ঘুঘু ডাকা নিরালা নিঝুম দুপুরে ভাঙ্গা ঘাটের পৈঠায় বসে কাঁসার দু তিনটে থালা আর একটা বড় জামবাটি তেতুল দিয়ে একমনে ঘসে ঘসে মেজে চলেছে মিনু ওরফে মিনতি রানী দেবী।
এই থালা বাসনগুলো আজ থেকে সেই কত বছর আগে তার বিয়েতে পেয়েছিল দান সামগ্রী হিসেবে, তবে বেশিরভাগই গিয়েছে কালের গর্ভে। সেদিন ঝুলভরা তাক থেকে উইএ কাঁটা কিছু পুরনো বই ফেলে দিতে গিয়ে নজর পরলো এগুলোর দিকে। কত বছর হলো ছুঁয়েও দেখেনি কারন দেখার দরকারও যে হয়নি। অনেকদিন হলো এলুমিনিয়াম তারপর মেলামাইন এসেছে ঘরে। সেই মান্ধাতার আমলের পুরনো কাঁসার ভারী থালাবাসন আজ অপাংতেয়। ধুলো বালি আর ব্যবহার না করায় কালচে হয়ে গেছে।
সাত সাতটি কন্যা সন্তানের মা বিধবা মিনতি রানীর মনে পরলো সেদিনের কথা যেদিন একটি জীর্ন মলাটবিহীন বই হাতে তার স্বামীর গৃহপ্রবেশ। সেই বই এর একটি পাতায় চৌখুপি কাটা নয়টি ঘর, লেখা আছে সেই ঘরের সাতের কোঠায় যদি কারো আঙ্গুল পরে তবে তার নাকি পুত্র সন্তান হবে। কিন্ত পোড়া কপাল সেই ঘরে আঙ্গুল ফেলার সৌভাগ্য তার স্বামীর কোনবারই হলোনা।
তিনটি মেয়েকে সবকিছু বেচে কোনরকমে পার করে তিনিতো স্বর্গবাসী হলেন। এখন অবিবাহিত চার চারটি যুবতী মেয়ে নিয়ে মিনতি রানীর কি করে দিন কাটছে তা সেই জানে আর বিধাতাই জানে।
পানিতে পায়ের গোঁড়ালি পর্যন্ত চুবিয়ে উপুর হয়ে নারকেলের ছোঁবায় তেতুল মাখিয়ে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে জোরে জোরে মেজে চলেছে কাঁসার থালাবাটিগুলো। তার সেই ভঙ্গীতে ফুটে উঠেছে নিয়তির বিরুদ্ধে এক চাপা আক্রোশ। যেন সেই তীব্র ঘর্ষনে মুছে ফেলতে চাইছে তার কপালের লিখন।
একটু দম নিয়ে তাকিয়ে দেখে মাঝ পুকুরে কচুরিপানার দামের ভেতর খালি জায়গাটায় একটা পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে আবার ভেসে উঠছে ভুস করে। এবার মুখে ছোট্ট একটা মাছ। পুকুরের ওপাশের বাদিকের কোনায় এক ঘর ব্রাম্মনদের বাস। বাড়ীতে পুজা পার্বনের জন্য সেই বৃটিশ আমলে তাদের এখানে বসিয়েছিল বাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা মালিক বিখ্যাত পাট ব্যাবসায়ী স্বর্গীয় হরিপ্রসাদ রায়।
এক সময় লোকজনের ভীড়ে গমগম করা, শান শওকত আর জৌলুসে ভরপুর চুন সুরকির দোতলা বাড়ি,সাথেই লাগানো পুজোর জন্য পাকা নাট মন্দির। আর তার চারিদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে ফুল আর ফলের বাগান, দিঘী যা আজ হেজে মজে গিয়ে পুকুরে পরিনত, সবই আজ ক্ষয়িষ্ণু, ধ্বংস প্রায়। কারুকার্য্যময় বিশাল দোতালা বাড়ি তার সব রূপযৌবন হারিয়ে ভগ্ন পোড়োবাড়ির রূপধারন করেছে। মাথার উপর যেকোন মুহুর্তে ভেঙ্গে পরতে পারে জেনেও মিনতি রানীর মত কিছু অসহায় পরিবার এবাড়ীর একটি দুটি ঘর লীজ নিয়ে বসতি গেড়েছে।
অনেকক্ষন পর সোনার বঁরণ ধারন করা কাঁসার থালা বাটিগুলো কঁচলে ধুয়ে নিল মিনতি দেবী ।এবার বা হাতের উপর থালাগুলো সাজিয়ে নিয়ে ভেজা কাপড়ে সপসপ আওয়াজ তুলে বাগানের মাঝের সরু মাটির রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
আজ ছুটির দিন, দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে শর্মিলা নির্মলা দুবোন খাটে শুয়ে শুয়ে নাটক দেখছিল। মিনতি রানী তাদের সজাগ থাকতে বলে পুকুরে গিয়েছে। কি জানি ঘুমিয়ে পড়লো কি না ।সারা সপ্তাহ অমানুষিক খাটুনির পর ঘুমিয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। তাদের ঘরের সামনের দিকে আসতেই নজরে পরলো উঠোনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রমহিলা ঘরের ভেতর উকি ঝুকি দিচ্ছে।
"কে কে আপনি" ?
আগন্তক চোখ ফিরিয়ে তাকে দেখে এগিয়ে আসলো তারপর নরুন পাড় সাদা ধুতির শাড়ি পরা শ্যামলা মুখখানির দিকে তাকিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলে উঠলো ‘মাসীমা!
"কে আপনি চিনতে পারছি না"? চোখের উপর হাত রেখে সুর্য্যের আলো বাঁচিয়ে প্রশ্ন করে।
‘মাসীমা আমি রোকেয়া, শর্মিলার রুকু ভাবী'।
"ওহ তুমি! আসো আসো মা ঘরে আসো এই কই তোরা দ্যাখ কে এসেছে ", বলেই তাড়াতাড়ি বারান্দায় থালাগুলো নামিয়ে ডানদিকের ঘরটায় প্রবেশ করলো মিনতী রানী।
মায়ের ডাকে ধরমর করে উঠে বসে দুবোন। ততক্ষনে স্যন্ডেল খুলে রুকুও বারান্দায় উঠে এসেছে।ঝকঝকে মেঝেতে পা রাখতেই ঠান্ডা শীতল অনুভুত হলো পায়ের পাতায়। শর্মিলা বেড়িয়েই রুকুকে দেখে ভাবী বলে জড়িয়ে ধরে রুকুও এক হাতে তার হাত পেঁচিয়ে ধরলো।
"ভাবী কতদিন পর আপনাকে দেখলাম ? এত দিনে আমাদের কথা মনে হলো"? গলায় অভিমানের স্বর ফুটে উঠে শর্মিলার।
'দিদি আপনিও তো আমার খোঁজ করেন নি, আমিতো তবুও ভয়ে ভয়ে আসলাম এত দূর পথ পেরিয়ে। মনে হচ্ছিল হয়তো আপনারা এখানে নেই’।
"কই যাবো এখানেই আছি ভাবী, আপনি একা এসেছেন ? আতিক ভাই আসে নি" ?
‘না দিদি আমি একাই এসেছি, আপনার ভাইতো এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে’।
বলতে বলতে সেই দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে ওঠা ঘরটায় ঢুকে সেই প্লাস্টিকের ভাঙ্গা চেয়ারটায় বসলো, যাতে সে পনের বছর আগে বসেছিল পাঁচদিন। বাড়ীটা যেন আরো জীর্ন হয়ে পড়েছে। অশ্বথ আর বটের চারার শেকড়গুলো কড়ি বর্গা ভেদ করে ঘরে ঢুকে পরেছে মনে হয়। অবস্থা দেখে রুকুর মনে হলো সামান্য বাতাসেই এটা ধসে পরবে কোন দিন।
মাসীমা কাপড় বদলে সামনে এসে দাড়ালো। সিঁথির সাথে কপালটাও পরিস্কার, গতবারের দেখে যাওয়া টকটকে লাল সিদুরের ফোটাটা অদৃশ্য।
টুকটাক দু একটা কূশল প্রশ্ন করে নির্মলাকে নিয়ে পাশের ঘরে স্টোভ জ্বেলে বসলো রুকুর জন্য নাস্তা বানাতে।
রুকু বেশ অনেকদিন আগেই কার মুখে জানি শুনেছিল শর্মিলাদির বাবা মারা যাওয়ার কথা।এখন মাসীমাকে দেখে সেটা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
“বাবা মারা গেছে শুনেছেন ভাবী”?
‘হ্যা শর্মিলাদি শুনেছি, কি হয়েছিল মেসোমশাই এর’ ?
“স্ট্রোক”
‘ওহ’
“আতিক ভাই কেমন আছে? আর আমাদের ভাগ্নে তার খবর কি? ওকে নিয়ে আসলেন না কেন, দেখিনি কখনো”।
‘সবাই ভালো আছে দিদি, রাতুলের পরীক্ষা তাছাড়া আপনারা আছেন কিনা তাই তো জানি না। তারপর কেমন আছেন’?
“আছি আর কি চলে যাচ্ছে। কোনরকম”।
‘বিশাখা, লক্ষী, রানী ওরা সবাই কোথায়’?
“লক্ষীর আজ বিকেলে ডিউটি আর রানী মনে হয় ছাত্র পড়াতে গিয়েছে"।
'আর বিশাখা' ?
"ভাবী বিশাখার কথা আর কি বলবো আপনাকে, মুখ নীচু করে শর্মিলাদি ভয় পাওয়া গলায় ফিসফিস করে বলে উঠলো "সেতো পালিয়ে গিয়ে অন্য ধর্মের এক ছেলেকে বিয়ে করে চলে গেছে, বাবা ওকে ত্যজ্য করেছে।জানেনতো সমাজ না হলে আমাদের এক ঘরে করতো"।
বিশাখার মিষ্টি মুখটি মনে পড়লো রুকুর, ‘কিন্ত দিদি সে ভালো আছে তো ? নাকি সেই ছেলেও তাকে ছেড়ে গেছে?’
“না ভালোই আছে শুনেছি। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। জামাই পয়সাওয়ালা। ওকে সুখেই রেখেছে"।
এ কথা শুনে চুপিসারে একটা স্বস্তির নিঃশাস ছাড়ে রুকু। হোক অন্য ধর্মের, সংসার, স্বামী- সন্তানের সুখতো বরাতে জুটেছে মেয়েটির।
ছেলে ছেলে করে শর্মিলাদিরা সাতটা বোন হলো তারপর ও পুত্র সুখ অধরাই থেকে গেল ছোট এক উপজেলার সামান্য স্কুল মাষ্টার শ্রী দিলীপ চন্দ্র রায়ের।
“ভাবী আজ কিন্ত থেকে যেতে হবে”, হাতটা আরো জোড়ে জরিয়ে ধরলো শর্মিলাদি।
‘না দিদি আজ নয় আরেকদিন আসবো, আজ কাউকে বলে আসিনি’।
রুকুর মনে পড়ে গেল সেইসব দিনগুলোর কথা,যখন তারা একই কমপ্লেক্সে থাকতো। সারা দিন মনে হয় তারা মানিকজোড়ের মত ছিল। উনি সেই প্রতিষ্ঠানের এক প্রকল্পের প্রশিক্ষক ছিলেন । রুকু সেখানেও গিয়ে মাঝে মাঝে হানা দিত। বিকেলে গ্রামের ভেতর বেড়ানো, রাতে একসাথে ক্যন্টিনে খাওয়া। কোন বাটির মাছের টুকড়াটা বড় তাই নিয়ে বাবুর্চি চাচার সাথে খিটিমিটি। কোথায় সেই দিন গুলো দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে। মাঝে মাঝে দিদি বাড়িতে যেত । অনেক সময় ওনার বাবা এসে নিয়ে যেতেন। তখন কিযে খালি খালি লাগতো রুকুর।
নির্মলা থালায় করে লুচি আর হালুয়া নিয়ে আসে। মাসীমা চা এর কাপ হাতে এসে বসে।নাস্তা খাওয়া শেষ।বিকেল হয়ে আসছে। রুকু উঠে দাঁড়ায়।ওরা সবাই বড় রাস্তার কাছে এগিয়ে আসে তার গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য। এসময় মাসীমা একটু দ্রুতলয়ে কাছে চলে আসে ।রুকুর হাতদুটো ধরে কাতর মিনতিতে বলে ওঠে ‘মা তোমার শর্মিলাদির জন্য একটা পাত্র দেখো, আমি বিধবা মানুষ,মাথার উপর চারটে কুমারী মেয়ে, ভগবান আমাকে একটি পুত্র সন্তানও দিলোনা যে ওদের দেখে রাখবে। এদের একটা গতি করে না গেলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না মা। ’।
এক নিশ্বাসে বলে যায় মাসীমা তাঁর মনের কোনে অহর্নিশি বয়ে চলা কষ্টের কথা , চোখে ফুটে উঠে এক গভীর বিষাদ যা রুকুকে খানিক্ষনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। কোনমতে বলে উঠে ‘ মাসীমা আমি চেষ্টা করবো’।
কিন্ত আপনাদের জাত, পাত, ঠিকুজি কোষ্ঠি মিলিয়ে পাত্র খুজে পাওয়া কি সম্ভব আমার পক্ষে,আর আমি কি এসব বুঝি ! মনের ভেতর আকুল বিকুলি করা কথাটি বলতে গিয়েও বলতে পারেনা রুকু ? আস্তে গাড়ীতে উঠে বসে । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো দুপাশে দু মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনতী রানী, মনে হচ্ছে বিশাল পাহাড় সমান বোঝা কাঁধে নিয়ে।
মনে পড়ে বছর পনের আগে রুকু অর্থাৎ রোকেয়া চৌধুরী শর্মিলাদির এই বাসায় এসে পাঁচদিন থেকে গিয়েছিল। দ্বিতীয়দিন বিকেলে মাসীমা শর্মিলাদিকে ডেকে বলেছিল 'শর্মি মেয়েটাকে নিয়ে আমাদেরদের গ্রাম আর সেখানে ফেলে আসা গ্রামের বাড়ীটা দেখিয়ে নিয়ে আয়'।
মেঠোপথ ধরে হাটতে হাটতে এগিয়ে যাচ্ছিল রুকুকে নিয়ে শর্মিলা। পাশে একটা পুকুর তার উপরে উপুর হয়ে আছে এক ঝুপসী বট গাছ, যার ঝুড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দোলনা বেধে ঝুলছে। পাশে লম্বা একটা ঘর। ওটা নাকি স্কুল। বাদিকে দুর দিগন্ত ঘেষা ধানের মাঠ তাতে সোনালী ধানের ছড়া ফলভারে নুয়ে পরেছে। বেশ কিছুদুর হাত ঘুরিয়ে এনে পরিমানটা দেখিয়ে শর্মিলাদি বলে উঠে, “ভাবী এই জমিগুলো না আমাদের ছিল”।
‘এখন কি হয়েছে দিদি’? উৎসুক মুখে প্রশ্ন করে রুকু।
“মেজদির বিয়ের সময় বেঁচে দিয়েছে বাবা”।
‘কি বলেন’! আর্ত কন্ঠে বলে উঠে রুকু।
“জী ভাবী আমাদের মেয়ের বিয়েতে অনেক টাকা যৌতুক দিতে হয়”।
রুকুর মুখে আর কথা যোগায় না,সাত মেয়ের মাঝে মাত্র দু মেয়ের বিয়ে দিতেই যার সর্বস্ব বিক্রি করতে হয় তার পর কি হবে!আস্তে আস্তে শর্মিলাদি দেখিয়ে চলে তাদের প্রাক্তন বসত বাটি। গাছপালায় ঘেরা বিশাল উঠোন নিয়ে খোলামেলা সেই বাড়িটি ত্যাগ করে তারা নিরাপত্তার জন্য গিয়ে উঠেছে জীর্ন পুরাতন ভাঙ্গাচুড়া দালানবাড়ীতে, যেখানে ঘরে ঘরে এক পরিবারের বাস।
সেই পাঁচদিন রুকু ঐ বাড়ীর মেয়ের মতই হয়ে গিয়েছিল। পুকুরে গোসল, আসন পেতে ভাত খাওয়া, সব কিছুই। এমনকি ঘরের ভেতর ছোট আসনে রাখা দেবতার নিত্য পুজার সময় ও সে উপস্থিত থাকতো।
মেসোমশাই অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সাতটা মেয়ে হলেও তিনি তার স্ত্রী কন্যাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মা ছাড়া কোন মেয়ের সাথে কখনো কথা বলতেন না। রুকুকেও মা বলেই সম্বোধন করতেন ।
রুকুকেও পাঁচটি দিন আদরে মমতায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার স্নেহাতুর মুখটি ভেসে উঠলো রুকুর মনের পর্দায়। প্রচন্ড এক ঝড়ের দাপট সামলে চলেছেন কি অনন্ত সাহস নিয়ে। চার চারটি বিয়ের উপযুক্ত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মুখে স্নেহের হাসি ম্লান হতে দেখেনি।
একটু আগে রুকু চলে গেল, অনেক বছর পর আসলো মেয়েটা, আগের বার যখন এসেছিল তখন তার কোন সন্তান ছিল না। এখন সে এক পুত্রের মাতা,স্কুলে নাকি পড়ে।রুকুর স্বামীকে আগের বার দেখেছিল, সুদর্শন ভদ্রলোক। রুকুকে দেখে মনে হলো অনেক সুখেই আছে। রুকুকেও বলেছে শর্মিলার জন্য পাত্র দেখতে, ভগ্নস্বাস্থ্য চল্লিশোর্ধ কন্যার জন্য রুকু কি পাবে পাত্র ! যাই যুটুক একটা মেয়েরও গতি যদি হতো, বিধাতা কি তার মুখের দিকে ফিরে চাইবে না ?
একে একে চার কন্যা যখন হলো তখন মিনতী রানী অনেক লজ্জার মাথা খেয়ে স্বামীকে বলেছিল আর সন্তান না নেয়ার কথা। দিলীপ বাবু গভীর বিশ্বাসের সাথে বলেছিল ‘ তুমি দেখে নিও এবার আমাদের পুত্র সন্তান হবেই। ছেলে না থাকলে মরার সময় কে মুখে জল দিবে রাধার মা কে মুখাগ্নি করবে বলো? আর তা না হলে আমার চৌদ্দপুরষ নরকস্থ হবে যে মিনু’।
অসহায় মিনতীর গলায় আর শব্দ ফোটেনা, চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকে মেঝেতে। চতুর্থ মেয়ের জন্মের আগে কার কাছ থেকে শুনে কোথা থেকে এক ছেড়াফাটা এক বই নিয়ে আসলো। কিসের বই এটা? মিনতীর প্রশ্নের জবাবে লাজুক হেসে দিলীপ বাবু জানালেন ‘ এটা খুব গুরুত্বপুর্ন একটা বই। এতে ভাগ্য জানা যায়। দেখ বইটি্র এই পাতায় লেখা আছে,
“ওঁ নমো ভগবতী মাতঙ্গিনী সর্বকার্য সিদ্ধি কুরু কুরু স্বাহা" ..মন্ত্রটি তিন বার বলে এই নয়টি অংকের যে ঘরে হাত রাখবে সেই রকম ফল পাবে। দেখ, দেখ লেখা আছে সাত নম্বর ঘরে পরলে পুত্রসন্তান লাভ হবে’।
কিন্ত বিধাতার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। তিনি বোধ হয় চাননি তাদের পুত্র সন্তান হোক। কারন যতবারই মিনতী দেবী সন্তান সম্ভাবা হতেন ততবারই দিলীপ বাবু সেই বইটি নিয়ে বসতেন। কিন্ত কোনবারই তার প্রত্যাশিত সাতের ঘরে আঙ্গুল পরেনি। একে একে সাত কন্যার জননী মিনতী দেবীর লজ্জা/ভয় সরে গিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড এক ক্রোধের সুত্রপাত হয়েছিল। বিধাতার উপর তার চরম আক্রোশ মিটিয়েছিল বইটি ছিড়ে কুটি কুটি করে আগুনে পুড়িয়ে।
দু বছর আগে এক সন্ধ্যায় টিউশনি সেরে বাসায় এসে ধপ করে বারান্দায় বসে পরে দিলীপ বাবু। তার মিনতি ডাকে মা মেয়ে সবাই দৌড়ে আসে। তাদের চিৎকারে সামনের বাড়ীর ছেলেটাও বেরিয়ে আসলো। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গেল উপজেলা হাসপাতালে। অজানা আশংকায় বুকটা খামচে ধরে মিনতী দেবীর। নার্স এসে জানালো এক জন একজন করে ভেতরে যেতে দেখার জন্য।সবার শেষে আসলেন মিনতী দেবী। স্বামীর নিমিলিত চোখ কিন্ত অস্ফুট গলায় কি যেন বলছে। কানের কাছে মুখ নিতেই শুনলো
“মিনতী তুমি চিন্তা করোনা এবার আমার সাতের ঘরে আঙ্গুল পড়বেই, নাহলে কে আমাদের মুখাগ্নি করবে বলো”?
চৌদ্দপুরুষ নরকস্থ করার দায় নিয়ে অহল্যার মত কঠিন প্রস্তরবত হয়ে বসে থাকে মিনতী রানী দেবী তার সদ্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা স্বামীর শিয়রে।
উপরের ছবিটি আমার আঁকা + এডিট ।