সিলেটের আকর্ষন সেই লালাখাল
দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ, নাম তার সিলেট, বুক জুড়ে থাকা অজস্র ছোট ছোট টিলা চির হরিৎ চা পাতার চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে সেই বৃটিশ শাসনামল থেকে । ইতিহাস সাক্ষী তিন শতাধিক ওলী আউলিয়ার পদধুলিতে ধন্য পুন্যভুমি একদা যার নাম ছিল শ্রীহট্ট। সেখানে রয়েছে দূর দিগন্ত রেখায় দাঁড়িয়ে থাকা ঝাপসা মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের সারি , আর পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা সেই অপরূপ ঝর্নাধারা যার পড়ন্ত জলে রংধনু একে চলে সাতরঙ্গা হার।
ব্রিজের উপর থেকে দেখছি অপরুপা সারি নদীকে
সুরমা, কুশিয়ারা, সারি এক নামে চেনা সেই নদী বিধৌত সিলেট। বসন্তের বাতাসে মরমী শিল্পী শাহ আবদুল করিমের উঠোনে বোনা ফুলের গন্ধ বন্ধুর বাড়ী ছাড়িয়ে দেশের আনাচে কানাচে ভেসে যায় সেই সিলেট। অম্ল মধুর স্বাদে সেই কমলা রঙের ফল কমলা লেবুর দেশ। একসময় কমলালেবুর নাম শুনলেই সিলেট নামটা চোখে ভেসে উঠতো সবার। আজ সে অবশ্য তার সেই গৌরবকে কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে নানা কারনে। থাক সে কথা।
সেই সুরমা নদী যার তীরে সিলেট শহর
এই সিলেট তার মন মাতানো সৌন্দর্য্য দিয়ে পর্যটকদের টেনে আনে সারা বছর জুড়ে। সে টান এড়ানো বড্ড কঠিন সবার কাছে, তাকে একবার দেখে যেন কারোই মন ভরে না। সেই টান সেই অতৃপ্তি আমাদেরও ২০১৪ এর মার্চের ১৫ তারিখ তৃতীয় বারের মত নিয়ে গেল সেই চা এর দেশে।
চা বাগান
ট্রেন লেট ছিল দু ঘন্টা, সুতরাং পৌছাতেও দু ঘন্টা বেশি লাগলো। নির্ধারিত হোটেলে যখন পৌছাই তখন রাত বাজে নটা । টি টোয়েন্টি খেলার জন্য অন লাইনে কোন হোটেলই যখন পাওয়া মুশকিল হয়ে উঠেছিলো ঠিক সেই সময় অসাধ্য সাধন করলো আমাদের ব্লগের সবার প্রিয় মামুন রশিদ। তার কাছে আমি প্রথমেই আমাদের দুজনার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
শাহজালাল (রঃ) এর মাজার গেট।
১৬ই মার্চ সকাল নটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়লাম হোটেল থেকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দুটো মাজার জিয়ারত করার ইচ্ছা নিয়ে।প্রথমেই গেলাম হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজারে । হঠাৎ একটা হাল্কা শোরগোল শুনে তাকিয়ে দেখি এক ভক্ত তার সারা শরীরে শিকল আর তালার লহর ঝুলিয়ে মাজার চত্বরে প্রবেশ করলো। কিন্ত মাজারের দেখাশোনা করে যারা তাদের কেন জানি পছন্দ হলোনা তাকে । ঠেলে বের করে দিল তালাবাবাকে ।
সারা শরীরে তালা লাগানো সেই ভক্ত
ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা জালালী কবুতরগুলো্কে। বেড়া দিয়ে ঘেরা এক জায়গায় তাদের জন্য ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে শস্যদানা যা তারা সবাই মিলে খুটে খুটে খাচ্ছে বাক বাকুম শব্দ তুলে। মাজার চত্বরের মাঝেই পুকুর। রেলিং ঘেরা কিনারা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বিখ্যাত সেই অতিকায় গজার মাছ ।
বিশাল আকারের সব গজার মাছ শাহজালাল (রঃ) এর মাজারে
বিকালে এদিক ওদিক ঘুরে কয়েকটা মনিপুরি শাড়ি কিনে রাতে খেতে গেলাম সবার সেই অতি পরিচিত পানসী হোটেলে। মালিক ভদ্রলোকের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। এমন ভাবে কথা বলছিল যেন কত দিনের পরিচিত আমাদের।
লালাখাল
পরদিন আমরা যাবো অনেকের মুখে শোনা নাম লালাখাল দেখতে। বিশেষ করে যাবার আগে ব্লগের প্রিয় বন্ধু সুরঞ্জনা আমাকে লালাখাল দেখার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল । সে তখন ঢাকায় ভাইয়ার অপারেশনের জন্য।
হোটেলের মাধ্যমে আমরা রেন্ট এ কার থেকে তিন হাজার টাকায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত একটি এক্স করোল্লা ভাড়া নিলাম যেটা সারাদিন আমাদের সাথে থেকে জাফলং আর লালাখাল ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় হোটেলে পৌছে দেবে।
১৭ই মার্চ সকাল নটায় গাড়ী আসলো আর আমরা স্বামী স্ত্রী দুজন রওনা হোলাম সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বিখ্যাত নদী সারির অপরূপা সেই অদেখা লালাখাল দেখতে। বেশ চওড়া কার্পেট করা মসৃন পাকা রাস্তা দিয়ে চলেছি। হাতের বা দিকে বিশাল জায়গা জুড়ে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের বিখ্যাত এম, সি কলেজ।
বিখ্যাত এমসি কলেজ গেট রক্ষনাবেক্ষনের অভাবের চিনহ যার গায়ে প্রকট।
আর ডান দিকে হযরত শাহ পরান (রঃ) এর দরগা যা আগের দিন জিয়ারত করে গিয়েছি তা অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যের দিকে।
হজরত শাহ পরান(রঃ) এর দরগা শরীফ
সিলেট শহর থেকে আনুমানিক প্রায় ৩০ কিমি যাবার পর রাস্তার আশে পাশে বিভিন্ন সাইনবোর্ড দেখলাম যাতে পানিপথ এবং সড়ক পথে লালাখাল যাবার দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। সেখান থেকে নৌকা করে লালাখাল যাবার ব্যাবস্থা আছে ।
এই সেই অপরূপা লালাখাল
কিন্ত সাতার না জানা আমি সেই সাহস দেখাতে সাহস করলাম না । অতএব ডান দিকে যে নির্জন আঁকাবাকা পথ চলে গেছে লালাখালের দিকে তা দিয়েই অগ্রসর হতে লাগলাম। প্রায় ৮ কিমি নিরিবিলি গ্রামীন পাকা রাস্তা পেরিয়ে আমরা দুজন আসলাম শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্য্যময় লালাখালের তীরে।
সারি নদীর দিকে ছুটে চলা লালাখাল
গাড়ী থামলো এক রিসোর্টের সামনে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম আমার দ্বিতীয়বার চা খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে । হোটেল থেকে নাস্তা খেয়েই বের হয়েছি কিন্ত আমার স্বামীর মতে শুধু চা নাকি বলা যাবে না, তাই আরেকবার নাস্তার অর্ডার করা হলো।
রিসোর্টে নাস্তার টেবিলে
চা খেয়ে ধীরে সুস্থে রিসোর্টের নিজস্ব সিড়ি পথ বেয়ে আমরা আস্তে আস্তে এসে দাড়ালাম আমাদের কাংখিত গন্তব্যে। হাতের বা দিকে বেশ দূরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী কুল কুল শব্দে অবিরাম বয়ে চলেছে সারি নদীতে গিয়ে মিলবে বলে। সে জলের ধারা কোথাও বা নীলাভ কোথাও বা পান্না সবুজ। দু পাশ ঘেষে রয়েছে যার সবুজ অরন্য,পাহাড় আর চায়ের দেশের অপরূপ সুন্দর মন কাড়া সেই চা বাগান।
দু ঘন্টার জন্য আমাদের ছিল এই নৌযান
পর্যটকরা তখনো এসে পৌছেনি তাই আমরা দুজন এক হাজার টাকায় একটি ইঞ্জিন চালিত বোট রিজার্ভ করে শুরু করলাম আমাদের লালাখাল ভ্রমন।
এগিয়ে চলেছি সচ্ছ জলের স্রোত ধরে সন্মুখে
টলটলে স্বচ্ছ পানির বুকে সুনীল আকাশের ছায়া। হাল্কা ঢেউ তুলে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে সীমান্ত মিশেছে সীমান্তে। চোখ ফেরালাম পানির দিকে। পানির রঙ এত সুন্দর কি করে যে হয় বিস্মিত তাই আমি ভেবে চলেছি একমনে।
লালাখালের সেই পান্না সবুজ পানি
চোখ তুলে দেখি মাথার উপর ঝকঝকে নীলাকাশ, দিকচক্রবাল ঘেষে কিছু সাদা মেঘ থমকে আছে, মনে হচ্ছে কালনাগিনীর মত ফনা তুলে ছোবল দিতে আসবে কি আসবে না তাই হয়তো ভাবছে আনমনে। নৌকার দু পাশ ঘেষে গভীর সবুজ বা নীলাভ রঙের পানি দ্রুতগতিতে পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। অদূরে মেঘেরআলয় যা সংক্ষেপে মেঘালয় এর সুউচ্চ গম্ভীর পাহাড় এর সারি।
মেঘের আলয় থেকে নেমে আসা ঝর্না যা লালাখাল নাম নিয়ে সারি নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে।
মনে হচ্ছে কোন এক চিত্রকরের ক্যানভাসে আঁকা অপরূপ এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভেতর আমরা দুজন ভেসে চলেছি ।সেই সবুজ বা নীল বর্নের পানি কোথাও কোথাও কাকচক্ষু জলের মত স্বচ্ছ। তাকিয়ে দেখছি নদীর বুকে বিছিয়ে থাকা স্বর্নবর্নের পাথর আর বালু।
স্বচ্ছ পানির নীচে বিছিয়ে আছে স্বর্ন রঙ্গা নুড়ি
আবার খানিক পরেই পানির রঙ হলো পান্না সবুজ আর সেই সাথে গভীর হয়ে উঠলো। কিছু দূর পর পর পাল্টে যাওয়া পানির সেই অপুর্ব রং আর রূপের বৈচিত্র অবর্ননীয়।এগিয়ে চলেছি কোনদিকে তাকাবো ভাবতে ভাবতে।
এগিয়ে যাচ্ছি নৌকা করে সীমান্ত পয়েন্টের দিকে।
লালাখালের দুপাশের সবুজ ছোট শিলাময় পাহাড়গুলো দেখে মনে হলো অনেক বছরের পুরোনো যার মাঝে রয়েছে কিছু অদ্ভুত রহস্যময় গর্ত।
রহস্যময় কিন্ত দেখে মনে হয় মানুষের তৈরী অস্ত্র শস্ত্রের ছুড়ে মারা ক্ষত চিনহ
আমাদের নৌকা এক জায়গায় থামিয়ে মাঝি দেখালো ভারতীয় সীমান্ত চৌকি আর আমরা নাকি ভারতীয় অংশেই দাঁড়িয়ে আছি।স্থানটিকে সে সীমান্ত পয়েন্ট বলে উল্লেখ করলো।
বাদিকে পাহাড়ের টিলায় ঝোপের ভেতর সাদা বাংলোটি হলো বিএসেফ এর চৌকি ঘর।
মার্চের প্রচন্ড গরমের ভেতর অদুরের পাহাড় থেকে নেমে আসা লালাখালের সেই স্বচ্ছ ঠান্ডাপানিতে পা ভিজিয়ে হেটে বেড়ানোর কি যে আনন্দ তা লিখে বোঝানোর নয়।সেই স্বচ্ছ হিম হিম পানিতে হাত দিয়ে তুলছি ছোট ছোট নুড়ি পাথর যার গায়ে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ অবিরাম একে চলেছে নানারকম জ্যামিতিক নকশা। সেই নকশী পাথরের কোনটা স্বৃতি হিসেবে ঢাকায় নেবো, ‘এটা নাকি ওটা’ না না ঐটা আরো সুন্দর' বলে পানি থেকে তোলা আর ছুড়ে ফেলা এই দোদুল্যমনতায় কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়।
উপরে উঠছি মেঠো পথ বেয়ে
এবার খালের ডান দিকের তীর থেকে মাটির পথ বেয়ে খানিকটা উপরে উঠে দেখি নানারকম বৃক্ষের সবুজ অরন্য।বাতাসে শর শর শব্দ তুলে উড়ে যাচ্ছে ফাল্গুনে ঝরে পড়েছিল যেই পাতাগুলো।রোদের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমরাও এগিয়ে গেলাম একটুখানি।
লালাখালের তীরে
সেই চৈত্রের কড়া রোদ গাছের পাতা আর টুপির ফাক দিয়ে কখনোবা আমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে আলতো করে। বা দিকের গাছটায় চোখ ফেলতেই দেখলাম ডাল বেয়ে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে লেজ তোলা এক দুষ্ট কাঠবেড়ালী। কিছুক্ষন ঘুর ঘুর করে নেমে আসলাম কিছু বুনো ফুল হাতে নিয়ে।
বুনো ফুল
ফিরে আসার সময় নৌকা তীর ঘেষে এক জায়গায় থামলো, মাঝি জানালো এর উপরে আছে এক চা বাগান।সেই প্রাচীন পাহাড় বেয়ে উঠে আসলাম চির হরিৎ চা বাগানে যার সৌন্দর্য্য বর্ননাতীত। পাশের জঙ্গলের আলোছায়ায় কি এক অজানা পাখি ডেকে চলেছে অবিরাম। সেখানে রয়েছে সাদা রঙ করা চা বাগানের একটি অফিস।
চা বাগানের কি এক নাম না জানা অফিস
পাহাড় থেকে নেমে এসে বসলাম চ্যাপটা এক পাথরের উপর সেই সবুজ পান্না রঙ এর পানিকে চোখের সামনে রেখে।পাশেই পাহাড়ের খাজে রয়েছে বেগুনী রঙের নাম না জানা এক বন্য ফুলের ঝোপ। মাথার প্রায় উপরে তখন সুর্য চলে এসেছে। মার্চের সেই জলন্ত সুর্যের তেজও আমাদের ভালোলাগার বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটাতে পারেনি। চারিদিকের সেই সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ নীরবতা আমাদের আবিষ্ট করে রেখেছিল সে সময়টুকুর জন্য । মন বলছিল বসে থাকি খানিকটা সময় চুপচাপ আর প্রান ভরে উপভোগ করি অপরূপা লালাখালের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যকে।
পাথর আর বালি তুলে আনছে ডুব দিয়ে
দেখছি কিছু শ্রমিক নিঃশ্বব্দে পানিতে ডুব দিয়ে দিয়ে বালতি ভরে তুলে আনছে বালি, কোথাও বা পাথর শ্রমিকরা পাথর তুলে খালের বুকে বেধে রাখা নৌকায় ভরছে।বালি আর পাথর বোঝাই কিছু কিছু নৌকা নীরবে পাশ ঘেষে চলে যাচ্ছে, মনে হয় সেখানে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে গিয়ে সারি নদীর সাথে মিশেছে লালাখাল। তারপর সেই পাথর ট্রাকে করে চলে যাবে দুর-দুরান্তে যেখানে নির্মিত হচ্ছে ইট পাথরের দালান কোঠা সমস্ত সবুজকে নির্মুল করে।
পাশ ঘেষে চলে গেল বালি বোঝাই নৌকা
খালের তীরে দুজন নারী পুরুষকে দেখলাম চালুনী দিয়ে সেই খাল থেকে ছেঁকে তুলছে কুচকুচে কালো কয়লার কুচি।
দুজনা ছেকে তুলছে কয়লার কুচি
তা ছাড়াও স্থানীয় লোকজন মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে স্নান পর্ব থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ঘর গেরস্থালীর কাজ সারছে। ভেবে অবাক হচ্ছি এতরকম কর্ম কান্ডও সেই নিঝুম নৈশব্দকে ভেঙ্গে চুড়ে ক্ষনিকের জন্যও একটি স্বর তুলতে পারেনি।
দিন যাপনের পালা
মাঝির ডাকে ঘোর ভাঙ্গলো, আস্তে আস্তে নৌকায় এসে বসলাম, নৌকা ছাড়লো যেখান থেকে উঠেছিলাম সেই জায়গায় পৌছে দেবে বলে আর আমি স্বৃতিপটে গেথে নিলাম অনেক দিন ধরে চলা জীবন পথের মাঝে এই দুঘন্টা সময়।মোহিত হোলাম নীরবে নিভৃতে বয়ে চলা রূপের রানী লালাখালের রূপ দেখে।
ফিরে চলা