অপরূপা নদী বাঁকখালী
রাজধানী ঢাকায় বের হয়েই আমরা যখন কোন বাঁধার সন্মুখীন হই তখনই বলে উঠি ‘নাহ, এদেশে আর থাকা গেল না’।
ঢাকার বাইরে গেলেও যখন কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে পড়ি তখনও বলি, ‘ যত শীঘ্রি পারা যায় এদেশের পাঠ চুকাতে হবে'।
রাস্তায় ধুলা, নোংরা- আবর্জনা দেখলে নাক সিটকে বলে উঠি, ‘ছি ছি এখানে মানুষ বাস করে কি করে! এত নোংরা-ময়লা অপরিচ্ছন্ন দেশ মনে হয় সারা ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই'।
হায়রে আমার মন মাতানো দেশ
কিন্ত না আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি যে কত অপরূপ, কত যে সুন্দর, কত মায়াময় তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার কথা নয়।
আজ আপনাদের চোখে তুলে ধরতে চেষ্টা করবো এমনি মন মাতানো সৌন্দর্য্যময় এক স্থান যার নামের সাথে অনেকেই পরিচিত হলেও এর রূপের সাথে পরিচিতি আছে কি না আমি জানি না।
নাম তার মহেশখালী দ্বীপ। অনেকের অনেক পরিচিত অনেকবার ঘুরে আসা সৈকতরানী কক্সবাজারের এক উপজেলা।
মহেশখালী উপজেলা পরিষদ
বহুবার কক্সবাজার গেলেও মহেশখালী যাওয়া হয়ে উঠেনি শুধুমাত্র আমার পানি ভীতির কারনে। সাতার জানি না আমি ।সে অনেক বছর আগের কথা। প্রথমবার যখন কক্সবাজার গিয়েছিলাম তখনই শুনেছিলাম নদী পেরিয়ে সাগর ছুয়ে ট্রলারে করে দুরন্ত ঢেউ এর সাগর পাড়ি দিয়ে নাকি মহেশখালী যেতে হয়।সুতরাং সেখানে আর যাওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কখনো।
মহেশখালীর পথে
এবার ছেলের পড়াশোনার কাজে সেন্ট মার্টিন যাবার পরিকল্পনা নিয়ে উড়ে এসে কক্সবাজার হাজির হোলাম।রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য সেই নিঝুম পর্যটকবিহীন কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাবার সমস্ত পরিবহন বন্ধ।তখন অনেক ভেবে চিন্তে প্রফেসরের সাথে মেইল এর মাধ্যামে আলাপ আলোচনার পর সেন্ট মার্টিনের বদলে মহেশখালীর যাওয়া ঠিক হলো।কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে আসতে কোন সমস্যা ছিলনা।
যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেছে স্পীডবোট কক্সবাজারে দিকে
পাশের হোটেলের এক প্রৌঢ় গার্ডের তথ্য আমাদের মহেশখালী যাওয়ার সিদ্ধান্তকে আরো পাকাপোক্ত করলো। একদা সেও ছিল মাছ ধরা এক ট্রলার মালিক এবং হাজার বার মহেশখালী যাওয়া আসা এক মানুষ। সে আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে ভরসা দিল,
‘ভয় নাই আন্টি, এখন শীতকাল, ঢেউও নেই খুব একটা, স্পীড বোটে যাবেন, পনেরো কি বিশ মিনিটের মত লাগবে, চোখের পলক পড়ার আগেই পৌছে যাবেন, তাছাড়া সামান্যই একটু পানি পথ’, বলে দু আংগুল সামান্য ফাঁক করে পানিপথের পরিমাপটা বুঝিয়ে দিল।
সাগর সঙ্গমে
আমার স্বামী আমার চেহারা দেখে ভাবছিল কি করা যায়? তাদের তো যেতেই হবে, এখন আমি যাবো কি না? সেই গার্ডের কথায় আর একা একা সারাদিন হোটেলে থাকার কথা ভেবে সাহস আনলাম মনে, রাজী হোলাম, যাবো মহেশখালী। মায়ের মন পরাভূত হলো নিজের ভয়ের কাছে।
৬নংফিশারী ঘাটে ভীড় করে আছে সমস্ত জল পরিবহন
পরদিন সকাল নটায় ৭০ টাকা ভাড়ায় ব্যাটারির অটোতে করে বাঁকখালী নদীর তীরে ৬নং ফিশারি ঘাটে আসলাম।সেই ঘাটে প্রবেশ ফি মাথা পিছু ৩ টাকা। তখন ভাটা চলছে, পানি নেমে গেছে অনেকখানি। জেটি দিয়ে স্পীড বোটে ওঠা যাবেনা, তাই বিকল্প হিসেবে একটা পর একটা নৌকা দড়ি দিয়ে বেঁধে সেতু বানানো হয়েছে।
ভাটায় পানি নেমে গেছে, তাই এই নৌকার সেতু
সামনে অনেকগুলো স্পীড বোট,যাত্রী ও মাছ ধরা ট্রলার, নৌকা ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। এক একটি স্পীড বোটে ১২ জন যাত্রী হলেই ছেড়ে দিচ্ছে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে।আমরা সেই দুলে উঠা নৌকার ব্রিজ পার হয়ে এগুতেই একটা বোট ছেড়ে গেল।
এই বোটে আমাদের স্থান হয়নি
পরের সিরিয়ালের মাঝি ডেকে উঠলো ' আসেন, আসেন, আছে,আছে স্থান'।
আমরা তিনজন গিয়ে সেই বোটে উঠে বসে পড়লাম ।মাথাপিছু ৭৫ টাকা ভাড়া। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই ১২ জন যাত্রী হয়ে গেল আর আমাদের চালক ছেড়ে দিল ইঞ্জিন।ঘাটের আশে পাশে নোঙ্গর করা মাছ ধরা ট্রলার আর যাত্রী বাহী নৌকাগুলোকে এদিক ওদিক করে কাটিয়ে পুরো গতি নিয়ে ছুটলো আমাদের স্পীডবোট মহেশখালীর উদ্দেশ্যে।
সবাইকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা
মিনিট কয়েক পরেই চোখের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো সব নৌকা ট্রলারকে পিছু ফেলে আমরা খোলা নদীতে হাজির। সেই পথের সৌন্দর্য্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।কোথায় গেল আমার ভয় ভীতি কোথায় ডুবে মরার চিন্তা? আমি শুধু ভাবছি এই কি আমার দেশ!এত সুন্দর!
নোঙর করে আছে মাছ ধরা ট্রলারের সারি
আশ পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে দু একটা ট্রলার বা স্পিড বোট। তাদের ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের স্পীড বোট কিছুটা ওপরে উঠে আবার আছড়ে পরছে স্বচ্ছ কাচের মত পানিতে।দুদিকে ছিটকে উঠা ফেনীল জলরাশিতে সুর্য্যের আলো পড়ে ছোট ছোট্ট রংধনু্ তৈরী হয়েই মুহুর্তেই ভেঙ্গে একাকার হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
তীব্র গতির ফলে জলকনা ছিটকে উঠছে দুদিকে
আমরা তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছি আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।তখন মনে হচ্ছিল এমন করে যদি দূরে আরো দূরে উড়ে যেতে পারতাম।বাংলা মাস অগ্রহায়নের শেষ, পৌষ আসি আসি করছে। আকাশে সুর্য্য ঝক ঝক করলেও তেমন তাপ ছিল না।নদী থেকে উঠে আসা হাল্কা ঠান্ডা বাতাস সবার গায়ে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল ।
সামনেই ভীড় শেষ, আসছে খোলা নদী,সমুদ্র আর আকাশ
খানিকটা দূরে আকাশ পটে অনেকগুলো সীগাল।বিশেষ করে জেলে নৌকার আশে পাশে মাছের আশায় তাদের দুগ্ধ ধবল ডানা দুদিকে ছড়িয়ে উড়ছে, যাতে রয়েছে ছাই রঙ এর ছোঁয়া।আবার কখনো ঝুপ করে পানির উপর বসে ভেসে বেড়াচ্ছে ঠিক যেন এক ঝাঁক রাজহাঁস।
অদুরে পানিতে ভেসে থাকা সীগালের ঝাঁক
নদীর এক পারে নারকেল, সুপাড়ি আর কেওড়া গাছের ফাঁকে একাকী এক কৃষ্ণচূড়া আগুন ঝড়িয়ে যাচ্ছে। কি অপার্থিব সেই দৃশ্য।
পার হয়ে যাচ্ছি সেই মোহনা যেখানে বাঁকখালী আর মহেশখালীর পুর্ব দিক ঘেষে নেমে আসা নদী মহেশখালী এসে মিলেছে সাগরে।এখানে বেশ ঢেউ তবে সবার নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় দূর হলো।
সাগর মোহনায় মিলেছে দুই নদী তাই এত আবেগের ঢেউ
আমরা তিনজন মুগ্ধ নয়নে বাংলার সেই অপার সৌন্দর্য্যে অবগাহন করছি।বাকী যাত্রীরা চুপচাপ, তারা ছিল স্থানীয় জনগন।নিত্য নৈমিত্তিক এই দৃশ্য তাদের ভেতর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি।
মহেশখালী থেকে ছেড়ে আসা ট্রলার আর স্পীড বোট এখুনি ঢেউ তুলে পাশ কাটিয়ে যাবে
আমার ছেলে অবিরাম ছবি তুলে যাচ্ছিল। আমিও তুলছিলাম কখনো আমার ক্যানন ক্যামেরায় কখনো বা মোবাইলে যখন যেটা হাতের কাছে পাচ্ছিলাম।মোহনা ছাড়িয়ে অবশেষে মহেশখালী নদীতে প্রবেশ।দুটি নদীই অসম্ভব স্রোতস্বীনি।সাগর বক্ষে ঝাপিয়ে পড়ার অপেক্ষার পালা যেন তাদের শেষ হয়েছে।
সবুজ গাছে ছেয়ে থাকা তীর
তাকিয়ে দেখি দু দিকে রয়েছে বন বিভাগের লাগানো সবুজ কেওড়া গাছের সারি। তারা তাদের অসংখ্য শিকড় দিয়ে মাটি কামড়ে ধরে ঠেকিয়ে রাখছে অবিরাম তীব্র ঢেউয়ের ধাক্কা থেকে তীরভুমির ভাঙ্গনকে।
আটটি ইউনিয়ন নিয়ে কক্সবাজারের এই উপজেলা মহেশখালী নামকরণের পেছনেও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য কারনটি হলো এখানে রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় একটি তীর্থস্থান আদিনাথ মন্দির।যা আমরা দেখার সময় পাইনি।
না দেখা আদিনাথ মন্দিরের এই ছবিটি নেট থেকে নেয়া
এই মন্দিরে পুজিত হন হিন্দু দেবতা শিব যার অপর নাম মহেশ।এই মহেশ থেকেই মহেশখালী।আবার কারো কারো মতে সেখানে একসময় প্রচুর মহিশ ছিল আর তার থেকেই এই নাম।যাই হোক, যাই থাকুক সেই ইতিহাস সে আর এখন আমাকে চিন্তা করার অবসর দিচ্ছে না।আমরা ছুটে চলেছি অপুর্ব নীল জলের বুক কেটে সেই অজানা দ্বীপ এর দিকে।
অদুরে মহেশখালী জেটি
এবার বেশ কিছুটা দূরে দেখা গেল মহেশখালীর জেটি।আস্তে আস্তে স্পীডবোট চালিয়ে দক্ষতার সাথে জেটিতে ভিড়ালো চালক।নেমে আসলাম সেই দ্বীপ যা আমি কখনো আমার ভ্রমন তালিকায় যুক্ত করার কথা চিন্তাও করিনি।
এক পর্বে শেষ করতে না পারার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত।
দ্বীতিয় পর্ব
Click This Link