কাল রাতে স্বামীর কথা শুনেই নজরুলের মা এর মেজাজটা উনপঞ্ছাশ হয়ে আছে। সারাদিন মানুষের বাড়িতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ঘরে গিয়ে কি কথাটাই না শুনতে হলো তাকে!
“নজ্জুলের মা শুনছোস নাকি আকলিমা কিতা কইছে”?
‘কি কইছে ঐ বুড়ির ঘরের বুড়ি'? ছেলের বৌ এর নাম শুনেই ঝাঁজিয়ে উঠে সখিনা।
“তুই খালি হ্যারে বুড়ি বুড়ি কছ ক্যারে? পুতে হাউশ কইরা বিয়া করছে এহন কি করবি” !
‘অহ হাউশ কইরা ডবল বয়সের এক বুড়ি বিয়া কইরা আনছে, হ্যারে এহন বুড়ি কওন যাইবোনা না, না?'
তিক্ত গলায় বলে উঠে নজরুলের মা। তার সতের বছরের ছেলে এক তিরিশ বছরের মহিলা বিয়ে করছে এটা সহ্য করাই তার পক্ষে অসম্ভব। এর মধ্যে স্বামীর কথা শুনলে তার মেজাজ আর ঠিক থাকে না।
দশ দশটি বছর ধরে পঙ্গু স্বামীকে টেনে চলেছে সাথে ছোট ছোট দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে। তার একটি মেয়ে, সেও জন্ম থেকেই অসুস্থ।ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করছিল।কিন্ত সেই ছেলে যখন মায়ের বয়সী এই মহিলাকে বিয়ে করে আনলো তখন সে সত্যি সত্যি মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিল।কাঁচের মত চুরমার হয়ে যেন ভেঙ্গে পড়লো তার ভবিষ্যত নিয়ে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আর সাধ।
নজরুলের বাবার ধারণা ছেলে শখ করে বিয়ে করেছে এখন বৌকে আদর করলে ছেলেও হাতে থাকবে।এই জিনিসটা নিজের বউকে কিছুতেই বুঝাতে পারে না।শুনলেই অগ্নি মুর্তি ধারণ করে বলে উঠে,
‘ক্যারে আমরা কি পুত বিয়া দিয়া তার বাপের বাড়িত থিকা চাইর পাচ লাখ টাকা যুতুক আনছি যে তারে আমাগো সমাদর করতে হইবো! এইডা আফনে কি কন!’ রাগে গা জ্বলে যায় নজরুলের মা এর।
ছাদের উপর ছোট্ট চিলে কোঠার ঘরটি তিন হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া থাকে।দুই হাত চওড়া একটা চৌকি ফালানোর পর এক হাত জায়গাও যেন অবশিষ্ট নেই।এর মাঝেই কাপড় চোপড় রান্নার সরঞ্জাম বালতি বদনা কোন মতে গুছিয়ে রাখা।ছাদের এক কোনায় মাটির চুলায় রান্নার বন্দোবস্ত।গোসলখানা পায়খানা সব নীচে। এমনকি পানির কলটা পর্যন্ত ।প্রতিদিনের কাজের জন্য ভরা বালতি টেনে তুলতে হয় তাকেই ।ক্লান্ত নজরুলের মা মুখে একটা পান দিয়ে চৌকির এক কোনায় বসে প্রশ্ন করে,
‘কি হইছে? কি করছে আপনের পেয়ারের বউ’?
ঢোক গিলতে গিলতে বেলায়েত মিয়া বলে উঠে, “তুই যেন আবার চেতিছ না কথা হুইন্যা।দম নিয়ে বলতে শুরু করে আবার। "কথা হইলো গিয়া আমগো নুজ্জুলের বউ আকলিমায় দেশে ফুন দিয়া আমার মায়েরে কইছে যারা যারা এজতেমায় আইসা মুনাজাত করতে চায় তারা যেন হগলে ঢাহায় আমগো বাড়িত আইসা পরে"।
‘কি কইছে! কি কন আপনে? হজ্ঞলরে আইতে কইছে ? আমি যে গত মাসে গিয়া তাগোরে কইছি যেন এই শীতের মধ্যে কেউ জানি না আহে, এইহানে অনেক কষ্ট অইবো । বাড়িত বইয়াই তারা জানি টিভিতে মুনাজাত ধরে।আমার কথার উপর দিয়া এত মাতুব্বরী তার’!
বৌ এর স্পর্ধায় বিস্মিত নজরুলের মাএর সব প্রশ্ন এক সাথে ঠেলাঠেলি করে বের হয়ে আসে!
“হ আমার ছুডু খালা খালু পুলাপান নিয়া ভাঢির দ্যাশ থিক্কা বেরাইতে আইছে আমগো বাড়ী, হ্যাগোও আইতে কইছে, তারাও আইবো”
মিন মিনে গলায় কোনমতে এটুকু বলতে পারে সে।নিজে একজন পঙ্গু মানুষ। সারাদিন বিছানায় পরে থাকে। এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নাই। যা নজরুলের মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার টানছে। সে কি করে জোর গলায় কথা বলবে।নিজেও বুঝে এই বাজারে দশ বারো জন মানুষ সাতদিন তাদের উপর থাকা তাদের জন্য বিরাট বোঝা। কিন্ত তারও মনের একটা সুপ্ত ইচ্ছা যে তার মা আসুক।
“ মাইনষে কয় এইডা নাকি ছুডু হজ্ব।তয় আমরা হইলাম গিয়া ধর গরীব মানুষ। মক্কা শরীফ যাইতে তো আর পারুমনা। এই মুনাজাতে শরীক হইলেই আমাগো হজ্বের ছোয়াব হইবো বুঝছস। ”।
‘এতটি মানুষ কই থাকবো, শুইবো কই? লেপ তুষুক বানাইয়া রাখছে মনে অয় আপনের পুতের বউ।আর হেরাই বা কি! এট্টুক বিবেক হইলোনা।আমি যেন ঢাহাস শহরে ফেলাট বাড়ী ভাড়া কইরা বইছি’!
রাগত গলা নজরুলের মায়ের, তার মাথায় সোয়াবের চিন্তা নেই, তার হলো এত গুলো মানুষের থাকা, খাওয়ার চিন্তা।
“কি করবি ক ? বউ কইয়া ফালাইছে” কাশিটা চেপে কোনমতে ধরা গলায় বলে উঠে বেলায়েত মিয়া।
‘আর এত্তটি মানুষ আইবো তাগো এই আলগা লাকড়ীর চুলায় রান্না বাড়া কইরা খাওয়াইবো কেডা ? নিজে গো রান্না কইরাই পেরেসান আমি? আপ্নের পুতের বউইতো গারমেন কইরা আইসা বিবি সাবের মত রেডিমেট ভাত খায়’।
“তুই চিন্তা করিসনা সখিনা, আকলিমাই রান্না করবো, হ্যায় যখন ডাকছে”।
‘হু করবো না!শেষে আমারই সব করন লাগবো’ গজ গজ করতে থাকে সখিনা।
কি কপাল নিয়া এই দুনিয়ায় আসছিল ভেবে কুল পায়না সে।বাবা মার আদরের ছোট মেয়ে। বাপ গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন। অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়া ছাড়াও অনেক কোরান হাদীস জানে।গরু বাছুর ক্ষেত খোলা নিয়ে সচ্ছল সংসার ।তিন ছেলে চার মেয়ে। এক ছেলে আর সখিনার বিয়ে বাকি। সখিনার বিয়ের কথা সে মাঝে মাঝে ভাবে কিন্ত মেয়ের মা রাজী হয়না। বললেই বলে আরো দুই এক বছর যাক।কিন্ত তার মা মাঝে মাঝে খোচায়।‘নাত্নীর বিয়া দিতে হইবো, পাত্র দেখ’।
‘এত পাগল হইছেন ক্যান আপনে? সখিনার বয়স কত ? মাত্র বারো বছর ।আরো দুই এক বচ্ছর হাইস্যা খেইল্লা যাইতে দেন।বিয়া হইলেই তো বান্দীর জীবন’, বলে উঠে সখিনার মা।
“এইডা কি কইলা রহিমের মা? তুমি কি আমার বাড়ীত বান্দীর জীবন কাটাইতাছো! কউ দেহি”! আশ্চর্য্য হয়ে যায় জনুরুদ্দিন কিন্ত সখিনার মা আর উত্তর করে না।
পাশের গ্রামের ফকির আলী কি কাজে জানি একদিন সখিনাদের বাড়িতে আসে। সেসময় সখিনারে দেখে খুব পছন্দ হয় তার।নাক মুখ খাড়া খাড়া, ফর্সা দোহারা গড়ন সখিনা মাথায় কাপড় দিয়ে উঠান পার হয়ে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিল।এক নজর দেখেই তার মনে হলো এই মেয়ের সাথে তার বড় ছেলে বাইশ বছরের যুবক বেলায়েত মিয়ার বিয়ে হলে মানাবে ভালো।
সে নিজেও একজন সম্পন্ন গৃহস্থ, ক্ষেত খোলা আছে, আম কাঠালের বাগান আছে, গরু ছাগল কিছুর অভাব নেই। পাঁচ ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে বেলায়েতই সবার বড়।সংসারে তার কোন অভাব নেই।
কিছু দিন পর সে ঘটক পাঠায় সখিনাদের বাড়ী।সখিনার মা কিছুতেই রাজী হয়না। সখিনার দাদী সখিনাকে বোঝায়,
'রাজী হ সখিনার মা ,হ্যাগো অনেক জমি জমা সয় সম্পদ, তর ঝি অনেক সুখে থাকবো'।
শেষ পর্যন্ত অনেক ধর পাকড়ের পর সখিনার সাথে বেলায়েত মিয়ার বিয়ে হলো এক অগ্রহায়নে।
সুখের সংসার সখিনার। শশুড় শাশুড়ির আদরেই দিন কাটে।কাজ করতে হলেও তেমন কঠিন কিছু করা লাগে না।এমনিতে ভারী কাজের জন্য মুনিষ নেয়। তাছাড়া তার স্বামী আর ভাইয়েরাও অনেক পরিশ্রমী।
দুই বছরের মাথায় কোল আলো করে ছেলে আসে। শশুড় আদর করে নাম রাখে নজরুল ইসলাম। চাচা ফুপুদের কোলে কোলে নজরুল বড় হতে থাকে।
এরই মাঝে নজরুলের বাবা কেমন জানি দুর্বল হতে থাকে। সামান্য পরিশ্রমেই হাপিয়ে ওঠে। গৃহস্থালি কাজ পানি কাদা ঘাটতে হয়, একটুতেই কাশি আর ঘুস ঘুসে জ্বর আর সারা শরীরে ব্যাথা। ভয় পেয়ে যায় সখিনা।
শাশুড়িকে বলার পর উনি বললেন,
‘এইডা কুনো বেফার না, গিরস্তি কামে এমুন অইতো ফারে, আদা দিয়া গরম পানি খাওয়াও আর শইরলে রসুন আর সইরষার তেল গরম কইরা মালিশ করো, ভালা হইয়া যাইবো’।
সখিনা শাশুড়ির কথা মত তাই করে কিন্ত তাও কোন উপকার হয়না। এর মধ্যে তার আবার বাচ্চা পেটে। কি করে, কই যায় ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে ঊঠে সে।গ্রামের কবিরাজ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত উপজেলা ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায় অসুস্থ স্বামীকে। কিছুতেই কিছু হয়না। আস্তে আস্তে একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পরলো বছর খানেকের মধ্যে।এখন সে পুরাই পঙ্গু। শশুর মারা গেল।আস্তে আস্তে সোনার সংসার যেন ছাই হয়ে গেল।খাওয়া পরা আর ননদদের বিয়ে দিতে গিয়ে ক্ষেত খোলা গরু বাছুর সব শেষ।
এর মাঝে কন্যা সন্তানের মা হয়েছে সখিনা।তার সোনার বরণ গায়ের রঙ এখন কালি, চোখের পানিতে দিন কাটে তার। সে যেন সবার গলগ্রহ। বাবাও মারা গেছে। ভাইয়েরা বিয়ে করে ভিন্ন।মাকে নিয়েই ভাইদের ঠেলাঠেলি। সে সেখানে কোথায় উঠবে!
সখিনার দুঃখের দিন আর শেষ হয়না।চারিদিকে যেন ঘোর অন্ধকার।এমন সময় পাশের বাসার রাহেলা ঢাকায় কাজ করে সে দশ দিনের জন্য গ্রামে আসে।সখিনাকে সে খুব পছন্দ করতো। তার কথা শুনে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবী আমার লগে ঢাহা যাবি? সেই খানে কাম করবি”।
‘কাম করমু ?আমি শহরে গিয়া কি কাম করমু'! অবাক হয়ে যায় সখিনা?
“কেন আমার মত বাসা বাড়িতে কাম করবি”উত্তর দেয় রাহেলা।
‘তুই এইডা কি কস রাহেলা! এইডা কি কস! বাসা বাড়িতে কাম করমু আমি !মাইনষে কি কইবো ’!
বিস্ময়ের সাথে সাথে সখিনার গলাও যেন এক পর্দা উপরে চড়ে যায়।
‘মাইনষের কথা চিন্তা করলে তরে পুলাপাইন লইয়া না খাইয়া মরতে হইবো বুঝলি, মাইনষে কি তরে খাওয়াইবো না পরাইবো শুনি’?
অনেক ভাবনা চিন্তার পর এক দিন স্বামী সন্তানের হাত ধরে ঢাকায় এসে হাজির হয় সখিনা রাহেলার সাথে।
তারপর এক সংগ্রামের ইতিহাস। এখন সে ঢাকার অন্ধি সন্ধি সবই বুঝে। কি ভাবে কাজে ফাকি দিতে হয় ? কি ভাবে বিবিসাহেবদের সাথে টক্কর দিতে হয় এখন আর তাকে শিখাতে হয়না।প্রথম প্রথম কি পরিশ্রমই না করেছে তাদের মন যোগাতে। এখন এক বাসার কাজ ছাড়লে আরো দুটো এসে জুটে।
ছেলে মেয়েরা বড় হতে থাকে। ছেলে একটু বড় হলে ভ্যান গাড়ী চালানোর কাজ নেয়। এক বেলা চালায় এক বেলা বিশ্রাম। যা রোজগার করে তাদের কোনমতে দিন চলে যায়। মেয়েটাকে ছোট বেলায় ঠিকমত খেতে দিতে পারে নি।ভাতের ফ্যান আর শাক সিদ্ধ জুটতো তার মেয়ের কপালে।সেই যে রুগ্ন স্বাস্থ্য তা আর ভালো হলোনা।
এরই মাঝে সখিনা শুনলো তার নয়নের মনি নজরুল বিয়ে করেছে তাদের না জানিয়ে।তারপর আরো যেটা শুনে সে 'হাটফিল করলো' তা হলো বৌ নাকি তার ছেলের দ্বিগুন বয়সী। আরেকজনের কাছ থেকে তালাক নিয়ে ভালোবেসে তার নজরুলকে বিয়ে করেছে।লুকিয়ে বিয়ে করা মেনে নিলেও বউ এর বয়সটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা সখিনা ।
সেই বুড়ি বৌ আজ তাকে না জানিয়ে দেশের সব লোককে এজতেমায় দাওয়াত দিয়ে বসে আছে। রাগে গা কিড়মিড় করতে করতে ভাত বসালো। এই বৌতো তার সর্বনাশ করে ছাড়বে। রাতে ঠিকমত খেলোনা, ঘুমও আসছে না । ভোরের দিকে চোখটা লেগে এসেছে সে সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল ছেলে আর বউ এর চাপা গলার ঝগড়ায়।কি ব্যাপার কানটা খাড়া করে সখিনা।
‘তুই কি কস ! তর গারমেন ছুটি দিছে আর তুই কাইল বাপের বাড়ি যাবি? এত্তটি মানুষ দাওয়াত কইরা তুই মা এর ঘাড়ে সব ফালাইয়া দেশে যাবি! তুই এইডা কি কস’! চাপা রাগ আর বিস্ময় ঝরে পরে নজরুলের গলায়।
‘হ আমি যামু এতদিন পর ছুটি পাইছি, আমি দেশে যামু। আর আমি এত মাইন্সের রান্না করতে পারতাম না’।
“তয় যে তুই দেশে ফুন কইরা দুইদিন ধইরা কইলে,
'দাদু আইয়েন, দাদু আইয়েন আখেরি মোনাজাতে। কি কন ছুডু দাদু আইছে ভাটির দ্যাশ থেইক্কা? তয় তারেও লইয়া আইসেন',
আর এহন কস তুই বাড়িত যাবি।মায় তরে এই বাড়িতে আর জায়গা দিবোনা মনে রাখিস, আমিও তরে আনতে যামু না”।
সখিনার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।শাশুরী তার মেয়ের ঘরের দুই তিনটা নাতি নাতনী ছাড়া চলতে পারে না।তারাও আসবে, মোটের উপর আট দশজন মানুষ।সকালে উঠে নজরুলের বাবার প্রাতকালীন সব কাজ সেরে ভাত খাইয়ে কাজের বাসার দিকে দৌড় দিতে দিতে দেখে বউ বাপের বাড়ি যাবার জন্য কাপড় ভাজ করছে। কোন কথা না বলে কাজের বাসার দিকে রওনা দেয়।দেরী করে গেলে বেগম সাহেবে ক্যাট ক্যাট করে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিবে।
সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে দেখে বাসা ভর্তি গিজ গিজ করছে লোকজন।অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর সখিনা রান্নার জন্য এক চিলতে জায়গাটায় গিয়ে ঢোকে।
পরদিন
রাতে ভাত খেয়ে শাশুড়ি চৌকিতে বসে পান চিবাতে চিবাতে বলে উঠে, "বউ হুনো, মুনাজাতের দিন তুমি কিন্ত আমারে লইয়া এজতেমার মাঠে যাইবা"।
আর সহ্য হয়না সখিনার, তীক্ষ শ্লেষ মেশানো গলায় বলে উঠে ‘হ হ নিমুনে, আপ্নেগো লিগাতো মুনাজাতের মাঠে সুফা পাইত্তা রাখছে বেডারা’।
তার কথার ধারে শাশুড়ি হতবাক হয়ে যায়। মা এর পাশেই আধশোয়া পঙ্গু বেলায়েত মিয়া বউএর কথা শুনে উঠে বসার চেষ্টা করে আর বলতে থাকে।
“এইতা কি কইলে তুই নুজ্জুলের মা !আমার মায়োরে তুই এইতা কি কইলে”!
রাগ আর বিস্ময় ফুটে উঠে বেলায়েতের গলায় সখিনার স্পর্ধিত কন্ঠ শুনে।
খরখরে গলায় নজরুলের মাও উত্তর দেয়,
'ঠিকই কইছি। আমি তারে লইয়া এজতেমার মাঠে যামু এইডা কি কথা! মাইনষের ধাক্কাধাক্কি খাইতে! টিভিতে মূনাজাত দেখাইবো, বাড়িওলির বাসায় গিয়া হেইতা দেইক্ষা মুনাজাত ধরলেই হইবো'।
এবার শাশুড়ি বলে উঠে ‘এইতা কি কউ বউ! এইতা কি কইলা তুমি! টিভি দেইখা মুনাজাত করমু! এত দূর থিকা নাতি বউ দাওয়াত কইরা আনলো টিভি দেইখা মুনাজাত করনের লাইগ্গা’! বিস্ময় ঝড়ে পরে তার কন্ঠে।
'ঠিকই কইছি, যে দাওয়াত কইরা আনছে তারে কইন যে আপনেগো লইয়া যাইতে, আমার বাসার থিকা ছুটি দিবোনা' ।
"কুন অফিসারের ফুষ্টে চাকরী করছ তুই যে হ্যারা তরে একদিন ছুটি দিবোনা শুনি"? কাশির দমকে আটকে আসা গলায় বেলায়েত মিয়ার চোখে মুখে রাগ আর ক্ষোভ এক সাথে ফুটে উঠে।
সখিনা চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো ছোট থেকে বড় সবাই কেমন ধিক্কারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘাড়টা আস্তে আস্তে নীচু হয়ে আসে।চৌকির তলা থেকে বের করে রান্নার সরঞ্জাম, চাল ডালের কৌটা, আলু, পেয়া্জ, মশল্লা সব কিছু। চৌদ্দজন মানুষের রান্না করতে হবে তাকে।বেচে থাকলে সখিনা আজ দাদীকে জিজ্ঞেস করতো 'দাদী সুখের পাখিটা কই' ?
ছাদের কোনায় রান্নার জায়গায় বসে চাল ভরা হাড়িটা হাতে তুলে নেয়।জোরে জোরে কচলে চাল ধুতে থাকে এক হাতে। টপ টপ করে ঝরে পরা ক্ষোভ, দুঃখ আর তিক্ততা মেশানো চোখের পানিতে নাকি তিন তলা পর্যন্ত টেনে আনা ভরা বালতির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে সেই মোটা মোটা কাঁকর মেশানো লাল চাল বুঝে উঠতে পারে না সখিনা ।