ইতালীর রাজধানী রোমের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা ভিক্টরীয় ইমানুয়েল।বলা যায় রোম শহরের হৃদপিন্ড। তারপাশেই এই নামে রোমের বিখ্যাত মেট্রো ষ্টেশন। এ জায়গার ঠিক মাঝখানে লোহার রেলিং ঘেরা গাছ পালায় ছাওয়া ছোট্ট একটা গোল পার্ক আছে যার চারিদিকে ঘোরানো ফুটপাথ। পার্কের নীচ দিয়ে মেট্রোলাইন, উপরে বাস লাইন, ট্রাম লাইন এবং সর্বোপরি অদুরেই ইতালীর প্রধান রেলওয়ে ষ্টেশন রোমা টারমিনি। চারদিক থেকে রাস্তা এসে এই গোল চত্বর ঘেরা রাস্তায় মিলেছে।
এই গোল পার্কের চারিদিকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাবু বা সামিয়ানা খাটিয়ে অস্থায়ী বাজার বসে। দুপুরের পর ঝকঝকে পরিস্কার ফুটপাথটি তে গেলে কেউ বিশ্বাস করবেনা এখানে একটা বাজার বসেছিল সকাল থেকে ।এই বাজারে সব পাওয়া যায়, যেমন মাছ, মাংস, টাটকা শাক সব্জী, রান্নার হাড়ি কুড়ি থেকে জুতা, ব্যাগ, কাপড় চোপড় ঘর সাজানোর জিনিস কি নেই !
এখানে সব দোকানের মালিকই ইতালীয়ান। আফ্রিকান আর এশিয়ান সেলসম্যানরা সেখানে অমানুষিক পরিশ্রম করছে মালিকের মন জুগিয়ে যাবার জন্য। মন্দার বাজারে এই চাকুরীটাই যে কত আরাধ্য যাদের ধারণা নেই তারা কল্পনাও করতে পারবেনা।
দালালকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে পারি দিয়ে আসা স্বপ্নের বিদেশ। মালিকরা দোকানে চেয়ার পেতে বসে আছে আর সেলসম্যানরা ফুটপাথে দাড়িয়ে প্রানপনে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায় ব্যাস্ত।
আমিও তেমন এক ইতালীয় মালিকের পুরোনো কাপড় বিক্রীর দোকানের কর্মচারী। আমার নাম মাইকেল। সুদুর আফ্রিকার আইভোরী কোষ্ট আমার দেশ। আমি পুরোনো স্যুট প্যান্ট বিক্রী করছি। ওগুলোর ছোটো খাটো ফুটোগুলো নিপুন হাতে রিপু করা, সাধারন চোখে দেখা যায়না। অত্যন্ত কৌশলে রেখে ঢেকে ক্রেতাদের দেখাই। ওটা দেখলেই দাম কমে যায়।
আর যত বিক্রী করতে পারবো ততই এই অনিশ্চিত জীবনে কাজে টিকে থাকার নিশ্চয়তা। তবে আমার ক্রেতা সাধারণত নিম্নবিত্তরাই। তারাও জানে এতে ছেড়া ফাটা আছেই।
বড় লোকদের জন্য তো চারিদিকে নিওন আলোয় সজ্জিত আলো ঝলমলে ইতালীর বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডেড দোকান। যেখানে বিভিন্ন দেশের ধনীরা এসে একগাদা ইউরো খরচ করে এক লহমায় কিনে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই যেটা তাদের চোখে পড়ছে, যেটা ভালোলাগছে।
তারপর দু একদিন পরার পর জীবনে হয়তো ছুয়ে ও দেখলোনা।শেষ পর্যন্ত হাত ঘুরে আমাদের কাছে চলে আসছে। বড়লোকের দামী ওয়ার্ডড্রোবে কিছুদিন বসবাস করে এরপর ঠাই হচ্ছে গরীবের ভাঙ্গা আলমারীতে।
আমি এই পার্কের পাশেই ইতালীয়ান এক মেয়ের সাথে থাকি।ওর নাম লিসি। বেশ বড় ফ্ল্যাটটি লিসির নিজের, এছাড়াও সে অনেক ভালো একটি চাকরীও করে।
আজ দুদিন হলো লিসির এক এশিয়ান সহকর্মী সস্ত্রীক তার একটি রুম ভাড়া নিয়েছে একমাসের জন্য। প্রথম দিন যখন জানালাটা খুলতে পারছিল না ওরা, তখন লিসি ও চেষ্টা করার পর বলতে শুনলাম, 'দাড়াও আমার স্বামীকে ডাকি'।
আমাকে দেখে ওরা একটু চমকেই গেল। ফর্সা, সোনালী চুলের স্লিম একটি শেতাঙ্গ মহিলার স্বামী হিসেবে সাত ফুটের উপর লম্বা, মেদহীন, কুচকুচে কালো গায়ের রং, মাথায় চুলগুলো ক্লিন শেভ করা আমি এক আফ্রিকান। কিন্ত খুব ভদ্র পরিবারটি মুহুর্তের মধ্যে তাদের সামলে নিল। কি সুন্দর করেই না আমাকে ধন্যবাদ জানালো ।
লিসি পরিচয় করিয়ে দিল তাদের সাথে, মেয়েটির নাম রুনা। রুনার স্বামী এক মাসের জন্য অফিসের কাজে রোম এসেছে, বউকে নিয়ে এসেছে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। বউটা তার ঘুরতে খুব পছন্দ করে বলে হাসলো ভদ্রলোক।
সকালে উঠে লিসি আর রুনার স্বামী অফিসে চলে যেত, আর দশটা বাজলেই রুনাকে দেখতাম চুল গুলো আচড়ে কাপড়টা ঠিক করে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে।
আমি একদিন বল্লাম, 'কই যাও তুমি প্রতিদিন সকালে পাগলের মত দৌড়ে কয়েক মিনিটের জন্য' !
ও মিষ্টি হেসে জানালো,' আমার ছেলেকে ফোন করতে'।
কিন্ত তার সেই হাসির আড়ালে একটা কষ্ট সে লুকিয়ে রাখার প্রানপন চেষ্টা করতো, যেমন আমি ছেড়া কোটের রিফুগুলো লুকোই। এই কারনেই আমার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে রুনা জানতোনা আমি কি কাজ করি। তাকে বলেছি আমি একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
আমি কাজে চলে গেলে সেও বের হয়ে পাশেই বাজার থেকে কেনা কাটা আর সেখানে কাজকর্মে রত তার দেশী ভাইদের সাথে আলাপ সালাপ করে বাসায় ফিরে রান্না বান্না শুরু করতো। আমাদের কিচেনটা ছিল কমন।
আমি সেদিন ডাইনিং টেবিলে বসে কফি খাচ্ছিলাম, রুনা রান্না করছে, ওকে একটু জুস ঢেলে দিলাম গ্লাসে।
এর আগে একদিন আমি বিয়ার খাচ্ছিলাম ওকেও একটু রেড ওয়াইন ঢেলে দিয়েছিলাম। সে অপ্রস্তত হয়ে জানালো সে কোনো রকম ড্রিন্ক করেনা। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম।
রুনা সেদিন কি যেনো রান্না করছিল। দেখলাম টমেটো দিচ্ছে সাথে একটা সবুজ পাতা কুচি কুচি করেও দিল । ভারী সুন্দর একটা গন্ধ বের হয়েছে।
'কি রান্না করছো এটা রুনা, আর ঐ পাতাটা কি দিলে' ?
বল্লো এটাকে নাকি ডাল বলে, আর পাতাটা নাকি ধনে পাতা সুগন্ধীর জন্য ।
কি জানি হবে হয়তো।
আমি চারটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারি। ইংরাজী, ফরাসী, ইতালীয়ান আর আমাদের নিজস্ব ভাষা তো আছেই। তবে রুনার সাথে আমি ইংরেজীতেই কথা বলতাম। কারন বাকী তিনটা ভাষার কোনোটাই সে জানতো না।
কথা শুরু করলেই সে বেশীরভাগ সময় তার ছেলের গল্পই করতো। সে নাকি কোনোদিনও তার ছেলেকে এক মুহুর্তের জন্যও কাছ ছাড়া করেনি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অনেক ভালো বেতন আর সন্মানের চাকরী ও সে ছেড়ে দিয়েছে ছেলের জন্য। ইতালিয়ান এ্যম্বেসী তার ছেলেকে ভিসা দেয়নি। মনে করেছে ওরা আর ফিরে যাবেনা। ওর স্বামীর অফিস থেকে একটা নোট ভার্বাল জমা দিলেই এ সমস্যা হতোনা। কিন্ত যখন জানলো তখন আর সময় ছিলনা।
সন্ধ্যায় স্বামী ফিরে আসলে আবার দুজন মিলে ফোনে কথা বলতো।
আমি একদিন বল্লাম 'তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেনো ? কার কাছে রেখে এসেছো তোমার ছেলেকে'?
রুনা বল্লো তার বাবা মার কাছে। শুনে আমি খুব অবাক হোলাম।
'ভালোইতো আছে, তোমার বাবা মা দেখাশোনা করছে, আর আমি তো আমার ছেলেকে একা রেখে এসেছি'।
শুনে রুনা ভারী অবাক হয়ে গেল! বল্লো ' তোমার ছেলে'!
"হু ছেলে"।
'কত টুকু'?
'বারো বছরের'।
'আশ্চর্য্য! , তোমাকে দেখে তো মনেই হয়না তোমার এত বড় ছেলে আছে'!
'কি করে মনে হবে বলো!, আমিতো কুড়ি বছরেই বাবা হয়েছি। অবশ্য তার মা কে আমি বিয়ে করিনি।এখন সে আরেক জনকে বিয়ে করেছে'।
রুনা আমাদের এসব সামাজিক প্রথা সম্পর্কে জানলেও সামনা সামনি শুনে কেমন যেন হয়ে গেল। তারপর ও আমার বাচ্চাটার জন্য কেমন মায়া ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে।
জানতে চাইলো কার কাছে আছে সে?
বল্লাম আমাদের যৌথ পরিবারের সাথেই আছে।
আমার তখন মনে হলো আমার বাবার বারোটি স্ত্রীর তিন নং ঘরের সন্তান আমি। আমাদের জন্ম দিয়েই আমার বাবার দায়িত্ব শেষ। কোনো সন্তানের কোনো খোজই সে নেয়না কখনও। অবশ্য আমি ও জানিনা আমার বাবার ঔরসে আমরা মোট কয় ভাইবোন !
রুনা একদিন যখন জানলো যে আমার বাবা ইউরোপের ই একটি অত্যন্ত উন্নত দেশে একজন রাস্ট্রদুত হিসেবে নিযুক্ত, সে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল।
সেদিন তার স্বামী, লিসি আর আমি লিভিংরুমে বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। রুনা ঢুকলো । আমি তাকে সিগারেট অফার করার সাথে সাথে সে কেমন যেন গুটিয়ে গেল । একটু হেসে ধন্যবাদ দিয়ে জানালো সে নন স্মোকার। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম শুনে।
এর আগে তাদের আমি একদিন বলেছিলাম 'এখানে ভালো ভালো নাইট ক্লাব আছে,তোমরা যেতে পারো, খুব এনজয় করবে'।
তাতে তারা দুজনেই মাথা ঝাকিয়ে জানিয়েছিলো সেখানে তারা যাবেনা।
সিগারেটের প্যাকেট টা টেবিলে রাখতে রাখতে বল্লাম, 'রুনা তুমি কেমন মেয়ে ! সিগারেট খাওনা, ড্রিন্ক করো না, নাইট ক্লাবে যাওনা'!
সে বল্লো তাদের দেশে নাকি এমন মেয়েই নিরানব্বই ভাগ। আমি খুব অবাক হোলাম। কি জানি হতেও পারে, আমার অবশ্য কোনো ধারণা নেই সে দেশ সম্পর্কে।
রুনা একদিন আমাদের রান্না করে খাওয়ালো ওদের দেশীয় রান্না। সেদিন আমার এক কাজিনও ছিল। এর আগে আমি কোনোদিন এমন খাবার খাইনি। ওহ সেই ডাল ও ছিল। আরেকটা মাছ বল্লো ওটাকে নাকি ইলিশ মাছ বলে। ওর স্বামী অনেক দাম দিয়ে বরফ জমা কতগুলো পিস কিনে এনেছিল। ভালোই খেতে কিন্ত বেশ কাটা। ওরা আমাদের মত কাটা ফেলে রান্না করেনা। তার চেয়ে গরুর মাংস আর ডালটাই আমার মজা লাগলো। লিসি তো যা মুখে দিচ্ছে তাই ওয়াও ওয়াও করছে। আমার ভাইয়েরও খুব ভালোলেগেছিল।যদিও একটু ঝাল লাগছিল।
লিসিও একদিন ইতালীর বিখ্যাত পাস্তা রান্না করে খাওয়ালো রুনাদের।তবে ওদের চোখমুখ দেখে মনে হলো খুব একটা ভালোলাগছে না। ওরা অনেক রকম মশলা খায়। আর আমাদের তো পাস্তা সেদ্ধ করে শুধু টমেটো সস। ভালো না লাগারই কথা।
ভালোই লাগছে ওদের সঙ্গ । লিসি তো ছুটি হলেই কোথায় না কোথায় চলে যায়। রুনা বেশ বুদ্ধিমতী। বুঝে ফেলেছে লিসি আমার বিবাহিত স্ত্রী নয়। লিসি অবশ্য সবসময় স্বামী বলেই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে মনে হাসি।
এর মধ্যে রুনারাও ভেনিস, নেপলস,ফ্লোরেন্স সহ আর কই কই যেনো বেড়িয়ে এসেছে। রুনা অবশ্য একা একাই সারাদিনের জন্য কয়েকটা জায়গা ঘুরে এসেছে গাইডেড ট্যুরে। ও বেচারা সারাদিন খালি বাসায় বসে কি করবে।
ওরা চলে যাবে আর দু তিনদিন পরেই।
লিসি অনেক দিন ধরেই তার একটা সাজানো গুছানো বেড রুম ভাড়া দেয় তার অফিসের বিদেশী কলিগদের কাছে। একটি রুমের ভাড়া প্রচন্ড রকম বেশী হলেও মানুষ ঐ এলাকায় অল্প দিনের জন্য বাসা পাওয়ার কথা স্বপ্নেও কল্পনাও করতে পারে না।
কিন্ত এর আগেতো কখনো এমন লাগেনি, কত মানুষই তো থেকে গেল পাঁচ দিন, দশ দিন করে। কিন্ত রুনারা চলে যাবে শুনে খারাপ লাগছে। এ কয়দিনে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওদের সাথে।
মেয়েটা ভারী মিশুক। আমরা মাঝে মাঝে ডাইনিং টেবিলে বসে কফি খেতাম আর বিভিন্ন গল্প করতাম। তবে ঐ যে বল্লাম বেশীরভাগ জুড়ে থাকতো তার ছেলের গল্প।
আজ সকাল থেকেই বেশ গরম পড়েছে । ইদানীং ইউরোপেও এমন গরম পরে মনে হয় আফ্রিকাতেই আছি। হাতে কতগুলো কোট প্যান্ট ফুটপাথে দাড়িয়ে আমি । পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া লোকদের দৃষ্টি আকর্ষনের ব্যার্থ চেষ্টা করছি।
ওটা কে হেটে আসছে !! কাধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে চোখে সান গ্লাস। রুনা না !! আস্তে আস্তে আমার দিকেই তো আসছে ।
হ্যা রুনাই তো ! লুকিয়ে যাবো নাকি ভাবছি। একটা দোটানা মনের মধ্যে।
ভাবতে ভাবতে রুনা এগিয়ে আসলো কাছে, যখন আর কিছু করার ছিলনা। বা হাত দিয়ে রুনা সানগ্লাসটা খুলতেই দেখলাম ওর চোখে মুখে অবাক হওয়ার চিন্হ ফুটে উঠেই দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। ওকে বলে এসেছিলাম ভার্সিটি যাচ্ছি।
আস্তে করে কাছে এসে আমার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে আমার বাড়িয়ে দেয়া হাত টা হাতের মধ্যে নিয়ে অনেক আন্তরিক ভাবে বল্লো, 'হাই মাইকেল, আজ কি ভীষন গরম পড়েছে তাই না!'
দেখলাম ওর চোখ দুটো আমার হাতে ঝুলানো কাপড় গুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে সন্তর্পনে। আমি যেন অস্বস্তিবোধ না করি সেদিকে তার সজাগ দৃষ্টি।
ওর ভাব দেখে আমার মনে হলো ও যেন আমাকে প্রতিনিয়তই দেখে আসছে ফুটপাথে দাড়ানো একজন পুরোনো কাপড় বিক্রেতা হিসেবে।
বল্লাম, 'ঠিকই বলেছো আজ খুব গরম পড়েছে'।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার বিশাল কালো হাতের মধ্যে একটি ছোট্ট শ্যামল হাত মিলে আছে, মনে হলো তৃতীয় বিশ্বের দুটি নাগরিকের দুঃখ, কষ্ট, চিন্তা আর চেতনাগুলো যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের এক শেতাঙ্গ দেশের আলো বাতাসের নীচে।