত হলো যে তাকে সেই স্যালাইন তাহিরপুরে দুদিন থাকার জন্য পিড়াপিড়ি শুরু করে দিল। তাদের কে আলিঙ্গনের মাধ্যমে বিদায় জানিয়ে সে নৌকায় এসে বসলো। মাঝিও নৌকা ছেড়ে দিল। তবে আসরের সময়ে সে নৌকা কিনারায় ভিড়িয়ে নামাজ পড়তে ভুল্লো না। খুব ভালো একজন লোক। আমাদের অনেক ছবিও সে কায়দা করে তুলে দিয়েছে।
মাঝি ভাই এর তোলা ছবি
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমরা সোলেমানপুর ঘাটে আসলাম।আমাদের জন্য অপেক্ষারত সিএনজিতে উঠে বসলাম। সব মিলিয়ে সুনামগঞ্জ পৌছাতে সাতটা, সাড়ে সাতটা বাজলো। বাস্তব হলো আমার দীর্ঘদিনের কল্পনার টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমন।
সুনামগঞ্জ জামতলা হেলভিটাসের রেষ্ট হাউজ থেকে এপারের বৈঠাখালি ঘাট রিকশাভাড়া ২০/= টাকা
ওপারের বৈঠাখালি ঘাট থেকে তাহিরপুর এর সোলেমানপুর সিএঞ্জি ভাড়া আপডাউন ১৬০০/= টাকা। ট্রলার ১০০০/= টাকা ।
ছবি আমাদের অপটু হাতে ক্যানন ক্যমেরা আর সেল ফোনে তোলা।