২০ শে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ২১ শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে নানান রকম অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। হঠাৎ হাফিজ ভাইয়ের ডায়েরীটার কথা মনে পড়লো। উনিও তো এসময়ের কথা কিছু কিছু লিখেছিলেন । বুক শেলফ থেকে ডায়রীটি নিয়ে বসলাম। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়লো তার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন ঘটনার কিছু বিচ্ছিন্ন বর্ননা। যদিও শিরোনামের সাথে এর কোনো মিল নেই তথাপি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তা উল্লেখ করছি।
তিনি লিখেছেন :
'পঁচিশে মার্চের রাতের পর কিছুদিনের জন্য আমরা একটু হতবিহ্ব্বল হয়ে পড়ি। যে যেখানে পেরেছিলাম লুকিয়েছিলাম, তখন আমাদের কি ই বা বয়স।সে সময় আমি ও চলে গেলাম পার্শবর্তী এক গ্রামে জনবিচ্ছিন্ন এলাকায়।
এখনও মনে আছে যে বৃদ্ধ গোয়ালাটি যাকে আমরা দাদা ডাকতাম তার বাসায় গিয়েই আশ্রয় নিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় তিনি ফিরে এসে বল্লেন, " সব দেশের রাজা উথান্ট (তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব) আমাগো সাপোর্ট করছে, এই বার দ্যাশটা স্বাধীন হইবোই'।
শহরের কোনো দোকান থেকে সে বিবিসি শুনে এসেছিল বলে ধারণা করছি।
মনে আছে ২৬ মার্চ সকালে দেখেছিলাম আমাদের বাসার আশ পাশ দিয়ে রাজার বাগ থেকে সারারাত ধরে অসম যুদ্ধে ক্লান্ত পিছু হটা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের গ্রামের দিকে চলে যাওয়া।বেশীর ভাগের পরনেই উর্দী ছিলনা। কারো কারো মুখে ভারী অশ্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর ভয়াবহ মর্টার আর ট্যান্কের গোলার আক্রমনের কাহিনী শুনে আমরা আৎকে উঠেছিলাম। শুধুমাত্র সামান্য রাইফেল থ্রি নট থ্রি দিয়ে সারারাত পুলিশ বাহীনি আটকে রেখেছিল পাক সৈন্যদের ।
এরপর মাস খানেকের মধ্যে আমাদের সঙ্গী সাথীদের সাথে আবার যোগাযোগ হয়।এর মধ্যে কয়েকজন ভারতে চলে গিয়েছিল।এর মধ্যে আমার পরিচিত র মধ্যে ছিল বাকী, শফিক, শহীদ , ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল। আমি আমার বাবার কারণে দুবার চেষ্টা করেও মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি।পারিনি তার ছলছল চোখের আকুতি ঠেলে।যে আক্ষেপ আমাকে এখোনো কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।আমার মত আরো অনেক বন্ধুরাই যেতে পারেনি নানা কারনে।
দু তিন মাসের মধ্যে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে আবার যোগাযোগ হলো ।তাদের মধ্যে ছিল ইউনিট কমান্ডার শহীদ আবদুল্লাহ হেল বাকী অন্যতম।বাকী আমাদের থেকে বয়সে কিছুটা বড় হলেও আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম এবং ছিলাম আমাদের গঠন করা পল্লীমা ক্লাবের সদস্য । বাকী সহ আরো কয়েকজন বন্ধু ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে ঢাকার অদুরে কায়েতপাড়ায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্হাপন করেছিল।সেখান থেকে তারা ঢাকা বা তার আশে পাশে অপারেশন চালাতো।
আমি,ও আমার বন্ধু আবদুল হক, মোস্তাক এবং আরো কয়েক জন দু দুবার গিয়েছিলাম সেই ক্যাম্পে । কিন্ত আমাদের কোনো প্রশিক্ষন না থাকায় বাকী আমাদের কোনো অপারেশনে পাঠায়নি।কিন্ত নিয়তির কি পরিহাস দেরাদুন থেকে কমান্ডো প্রশিক্ষন প্রাপ্ত বাকীই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্ব মুহুর্তে অর্থাৎ ৪ঠা ডিসেম্বর পাক হানদার বাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন ঢাকার খিঁলগায়ে।
স্বাধীনতার সেই উষালগ্নে শহীদ বাকীর সাথে আমার পরিচিত আরো দুজনের মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল,তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং জহির রায়হান'।
হাফিজ ভাইয়ের ডায়েরীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা আর বিশেষ কিছু পেলাম না। শুধু বিক্ষিপ্তভাবে তার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে না পারার বেদনার টুকরো টুকরো কিছু কথা।
এর পর তিনি লিখেছেন স্বাধীনতা পরমুহুর্তের সময়গুলোর কথা।সেখানে উল্লেখ করেছেন:
'১৬ ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার চুড়ান্ত বিজয়ের দিন থেকে আমাদের মনের যে আবেগ, উচ্ছাস, আনন্দ, অনুভূতি যা পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।সেই সাথে শেষ মুহুর্তে বাকীকে হারানোর বেদনাও আমরা অন্তর দিয়ে অনুভব করছিলাম তীব্র ভাবে।
আসলে সে সময় জনতা যেনো এই স্বাধীন দেশে পরস্পরের সাথে এক নিবিড় আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরেছিল। ৭১ এর ডিসেম্বরের শেষ দিকের কোনো এক সকালে খবর আসলো টাংগাইলে এক সংগঠন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান এবং গন সংগীতের আসর। অনুষ্ঠানটি সেদিন বিকেলেই অনুষ্ঠিত হবে। আমরা গনশিল্পী গোষ্ঠীর দশ বারো জন তখনই একত্রিত হয়ে গেলাম, কিন্ত যাবো কি ভাবে
টাংগাইলে যাবার পথে যে আঠারো টি ব্রিজ পড়ে তার সবগুলোই তো পাক বাহিনী ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।হঠাৎ নজরে পড়লো ক্লাবের পাশেই একটি হুইলি জীপ দাড়ানো।পাশে দাড়ানো ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম গাড়িটি কার ? সে সবিনয় উত্তর দিল গাড়িটি তৎকালীন জুট মিল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আউয়াল সাহেবের।
আমরা উনার অনুমতি নেয়ার জন্য গাড়িটি সহ মতিঝিলে তার অফিসে গেলাম।কি অমায়িক ভদ্রলোক। তার ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ। আমরা তো তাকে না জানিয়েই গাড়িটি নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্ত তার অনুমতি চাওয়াতে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন যখন শুনলেন আমরা বীর মুক্তযোদ্ধা কাদের সিদ্দীকির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করার জন্য তার গাড়িটি চাইছি। এ কথা শোনার সাথে সাথে তিনি গাড়ি তো দিলেনই সেই সাথে ড্রাইভার এবং পেট্রোল ও দিয়েছিলেন।অবশ্য ড্রাইভারকে আমরা পরে আর সাথে নেইনি পরদিন সেই জায়গাতেই গাড়ি ফেরৎ দেবো বলে প্রতিশ্রুতি দেই।
তারপর সেই ভাঙ্গা আঠারোটা ব্রিজের উপর দিয়ে টাংগাইল যাওয়া সে এক ভয়ংকর এ্যডভেন্চার। আমরা যথারীতি ঠিক বিকাল চারটায় গিয়ে পৌছালাম অনুস্ঠানস্থলে। টাংগাইলের বিখ্যাত বিন্দুবাসীনি গার্লস স্কুলের মাঠের সে অনুষ্ঠানে বংগবীর কাদের সিদ্দীকি যুদ্ধের পোশাকেই এসেছিলেন। তিনি আমাদের প্রতিটি গানই মনযোগ দিয়ে শুনে এর ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে সে রাতেই আমরা ঢাকায় ফিরে আসি এবং পরদিন সকালে আমরা নিজে গিয়ে আউয়াল সাহেব কে গাড়িটি ফেরৎ দিলে তিনি অবাক হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে তার অপরিসীম শ্রদ্ধা তা দেখে আমরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি আর উনি ও আমাদের সততায় অভিভূত হয়ে পড়েন '।
হাফিজ ভাইয়ের ডায়রীর আরেক পাতায় লেখা আছে ১৯৭২ সালের স্বাধীন বাংলার প্রথম একুশে উযাপনের কাহিনী। তিনি লিখেছেন : '৭২ এর এই একুশে ফেব্রুয়ারী যেনো এক নতুন ব্যান্জনা এবং নতুন অনুভূতি নিয়ে এসেছিল সকলের কাছে।এ যেন ছিল এক বিজয়ের একুশ।এই একুশ পালনের প্রস্ততি ছিল যেনো এক ভিন্ন মাত্রার।
ট্রাক নিয়ে বিশে ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে গান গেয়ে ঠিক রাত দশটায় আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হই।সে বারই প্রথম শহীদ মিনারের মধ্যে সূর্যটি সংযোযিত হয়েছিল। সাদা মিনারের ভেতর সেই লাল টকটকে সূর্যটি ফ্লাড লাইটের উজ্জল আলোয় কি যে এক আবহ সৃস্টি করেছিল তা চোখে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সেটা ছিল তখন বাইরের দিকে যা বর্তমানে পেছন থেকে সংযুক্ত করা।
সেখানে যে সমস্ত গানগুলো আমরা গেয়েছিলাম তার মধ্যে অনেক গুলো আগেই উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া আরো যে গান গেয়েছিলাম তার মধ্যে ব্যাতিক্রমী ছিল :
(১)বিপ্লবেরই রক্তা রাঙ্গা ঝান্ডা উড়ে আকাশে
(২) শীতল পৃথিবী অবশ নগর
(৩) অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি!
(৪) বিচারপতি তোমার বিচার করবে আজ জেগেছে এই জনতা।
রাত ঠিক বারোটায় শহীদ মিনারে আমাদের ফাংশন শুরু হয়। অগনিত জনতা ট্রাকের চারপাশে ঘিরে আমাদের গান শুনছিল আর বিরামহীন করতালির মধ্যে আমাদের উৎসাহিত করছিল।
এরপর আমরা বাংলাদেশ বেতারের উদ্দশ্যে ট্রাকে করে রওনা দেই। আমাদের অনুষ্ঠান ছিল রাত সাড়ে তিনটায় যা বাংলাদেশ বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।এই অনুষ্ঠানটি প্রচারে সহযোগিতা করেছিলেন জনাব কামাল লোহানী।গন শিল্পী গোষ্ঠীর সবকটি আগুনঝরা গানই আমরা সেই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম।
এরপরের ঘটনাটি ছিল অনাকাঙ্খিত।
মেয়ে শীল্পি যেমন আবিদা সুলতানার ছোট বোন সালমা সুলতানা শীলা, রুলিয়া রহমান, হাসনা সহ আরো অনেকে ছিল আমাদের গন শিল্পী গোস্ঠিতে। বেতারের অনুষ্ঠান শেষে মনুদা সিদ্ধান্ত নিলেন তাদেরকে ট্রাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আমরা পল্টনে যাবো। সেখান থেকে আমরা পল্টনের শহীদ মানিক স্মৃতি সংসদের প্রভাত ফেরীতে অংশগ্রহন করবো।
এখানে উল্লেখ্য আমাদের ক্লাবের জুনিয়র গ্রুপ পুলিশের একটি জীপ নিয়ে সব সময় আমাদের পেছনেই ছিল। জীপটি চালাচ্ছিল আমাদের পাড়ার এক পুলিশ অফিসারের ছেলে, সে ক্লাবের ই সদস্য। সে তার বাবাকে না জানিয়েই জীপটি নিয়ে গিয়েছিল।আমরা তাদের কে বল্লাম আমাদের কে পল্টনে নামিয়ে দেয়ার জন্য।
পেছনে আমরা বন্ধুরা বসেছিলাম আমি সহ, ফকির আলমগীর, মনুদা , খসরু, জাহাংগীর, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সালাউদ্দিন পান্না, নাসিম ও প্রখ্যাত অর্থনিতীবিদ আনু মোহাম্মদের বড় ভাই আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাফিজুর রহমান ময়না, রুমি ।আর জীপের সামনে ছিল জুনিয়র গ্রুপের ছয় সাত জন।
আমাদের বোঝাই হওয়া জীপটি শাহবাগ মোড় ঘুরে ঢাকা ক্লাবের সামনে রাস্তার বাঁকটিতে খুব দ্রুত গতিতে পাড় হচ্ছিলাম। হঠাৎ অনূভব করলাম জীপটি উল্টে যাচ্ছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন দেখি আমি জীপের বাইরে হামাগুড়িরত অবস্থায়।বাকি সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আমি হাত পা নেড়ে দেখলাম কোনো জখম বা আঘাত পেয়েছি কি না , নাহ একটি আচড় ও লাগেনি।গায়ে শুধু ধুলো আর বালি।
পরে জেনেছি ৫/৬ জনের হাড় গোড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। সাথে সাথে কে একজন দৌড়ে গিয়ে তখনও থেমে ট্রাক টা নিয়ে আসলো। আহতদের নিয়ে আমরা ঢাকা মেডিকেলে রওনা দিলাম। প্রভাত ফেরীতে আর যাওয়া হলোনা'।
আজকে যখন টিভি তে ভাষা সৈনিকদের সাক্ষাৎকার দেখি তখন মনে হয় ছেলে হারা মায়ের অশ্রু এখন ভাষা এবং স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের আক্ষেপের অশ্রুতে পরিনত হয়েছে। কারণ তারা হয়তো অনেক কিছু ই পেয়েছেন, কিন্ত আক্ষেপ টা হলো তারা যা চান নি তাও পাচ্ছেন যেমনঃ সেই নির্যাতন, অপঘাত মৃত্যু, দুর্নীতি, অনাচার আর সর্বোপরি বাংলা ভাষার লান্ছনা'।
হাফিজ ভাইয়ের ডায়েরীর থেকে উল্লেখযোগ্য অংশটুকু আমি এখানেই শেষ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৯