আজ মনিকার মনটা ভারী খুশী, তবে প্রচন্ড ক্লান্তির রেশ তার এখনও পুরোপুরি কাটেনি।
চার পাঁচ দিন আগে তার প্রথম বই প্রকাশ হয়েছে বই মেলায়। ভালোই পাঠক সাড়া পেয়েছে নতুন লেখক হিসেবে। এই বই প্রকাশ করা নিয়ে মাস খানেক ধরে কি দৌড়াদৌড়িই না চলেছে। এ সবের কিছুই বোঝেনা মনিকা। শুধু কিছু বন্ধু বান্ধবের পীড়াপীড়িতে এপথে আসা। অবশ্য তারা অনেক সাহায্য করেছে এ ব্যাপারে, না হলে তার পক্ষে একা কখনোই এটা সম্ভব হতোনা ।
পত্রিকার সাপ্তাহিকীতে আর দু একটা ছোটোখাটো ম্যাগাজিনে লিখেই অনেক খুশী ছিল মনিকা। তবে এখন সাধারন পাঠকদের আগ্রহ দেখে তার সব কষ্টের কথা ভুলে গেছে সে।
আজ প্রকাশকের স্টলে বসে নতুন একজন লেখকের বইএর পাতা উল্টাচ্ছে মনিকা। সকালের দিক মাত্র দু একজন ক্রেতা বা পাঠকের আনাগোনা স্টলের সামনের রাস্তায় ।
'এক্সকিউজ মি, শুনুন'।
ভারী একটি পুরুষালী কন্ঠের ডাকে চমকে তাকালো মনিকা।
'জী বলুন'।
'আপনাদের কাছে মনিকা চৌধুরীর লেখা ছোটো গল্পসমগ্র টি কি আছে' ?
৪০/ ৪৫ বছরের এক সুদর্শন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, বেশ লম্বা মতন, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা, অফ হোয়াইট কালারের ট্রাওজার আর পীচ কালারের একটি টি শার্ট পড়নে। গম্ভীর চেহারাটায় হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে আছে তার দিকে।
'জী আছে '।
'আচ্ছা ওনাকে কি পাওয়া যাবে' ?
'কেন'?
'না না এমনি একটি অটোগ্রাফ নিতাম তা হলে' ।
আকাশী নীল আর সাদার কম্বিনেশনে মনিপুরি শাড়ি পড়া মনিকার খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে হাল্কা করে উড়ছে। টানা টানা কাজল কাজল চোখ, কপালে ছোট্ট নীল টিপ আর হাল্কা একটু লিপস্টিক দেয়া ভীষন মায়াময় চেহারা নিয়ে লজ্জিত হয়ে তাড়া তাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে বল্লো,
'আমিই মনিকা চৌধুরী'।
তাই নাকি সত্যি বলছেন ! আশ্চর্য হয়ে যায় ভদ্রলোক !
'তবে কি মিথ্যা বলছি' ! একটু উস্মা ফুটে উঠে মনিকার কন্ঠে।
মনিকার গলার ঝাঁজ টের পেয়ে ভদ্রলোক অপ্রস্তত হয়ে আমতা আমতা করে জানালো,
'না না প্লিজ মনে কিছু করবেন না, আমি আসলে ভেবেছিলাম উনি একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা। কাল ওনার মানে আপনার দুটো গল্প পড়েছি ভীষন ভালোলেগেছে'।
'ওহ'।
'জী কাল পেপারে দেখলাম মেলায় আপনার বই প্রকাশ হয়েছে, তাই ভাবলাম যাই গিয়ে দেখি বইটা পাই কিনা। আমি বাইরে থাকি, মাস খানেকের জন্য বাংলাদেশে এসেছি। সপ্তাহখানেক পরেই চলে যাবো'।
'তাই! আমি দুঃখিত'! নিজের ব্যবহারে লজ্জিত মনিকা বইটি নিয়ে মুখ নীচু করে সযত্নে তার নাম লিখলো।
হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে ভদ্রলোক বল্লো,'জানেন বইটির নামের জন্যই কিনলাম'।
'তাই নাকি' চমকে উঠে মনিকা!
'হু, এটা আমার অনেক প্রিয় একটি গানের লাইন'।
'কি বলছেন ! এটা তো আমারও অনেক প্রিয়'।
'কি অদ্ভুত ঘটনা তাই না'!
'জী'।
'আপনি কি কখনো শুনেছেন এই গানটা'? প্রশ্ন করে আশফাক।
'শুনেছি একটু খানি, আর তাই নিয়েই আমার বইয়ের শিরোনাম'।
'আচ্ছা আজ আসি, যদি সময় পাই আরেকদিন এসে আপনাকে বিরক্ত করে যাবো'।
'না না কি যে বলেন, আমাদের মতন নতুন লেখকরা কিন্ত এতে অনেক উৎসাহ পাই'।
মাথা উচু করে ভদ্রলোক হেটে চলে যাচ্ছে গেটের দিকে ,মনে হয় যেন এই বইটি কিনতেই এসেছিল।
ভদ্রলোকের গলাটা ভীষন চেনা চেনা লাগছে, চেহারাটা কি কোথাও দেখেছে
মনে করতে পারছে না কিছুতেই। কি জানি হয়তো কোথাও দেখেছিল।
আশফাক রহমান বিদেশে থাকেন অনেক বছর। দু সন্তানের জনক। ছেলে মেয়ে দুজনেই বড় হয়ে গেছে, যার যার মত জীবন কাটছে তাদের।
ঘরে তার অপুর্ব সুন্দরী স্ত্রী । অনেক ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। সুখের সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছে তাদের জীবন। বড় একটি ফার্মে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সে।
মাঝখানে অবশ্য একটু ছোট্ট টানাপোড়েন চলেছিল কিছুদিন, তারপর এখন সব ঠিকঠাক।
দেশে এসেছে ভাইবোনের সাথে দেখা আর কিছু সম্পত্তি আছে ওগুলোর একটু বন্দোবস্ত করতে।
দুপুরে ভাবী অনেক কিছু রান্না করেছে। কত রকম মাছ আর কত রকম ভর্তাই যে বানিয়েছে। জানে আশফাকের এগুলো ভারী পছন্দ।
খেয়েদেয়ে তার জন্য বরাদ্দ রুমটায় বইটা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
ভারী মিস্টি দেখতে মনিকা চৌধুরী। এখনও মুখটা গেথে আছে মনে।
কেমন যেন একটু একটু চেনা চেনা। কি অল্পবয়সে কি সুন্দর গল্পই না লিখছে।
প্রথমে আমার প্রিয় গানের শিরোনাম নিয়ে গল্পটা পড়া যাক, দেখি কি লিখেছে সে?
এ কি ভারী অবাক হয়ে যাচ্ছে আশফাক ! একটা একটা করে লাইন পড়ছে আর দু বছর আগের স্মৃতির পর্দা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে।
তার জীবনের সেই নিঃস্বঙ্গ সময়ে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল একটি মেয়ের সাথে।কি একটা নাম বলেছিল ।
ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতো তারা। ঘুম নেই খাওয়া নেই। এখানে দিন তো, ওখানে রাত।
কি এক অদ্ভুত অবস্থা। একবার ফেসবুক তো, একবার ইয়াহু একবার ফোন কোনো ভাবেই যেন কথা শেষ হয়না।
মনিকাই কি সেই মেয়েটি ! নামটি তো এমনই ছিল মনে হয়। যদিও দেখা হয়নি কোনোদিন। নিজের পারিবারিক জীবন টি গোপনই রেখেছিল সে। যদিও মনিকা বেশ কয়েকবার ই জানতে চেয়েছে।
দুজনের দুটো অনেক পুরোনো ঝাপসা ছবি দেয়া ছিল প্রোফাইলে। তার মধ্যেও বোঝা যেত ভারী মিস্টি চেহারা।
অফিস যাবার আগে কত গল্প। একটা উত্তর দিতে এক সেকেন্ড দেরী হলোতো, 'কি হলো কই তুমি, কই গেলা শুনি'?
আবার অফিস থেকে ফিরে এসে শুরু হতো।
একদিন জানতে চাইলাম 'শোনো তুমি কি ঐ গানটা শুনেছো কখনো'?
'কোনটা'?
'ঐ যে, "কে প্রথম কাছে এসেছি" ওমনি সে চিৎকার করে বল্লো, 'আমি, আমি'।
"কে প্রথম চেয়ে দেখেছি" ওমনি সে আবারও বল্লো, 'আমি, আমি'।
কখনো পুরো গানটা বলতে পারিনি। গানটা কখনো শোনেনি সে। বলেছি গানের লিন্কটা পাঠাতে। কিন্ত গায়ক গায়িকার নাম জানিনা দুজনের কেউই, তাই লিন্কও খুজে পাইনা দুজন।
ওকে বলেছি সিডি টা যোগাড় করতে। প্রতিদিনই জানতে চাই বারবার করে, গানটা পেয়েছে কি না?
বলে 'না বের হতে পারছিনা, নানা ঝামেলা'।
তাদের এটা কি প্রেম ছিল কি না আজও বুঝতে পারেনা আশফাক।
আশফাক গানটার জন্য পাগল হয়ে গেছে। কিন্ত নানান ব্যস্ততায় আর বের হতে পারছেনা মনিকা। আশফাক বারবার বলছে 'গানটা পাঠাও, তার আগে তুমি অবশ্য শুনে নিও।'
মনিকা বলছে 'তোমার একটা ভালো ছবি পাঠাও তো,
তোমাকে ভালো করে চেনা যায়না ছবিতে। তুমি ঢাকায় আসলে কেমন করে চিনবো বলোতো'?
বলতে 'আচ্ছা পাঠাচ্ছি । সুন্দর করে সেজেগুজে তোমায় খুব শিগগির একটা ছবি পাঠাবো। গানটা পাঠাও লক্ষীটি'।
'পাচ্ছিনা তো গানটা, গায়কের নাম ছাড়া। তাছাড়া তুমি বলেছো ঢাকায় আসছো খুব তাড়াতাড়ি, তখন দুজনে মিলে খুজবো'।
'না না দেরী করোনা তাড়াতাড়ি পাঠাও।
'আচ্ছা'।
সকাল এগারোটা, আজ যে ভাবেই হোক গানটা খুজে বের করবেই মনিকা। কত দোকান যে খুজলো তার শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত সেই অধরার দেখা মিল্লো। বাসায় গিয়ে গানটা শুনবে। মনিকার যেন তর সইছেনা।
তাড়া তাড়ি বাসায় এসে কম্পিউটার অন করতেই দেখে তার নামে একটা মেইল। আশফাকের মেইল। মনে হয় ইয়াহুতে খুজে পায়নি আমায়। খুশীতে মুখটা ঝলমল করে উঠলো মনিকার। মেইল ওপেন করা পর্যন্ত যেন সহ্য হচ্ছেনা।
ক্লিক করে মেইল খুলে চোখ বোলাতেই অসাড় হয়ে উঠা হাত থেকে সিডিটা পরে গেল নীচে। হৃদস্পন্দন টা যেন ক্ষনিকের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। নিচু হয়ে সিডিটা কুড়াতে গিয়ে ঝাপসা চোখে হাতড়ে হাতড়ে খুজে পেল অবশেষে। বুকের মাঝে এক প্রচন্ড রক্তক্ষরণ শুরু হলোএবার।
আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে হেটে জানালার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে অনেক দুরে ছুড়ে ফেলে দিল সেলোফেনে মোড়ানো না খোলা সিডিটা।
আজ এ্যলিফেন্ট রোডের যানজটে বসে আছে মনিকা। গাড়ির গ্যাস শেষ হয়ে আসছে, তাই এসি বন্ধ করে জানালা খুলে রেখেছে। তাছাড়া ভোররাতে প্রচন্ড বৃস্টি হওয়াতে খুব একটা গরমও লাগছেনা তেমন।
বিশাল জট কখন ছাড়বে ঠিক নেই। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো পাশের সিডির দোকান থেকে সেই না শোনা গানটি, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে গাইছে।
"কে প্রথম কাছে এসেছি...
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি...
কিছুতেই পাইনা ভেবে...
কে প্রথম ভালোবেসেছি..."
মনে হলো কারো শক্ত হাতের থাবায় হৃদপিন্ডটা মুচড়ে উঠলো মনিকার, 'রফিক তাড়াতাড়ি গ্লাস উঠিয়ে এসি ছাড়ো ,পেট্রোলেই চালাও'।
দুদিন পর আশফাক মনকে অনেক শক্ত করে বইমেলায় এসে দাড়ালো। নেই মনিকা। ছোকরা মতন একজন বসে আছে ।
'মনিকা চৌধুরী কোথায় বলতে পারেন'?
"না আজ দুদিন ধরে উনি আসেন না"।
'ওনার ঠিকানা বা কোনো কনটাক্ট নম্বর আছে'?
"না আমার কাছে নেই, আর কারো কাছে আছে কিনা বলতে পারবো না ভাই।
'ওহ আচ্ছা'।
দুরে বট গাছটার আড়ালে দাড়িয়ে মনিকা দেখছে মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে পা ফেলে গেটের দিকে চলে যাচ্ছে আশফাক। যে কিনা তার জীবন থেকে সাময়িক চলে যাওয়া স্ত্রী ফিরে আসছে বলে বলেছিল, 'মনিকা তোমাকে একটা কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো'।
'কি বলো'? মনিকার গলায় আগ্রহ ঝরে পড়ে।
সেটা হলো তুমি সব বিষয় নিয়ে জোরাজুরি করো, যা সম্পর্কটাকে তিক্ত করে দিচ্ছে। শোনো আমি দুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি ফিরে এসে যোগাযোগ করবো'।
নাহ আর যোগাযোগ করেনি মনিকা, আর কোনো কথা হয়নি তাদের মাঝে আর কোনোদিন না।
সেদিন মনিকা ভেবেই পায়নি কি নিয়ে আশফাকের অভিযোগ! পরে অনেক ভেবে বের করতে পেরেছিল, আর তা হচ্ছে সেই ঝাপসা পুরোনো ছবিটার বদলে তার এখনকার তোলা একটা ছবি চেয়েছিল বার বার করে, আর কিছু নয়। আসলে ছিল তার স্ত্রীর পুনরায় ফিরে আসা যা মনিকা পরে জেনেছিল।